সোমবার, ১৪ মে, ২০১৮ ০০:০০ টা

বিএনপিকে কৌশলে আগাতে হবে

মেজর মো. আখতারুজ্জামান (অব.)

বিএনপিকে কৌশলে আগাতে হবে

সঠিক সময়ে সঠিক কাজ করতে না পারলে রাজনীতিতে পরাজিত হওয়া ছাড়া কোনো বিকল্প থাকে না। রাজনীতি সবাই জানে কিন্তু সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত সবাই নিতে পারে না।

রাজনীতি প্রচণ্ড খরস্রোতা নদীর মতো। খরস্রোতা নদী যেমন পাড়ের নরম মাটির কারণে বাঁক নিতে বাধ্য হয় তেমনি প্রতিপক্ষের দুর্বলতা রাজনীতির যুগান্তকারী সিদ্ধান্তের মাহেন্দ্রক্ষণ এনে দেয় এবং রাজনৈতিক বিজয় নির্ধারণ করে দেয়। রাজনৈতিক বিজয়ে প্রতিপক্ষের অবদান সবচেয়ে বেশি। রাজনীতিতে নেতা হতে তেমন বিদ্যাবুদ্ধি বা বড় বড় ডিগ্রি লাগে না, একমাত্র প্রয়োজন প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে সাহস করে দাঁড়ানো এবং শত প্রতিকূলতার মধ্যে ধৈর্য ধরে টিকে থাকা। সময়ই বিজয় এনে দেবে।

সব সফল এবং কিংবদন্তি তুল্য রাজনৈতিক নেতাদের জীবনী ও তাদের রাজনৈতিক কার্যক্রম গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে তারা সবাই তাদের প্রচণ্ডতম প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে অসীম সাহস নিয়ে লড়েছে এবং সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে টিকে থাকার সংগ্রাম করেছে।

বর্তমান প্রধানমন্ত্রীও কিন্তু ১৯৮১ সালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতি হয়ে সক্রিয় রাজনীতি শুরু করেছিলেন। আজকের এ অবস্থায় আসতে তার দীর্ঘ ৩৭ বছর সময় লেগেছে। এ দীর্ঘ সময় যারা ক্ষমতায় ছিলেন তারা বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর চেয়ে মেধায়, বুদ্ধি, ক্ষমতায় হয়তো কম ছিলেন না কিন্তু কালের স্রোতে সময় প্রতিপক্ষকে অবচয়ের নির্মম আঘাতে পেছনে ফেলে দিয়েছে। অবচয়ের এ নির্মমতা আবহমানকাল অব্যাহত থাকবে এবং বর্তমান ক্ষমতাসীনরাও এ অবচয়ের শিকার হবেন যা শুধু সময়ের ব্যাপার। সময়ের আগে ক্ষমতাসীনদের সরাতে গেলে সংঘাত অপরিহার্য হয়ে যায়, যার ফলে ক্ষমতার দৌড়ে অনৈতিক প্রতিযোগিতা এবং সন্ত্রাস রাজনীতিতে অপ্রতিরোধ্য উপসর্গ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ব্যক্তিগত আক্রোশ ও প্রতিপক্ষকে নির্মূল করাই এখন মুখ্য রাজনৈতিক সংস্কৃতি হয়ে দাঁড়িয়েছে যেখানে নৈতিকতা বা মূল্যবোধ যেমন বিবেচ্য হয় না তেমনি সংবিধান ও আইনের গ্রহণযোগ্য বাধ্যবাধকতা বিভিন্নজনের কাছে ভিন্নভাবে ব্যবহৃত হয়। ক্ষমতাসীনরা সংবিধান ও আইনের ব্যাখ্যা ও প্রয়োগ সম্পূর্ণভাবে তাদের মতো করে এবং ক্ষমতার অংশীদার এবং সুবিধাভোগীরা সে ব্যাখ্যাকেই ঢোল পিটিয়ে প্রতিষ্ঠিত করে যার ফলে সাধারণ মানুষ এবং ক্ষমতার বাইরের বা বিরোধীরা অসহায় হয়ে যায়। যেমন আজকে সংবিধানের সরকারি দলের ব্যাখ্যায় তারা বৈধভাবেই রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করে আছে এবং ক্ষমতাসীনদের আইনি ব্যাখ্যার মারপ্যাঁচে দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় নেত্রী আজকে কারারুদ্ধ। সরকারের ক্ষমতার দাপটে আইনের সব পথ রুদ্ধ করে রাখা হয়েছে তিনবারের সাবেক প্রধানমন্ত্রীর জন্য। একজন বয়স্ক বিশিষ্ট নাগরিকের প্রতি যে আচরণ ও ব্যবহার করা হচ্ছে তা খুবই দুঃখজনক। সরকার আজকে বিএনপির ওপর চড়াও হওয়ায় তাদের ওপর নেতিবাচক চরম আকার ধারণ করেছে। বিএনপির কোনো পর্যায়ের নেতা-কর্মী সরকারের রোষানল থেকে মুক্তি পাচ্ছে না। রাষ্ট্রের পুলিশ বাহিনী আজকে সন্ত্রাস দমন ও নিয়ন্ত্রণের নামে বিএনপির হাজার হাজার নেতা-কর্মীকে দাবড়ে বেড়াচ্ছে এবং যে কোনো ছুতায় বিএনপির নেতা-কর্মীদের হয়রানি করা হচ্ছে কিন্তু রাষ্ট্র এ ব্যাপারে একদম নীরব। আজকে রাষ্ট্র মানে আওয়ামী লীগ এবং ক্ষমতা মানে প্রধানমন্ত্রী, এর বাইরে আর কিছু নেই। সব রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা একজনের হাতে। রাষ্ট্র আজকে শুধু একজনের পক্ষ নিয়ে বিএনপির বিরুদ্ধে নেমেছে। সরকার বিএনপিকে এক ভয়াবহ অবস্থার দিকে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে যাতে বিএনপি সশস্ত্র সংগ্রামে নামতে বাধ্য হয়। এই ছুতো ধরে যাতে সরকার বিএনপিকে চিরতরে বিলীন করে দিতে পারে। সরকার অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে সে পথেই আগাচ্ছে। তবে বিএনপির ভয় বা ঘাবড়ানোর কিছু নেই। সংকট যত গভীর হবে সমাধান তত বেশি নিকটবর্তী হবে। বিএনপির চেয়ারপারসন আজকে কারারুদ্ধ। সিদ্ধান্ত এখন দলের নিবেদিত, ত্যাগী ও যোগ্য নেতাদেরই নিতে হবে। আজকে সময় এসেছে বিএনপির নেতাদের সামনে তাদের যোগ্যতা, দক্ষতা, দলের প্রতি তাদের দায়বদ্ধতা এবং চেয়ারপারসনের প্রতি সব প্রশ্নের ঊর্ধ্বে নেতাদের আনুগত্যের প্রমাণ রাখার।

সময়ের দাবি নেতাদের সামনে এগিয়ে আসতে হবে। কী রাজনৈতিক কৌশল নিয়ে নেতারা মাঠে নামবেন তা খোঁজার কোনো প্রয়োজন নেই। শুধু লক্ষ্য রাখতে হবে সরকার কী করছে এবং আগামীতে কী করতে চায়। সরকার এখন নিজেকে যতই শক্তিশালী ভাবুক না কেন সরকার কিন্তু দিন দিন দুর্বল হয়ে যাবে। সরকার বাংলাদেশে জোয়ার এনে জনগণের সামনে উন্নয়নের আইডল হতে চায়, তাই আগামীতে প্রয়োজনে গণতন্ত্র রুদ্ধ করে হলেও উন্নয়ন কর্মকাণ্ড দেখিয়ে লিকুয়ান বা মাহাতির মোহাম্মদ হওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করবে। আমাদের ভুলে যাওয়া উচিত নয় এদেশের মানুষ সাদ্দাম-গাদ্দাফির ভক্ত। অনেকে প্রকাশ্যেও বলেন এদেশে একজন সাদ্দাম আসত বা লিকুয়ান বা মাহাথির মোহাম্মদের মতো উন্নয়নের রূপকার আসত তাহলে সেই সরকার স্বৈরাচারী হলেও কোনো সমস্যা ছিল না!

সরকার মনে হয় সে পথেই হাঁটছে। কিন্তু উন্নয়নের রাজনীতির সবচেয়ে বড় দুর্বলতা হলো এতে লুটেরা শ্রেণি তৈরি হয়। সরকারি দলের নেতা-কর্মী, চামচা-চাটুকার এবং দলের সাঙ্গপাঙ্গ ও অনুসারীদের লাগামহীন দুর্নীতিতে জড়িয়ে যাওয়ার বিপদ সৃষ্টি করে। তবে উন্নয়নের রাজনীতির সবচেয়ে বড় শক্তি হলো কেউ এর বিরোধিতা করতে পারে না। সবাই কোনো না কোনো কারণে উন্নয়নকে সমর্থন করে এবং উন্নয়নের সঙ্গে বিভিন্নভাবে জড়িয়ে যায়। আমরা সবাই কোনো না কোনোভাবে উন্নয়নের সুবিধাভোগী হয়ে যাই, যার ফলে সরাসরি উন্নয়নের বিরোধিতা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। তবে সবাই উন্নয়নের নামে কোনো প্রকার দুর্নীতি, অপকর্ম বা যে কোনো প্রকার সন্ত্রাসী কার্যক্রম চরমভাবে বিরোধিতা করতে প্রস্তুত থাকে এবং কেউ যদি দুর্নীতি, অপকর্ম বা সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে সাহস দেখায় তাহলে চূড়ান্ত সংগ্রামে সাহসীদের সঙ্গে থাকে যার ভূরি ভূরি প্রমাণ আমাদের সামনে আছে।

বিএনপিকে উন্নয়নের বিরোধিতা করার রাজনীতির পথে হাঁটলে আমাদের গণবিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার অবস্থা সৃষ্টি হতে পারে যা ভবিষ্যৎ রাজনীতিতে প্রচণ্ড প্রতিকূল অবস্থায় ফেলে দিতে পারে। কিন্তু উন্নয়নের রাজনীতিকে উৎসাহিত করে যদি দেশব্যাপী দুর্নীতি প্রতিরোধ করার দুর্বার মনোভাব চাঙ্গা করে তোলা যায় তাহলে উন্নয়নের রাজনীতির সবচেয়ে বড় ফায়দা হবে বিএনপির। দেশব্যাপী দুর্নীতিবিরোধী মনোভাব সৃষ্টি করতে হলে সবার আগে দলকে দুর্নীতিমুক্ত করে অত্যন্ত গণতান্ত্রিকভাবে সুসংগঠিত করতে হবে যাতে জনমনে দৃঢ় আস্থা সৃষ্টি হয় যে বিএনপি একটি গণতান্ত্রিক দল এবং বিএনপি বিশ্বাস করে গণতন্ত্র ছাড়া জনপ্রত্যাশিত উন্নয়ন সম্ভব নয়। সরকার উন্নয়নের জন্য গণতন্ত্রকে বিদায় করে দেবে যেটা হবে সরকারের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা এবং এর বিপরীতে বিএনপিকে হাঁটতে হবে গণতন্ত্রের পথে এবং জনগণের সামনে অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে প্রমাণ করাতে হবে গণতন্ত্র ছাড়া উন্নয়নে দেশ ও জাতির কোনো উন্নতি হয় না।

জনগণ মনে করে গণতন্ত্র ছাড়া উন্নয়নে দুর্নীতি ও সন্ত্রাসের ব্যাপকতা বাড়ে এবং জনগণের অকল্যাণ বয়ে আনে। তাই আগামী রাজনীতিতে বিএনপিকে দুর্নীতি ও সন্ত্রাসে জিরো টলারেন্স এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, আচার-আচরণ ও অনুশীলনে একশ ভাগ বাধ্যবাধকতা নিশ্চিতভাবে প্রকাশমান করতে হবে। আগামীতে দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠিন সাহসী অবস্থান নিয়ে দাঁড়াতে পারলে বিএনপির সুদিন কোনো শক্তিই ঠেকাতে পারবে না বলেই জনগণের দৃঢ় বিশ্বাস।

তথাকথিত সাবেকি ঢঙে সন্ত্রাসী কার্যক্রম বা আন্দোলনের বাঁধাধরা পথে না হেঁটে আগামীতে যদি বিএনপি সন্ত্রাস ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে সাহসের সঙ্গে প্রকাশ্যে দুর্বার গণপ্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারে তাহলে দেশের বেশিরভাগ মানুষ বিএনপির পক্ষে আসবে এবং আন্তর্জাতিক সমর্থনও অনেক বেড়ে যাবে বলেই অনেকের বিশ্বাস।

বিএনপির রাজনৈতিক কৌশল নিয়ে অযথা মাথা না ঘামিয়ে সরকারের দুর্বলতা চিহ্নিত করে সেখানে সময়মতো আঘাত হানার ক্ষমতা অর্জনই হবে আগামী দিনের সঠিক রাজনৈতিক কৌশল। সেই ক্ষমতা ও দক্ষতা অবশ্যই বিএনপি নেতৃত্বের আছে বলে জনগণের মধ্যে প্রচণ্ড আস্থা এখনো রয়েছে।

            লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর