সোমবার, ১৪ মে, ২০১৮ ০০:০০ টা

আইন যেখানে সবার জন্য সমান

শামীম আল আমিন

একবার ইতালির রোম শহরে গিয়েছিলাম। একদিন রাস্তায় গাড়িতে বসে আছি। কোনো এক অজ্ঞাত কারণে সরু রাস্তাটিতে অস্বাভাবিক রকমের যানজট লেগে গেছে। এমন সময় অ্যাম্বুলেন্সের সাইরেন শুনতে পেলাম। মনে মনে ভাবতে শুরু করলাম, হায়! যানজটের এই রাস্তা পেরিয়ে অ্যাম্বুলেন্সটা কীভাবে তার গন্তব্যে পৌঁছাবে! কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে অ্যাম্বুলেন্সটি ঠিকই যানজট ঠেলে মুহূর্তেই সেখান থেকে বেরিয়ে গেল। অদ্ভুতভাবে গাড়িগুলো সরে গিয়ে ঠিকই জায়গা করে দিল মরণাপন্ন রোগীর জন্য। দায়িত্ববোধের সেই উদাহরণ আজও আমার মনে দাগ কেটে আছে। উদাহরণ হিসেবে কতবার যে সেই ঘটনা বলেছি, সেই সংখ্যা মনে নেই। তবে আইন, আইনের প্রয়োগ আর আইনের প্রতি শ্রদ্ধা, তিনটি ক্ষেত্রেই যুক্তরাষ্ট্র অসাধারণ একটি দেশ। আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে কিছু ভুলের ঘটনাও হয়তো কখনো ঘটে, কিন্তু প্রমাণিত হলে তার দায়ভারও সংশ্লিষ্টদের নিতে হয়। আইন এখানে সবার জন্যই সমান। আর এ জন্যই প্রয়োজন হলে দেশটির প্রেসিডেন্টকেও ইম্পিচমেন্টের মুখোমুখি করার বিধান রয়েছে। নির্বাচনে রাশিয়ার সঙ্গে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ক্যাম্পেইন টিমের গোপন আঁতাতের অভিযোগ নিয়ে তদন্ত চলছে এ দেশে।

আর আইন সবার জন্য সমান বলেই একজন পর্নোস্টার মামলা করতে পারেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের বিরুদ্ধে। এ নিয়ে প্রেসিডেন্টের ব্যক্তিগত অ্যাটর্নি মাইকেল কোহেনের বিরুদ্ধে তদন্তও চলছে; এমনকি তার বাসা এবং অফিসে পর্যন্ত অনুসন্ধান চালিয়েছে এফবিআই। হাতে গুনে দেখুন না যৌন হয়রানির অভিযোগ নিয়ে সম্প্রতি কত রথী-মহারথীর পতন হয়েছে। তাদের মধ্যে ক্ষমতাধর রাজনীতিবিদ থেকে শুরু করে শোবিজের ডাকসাইটে ব্যক্তিও আছেন। যৌন হয়রানির অভিযোগে হলিউডের প্রভাবশালী প্রযোজক হার্ভে ওয়েনস্টেইন কীভাবে রাজত্ব ছাড়া হয়েছেন, কিংবা ‘অ্যামেরিকার ড্যাড’ নামে পরিচিত বিল কসবিকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে তা সবাই দেখেছে। পুলিশের কাজ আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করা। কিন্তু এ দেশে অপরাধ করে পুলিশও পার পেয়ে যায় না। একজন মানুষ যত প্রভাবশালীই হোন না কেন, তিনিও আইনের ঊর্ধ্বে নন। আর এটাই আমেরিকার বিউটি। গত আড়াই বছরে নিউইয়র্কে বসবাসের অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি, এখানে মানুষের আইন মেনে চলার প্রবণতা অনেক বেশি। দুটি কারণে সাধারণ মানুষ এখানে আইন মেনে চলে বলে আমার ধারণা। একটা শ্রেণি রয়েছে যারা অত্যন্ত সভ্য-ভদ্র। তারা আইনের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ থেকেই তা মেনে চলে। আর আরেকটা শ্রেণি রয়েছে, তারা আইনের কঠিন প্রয়োগের কারণে ভয় থেকে তা মেনে চলে।

গুরুত্বপূর্ণ কোনো ব্যক্তি হলেও, এ দেশে উল্টোপথে কেউ গাড়ি চালিয়ে যেতে পারবে না। কেউ যায়ও না। রাস্তায় যেখানে-সেখানে গাড়ি পার্কিং করার চেষ্টাও কেউ করে না। নির্দিষ্ট জায়গায় নিয়ম মেনে গাড়ি পার্কিং না করলে, তার জন্য মাশুল গুনতে হয়। তবে মানুষের জীবন বাঁচানো ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষার কাজে অ্যাম্বুলেন্স, ফায়ার সার্ভিস ও পুলিশের গাড়ি সেটা করতে পারবে। কারণ এ দেশে এই সংস্থাগুলো প্রবলভাবে মানুষের পাশে থাকে। সাইরেন বাজানো অবস্থায় অ্যাম্বুলেন্স কিংবা ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি পেছনে এলে সামনে থেকে অন্য গাড়িগুলোকে অবশ্যই সরে যেতে হবে, মানুষ সরেও যায়। একইভাবে প্রচণ্ডগতিতে পুলিশের গাড়ি সাইরেন বাজিয়ে যাচ্ছে, আর সামনের গাড়ি দ্রুত পাশে সরে যাচ্ছে, এই দৃশ্যও এখানে চিরচেনা। তবে সাইরেন না বাজিয়ে নিয়মিত টহলের অংশ হিসেবে পুলিশের যে গাড়ি চলছে, তাকে সাইড দেওয়ার কোনো প্রয়োজন কেউ দেখায় না। তার জন্য কোনো সংকট তৈরি হওয়ারও ঝুঁকি নেই। সবচেয়ে দারুণ ব্যাপার হচ্ছে, স্কুল বাসগুলো এখানে খুব গুরুত্ব পায়। একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। কোনো কারণে যদি একটি স্কুল বাস কোথাও দাঁড়িয়ে থাকে, আর দুই পাশের ‘স্টপ’ লেখা কান দুটো খুলে দেয়, তাহলে প্রেসিডেন্টের গাড়িও সেটিকে পাশ কাটিয়ে যেতে পারবে না। সামনে-পেছনে চলে যাওয়ার মতো জায়গা থাকলেও, সেটা সম্ভব নয়। কেউ যায়ও না। নিউইয়র্কে নিজে যখন প্রথম প্রথম গাড়ি চালানো শুরু করেছি, অনেকেই সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, স্কুল বাসের ব্যাপারে বেশি সাবধান। কারণ স্কুলবাসে ছোট ছোট বাচ্চারা থাকে। শিশুদের বিষয়গুলো এখানে অতি স্পর্শকাতর হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এ কারণেই কোনো স্কুল বাস যদি থামার সিগন্যাল দেয়, আর কেউ তা অমান্য করে, তাহলে তার শাস্তি অত্যন্ত কঠিন। আইন অমান্যকারী গাড়িচালকের লাইসেন্সের পয়েন্ট তো কাটা যাবেই, সেই সঙ্গে রয়েছে অর্থদণ্ডও। দেশটিতে সর্বত্র এসব আইন মেনে চলতে দেখি। তবে এর মধ্যেও ছোটবড় দুর্ঘটনা ঘটে, অপরাধ হয়। কারণ কোনো সমাজই অপরাধ মুক্ত নয়। এর মধ্যেও কোথাও কোথাও দেশি ভাইবোনদের রাস্তায় থুথু কিংবা পানের পিক ফেলা, অথবা সিগন্যাল না মেনেই দৌড় দিয়ে রাস্তা পার হওয়ার চেষ্টা দেখে ব্যথিত হই। দুর্ঘটনাও ঘটে। সুযোগ পেলে হয়তো গাড়ি চালানোর সময় কেউ কেউ রেডলাইট অমান্য করে বেরিয়ে যাওয়ারও চেষ্টা করেন। শাস্তিও পান অনেকে। কিন্তু শাস্তির চেয়ে কি সচেতনতা ভালো নয়! কমিউনিটি হিসেবে প্রবাসী বাংলাদেশিরা অনেক ভালো আর অনেক সচেতন বলেই আমার বিশ্বাস। এরপরও তো কাউকে কাউকে অপরাধে জড়িয়ে পড়তে দেখি। অপরাধহীন যেমন কোনো সমাজ নয়, তেমনি মনে রাখা ভালো কোনো সমাজই অপরাধকে সমর্থন করে না। ফলে নিয়মের মধ্যে, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ নিয়ে থাকাই সবার জন্য মঙ্গল। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এই লেখায় তুলে ধরতে চাই। সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ প্রতিরোধে আমেরিকার প্রতিটি সাধারণ মানুষ একাট্টা এবং অভিন্ন তাদের অবস্থান। রাজ্যভিত্তিক এবং পুরো দেশের পরিপ্রেক্ষিতেই সন্ত্রাস প্রতিরোধে ‘কঠোর’ ও ‘কার্যকর’ ধারাবাহিক পদক্ষেপ রয়েছে।

দেশের প্রয়োজনে কোনো কাজেই রাজনৈতিক বিরোধিতা কিংবা বিভেদও নেই। আর সন্ত্রাস প্রতিরোধে দেশের মানুষকে অত্যন্ত সফলভাবে সম্পৃক্ত করতে পারাটাই এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় উদাহরণ। নিউইয়র্কের কথা যদি বলি, সাবওয়েতে পাতাল ট্রেনে কিংবা বাসে উঠলে একটু পর পরই ভেসে আসে ‘নিরাপত্তা সতর্কবাণী’। বলা হয় ‘ইফ ইউ সি সামথিং, সে সামথিং (If You See Something, Say Something)’। কেবল তাই নয়, ট্রেন ও বাসের গায়ে, দেয়ালে লেখা রয়েছে, এমন সতর্কবার্তা। সন্দেহজনক কিছু দেখলে পুলিশ কিংবা মেট্রোপলিটন ট্রান্সপোর্টেশন অথরিটি বা এমটিএর কর্মীদের জানানোর জন্য অনুরোধ করা হয়েছে। সতর্ক থাকুন, সহযোগিতা করুন এবং নিরাপদ থাকুন—মূল বার্তাটি এমন। আর তাতে জনগণের ভালো সাড়া পাওয়া যাচ্ছে। অত্যাধুনিক প্রযুক্তি, প্রশাসনের সদিচ্ছা এবং সাধারণ মানুষের সম্পৃক্ততায় ভালোভাবেই সন্ত্রাসের ঝুঁকি মোকাবিলা করে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। তবে এর মধ্যেও ফাঁক গলিয়ে বিচ্ছিন্ন নানা ঘটনা ঘটে যাচ্ছে। তবে বসে নেই, কর্তাব্যক্তিরা। অপরাধ মোকাবিলায়, তাদের মতো করে, চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। দেশটির কাছ থেকে শেখার আছে অনেক কিছুই।

লেখক : হেড অব নিউজ, টিবিএন২৪ টেলিভিশন, নিউইয়র্ক।

            amin.one007¦gmail.com

সর্বশেষ খবর