সোমবার, ১৪ মে, ২০১৮ ০০:০০ টা

বাংলাদেশের সামাজিক রূপান্তর

তপন কুমার ঘোষ

বাংলাদেশের সামাজিক রূপান্তর

গত ২৫ এপ্রিল বাংলাদেশ প্রতিদিনের প্রথম পৃষ্ঠায় প্রকাশিত দুটি খবর অনেকেরই নজর কেড়েছে। একটির শিরোনাম, ‘গ্লোবাল উইমেন লিডারশিপ অ্যাওয়ার্ড পেলেন প্রধানমন্ত্রী’। যুক্তরাষ্ট্রের বেসরকারি সংস্থা ‘গ্লোবাল সামিট অব উইমেন’ বংলাদেশে নারী শিক্ষার প্রসার এবং নারী উদ্যোক্তা সৃষ্টিতে অগ্রণী ভূমিকা পালনের স্বীকৃতি হিসেবে প্রধানমন্ত্রীকে এই সম্মানজনক পদকে ভূষিত করেছে। অন্য খবরটির শিরোনাম ছিল, ‘এশিয়ার সবচেয়ে চমকপ্রদ ও অপ্রত্যাশিত সাফল্যের নাম বাংলাদেশ’। এই মন্তব্যটি করেছেন, বিশ্বব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ কৌশিক বসু। তার পর্যবেক্ষণ, বিশ্বের বুকে দ্রুত বিকশিত হচ্ছে বাংলাদেশের অর্থনীতি। আমার স্কুল জীবনটা গ্রামেই কেটেছে। প্রতি বছর অন্তত একবার হলেও এখন গ্রামের বাড়িতে যাই। আমাদের ছেলেবেলার সেই সময় আর এই সময়ের মধ্যে ফারাকটা স্পষ্ট চোখে পড়ে। বদলে গেছে অনেক কিছুই। ১৯২১ সালে প্রতিষ্ঠিত সিঙ্গাশোলপুর কে.পি ইনস্টিটিউশনের বয়স শতবর্ষ পূর্ণ হতে চলেছে। আমি এই স্কুলের প্রাক্তন ছাত্র। ষাটের দশকের কথা। স্কুলের সুনাম চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। আমরা ক্লাস নাইনে পড়ি। সেবার একজন ছাত্রী ক্লাস সিক্সে ভর্তি হয়। ব্রাহ্মণ পরিবারের মেয়ে। সবার নজর তার দিকে। শিক্ষকদের রুমের এককোনে জড়সড়ো হয়ে বসে থাকত। ক্লাসের ঘণ্টা বাজলে শ্রেণি শিক্ষকের পিছু পিছু হেঁটে ক্লাসে ঢুকত। ক্লাস শেষে আবার শিক্ষকের পিছু নিত। পথেঘাটে অনেক কটু মন্তব্য সহ্য করতে হয়েছে ওই মেয়েটিকে। কিন্তু হাল ছাড়েনি। তার দেখাদেখি পরের বছর থেকে দু-তিনজন করে ছাত্রী ক্লাস সিক্সে ভর্তি হয়। সেই শুরু। এখন ওই স্কুলে ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা প্রায় সমান সমান। দেশে নারী শিক্ষার কতটা প্রসার হয়েছে, এই পরিসংখ্যান থেকে তা স্পষ্ট।

ওই সময় বাল্যবিয়ের প্রচলন ছিল। মেয়েদের তেরো-চৌদ্দ বছর বয়সেই বিয়ে হয়ে যেত। ছেলেদের পনেরো-ষোলো বছর বয়সে। ‘বয়স্থা’ মেয়ে নিয়ে অভিভাবকদের দুশ্চিন্তার অন্ত ছিল না। ছেলেদের বয়স পনেরো পেরোলেই বিয়ে দেওয়ার তোড়জোড় শুরু হতো। ছেলে ‘জোয়ান’ হয়েছে না! এখন পাল্টে গেছে প্রথা। প্রতিষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত ছেলে বা মেয়ে কেউই এখন বিয়ে করতে রাজি হয় না। বাল্যবিয়ের বিরুদ্ধে এখন অপ্রাপ্তবয়স্করাই সোচ্চার। প্রতিবাদ করে, বেঁকে বসে। আইনের বিধান অনুযায়ী, এখন মেয়েদের বিয়ের সর্বনিম্ন বয়স আঠারো আর ছেলেদের একুশ।

পণ দিতে না পারায় অনেক মেয়ের বিয়ে ভেঙে যেত। প্রতিশ্রুত যৌতুক না পেয়ে বিয়ের আসর থেকে বর উঠে গেছে, এমন ঘটনার কথাও শোনা যেত। অধিকাংশ ক্ষেত্রে পাত্রপক্ষের দাবি, সোনার আংটি, হিরো বা প্রিন্স বাইসাইকেল, কেমি বা সিটিজেন ব্র্যান্ডের হাতঘড়ি, আর একটা রেডিও। এ ছাড়া তিন পদের গয়না দিয়ে পাত্রীকে সাজিয়ে দিতে হবে। ধার-দেনা করে বিয়ের টাকা জোগাড় করতেন কন্যাদায়গ্রস্ত পিতা। এখনকার শিক্ষিত সমাজে যৌতুক নিয়ে দর-কষাকষি হয় না। অবশ্য, পণপ্রথার অভিশাপ থেকে এখনো পুরোপুরি মুক্ত হতে পারেনি সমাজ। আইন হয়েছে। পণ দেওয়া-নেওয়া এখন শাস্তিযোগ্য অপরাধ। নড়াইলের একটি অপরিচিত গ্রাম সুমেরুখোলা। গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে চিত্রা নদী। খরার মৌশুমে পানীয়জলের হাহাকার পড়ে যেত। গ্রামের একমাত্র টিউবওয়েলে পানি ওঠে না। তখন নদীর দূষিত পানি ছিল একমাত্র ভরসা। নিরাপদ পানির অভাবে ফিবছর ডায়রিয়ার প্রকোপ দেখা দিত। কলেরা-মহামারীতে মানুষ মারা যেত। অসুখ-বিসুখ হলে ঝাড়ফুঁক, মন্ত্রতন্ত্র, তাবিজ, কবজ, পানিপড়া ছিল একমাত্র ভরসা। গ্রামের মানুষ এখন আগের তুলনায় অনেক বেশি স্বাস্থ্য সচেতন। প্রায় প্রতিটি বাড়িতে এখন টিউবওয়েল। স্বাস্থ্যসম্মত পায়খানা। রোগ পুষে না রেখে শহরে যান চিকিৎসকের কাছে। সম্পন্ন পরিবারের মায়েরা সন্তান জন্মদানের আগে ক্লিনিকে ভর্তি হন। শিশুমৃত্যুর হার এখন অনেক কম। জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার এক দশমিক এক শতাংশ। বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু এখন ৭২, যা পাকিস্তান এবং ভারত থেকে বেশি। চৈত্র-বৈশাখ ছিল অভাব-অনটনের মাস। অভাবের তাড়নায় ফলধরা গাছগাছালি, এমনকী পোষা গরু-ছাগল পর্যন্ত বিক্রি করে দিন গুজরান করতেন অভাবী মানুষ। অনন্যোপায় হয়ে গ্রাম্য মহাজনের কাছ থেকে চড়া সুদে টাকা কর্জ নিতেন। এখন গ্রামের নারীরা স্বাবলম্বী হওয়ার চেষ্টা করছেন। এনজিও কিংবা ব্যাংক থেকে ক্ষুদ্রঋণ নিয়ে ছোটখাটো ব্যবসা বা খামার গড়ে তুলে ভালোই আয়-রোজগার করছেন। গ্রামে এমন মানুষও ছিলেন যারা কোনো দিন শহরে যাননি, ট্রেন দেখেননি বা বাসে চড়েননি। জীবনে কোনো দিন ডাক্তারের কাছে যাননি বা ওষুধ সেবন করেননি, এমন মানুষেরও সাক্ষাৎ মিলত। খালি পায়ে ও খালি গায়ে জীবন পার করে দিয়েছেন অনেকে। জরাজীর্ণ কুঁড়েঘরে বসবাস। এখন গ্রামের মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বেড়েছে। দারিদ্র্য কমেছে। জীবনমান উন্নত হয়েছে। রুচিরও পরিবর্তন হয়েছে। স্মরণ করি, আমাদের ছোটবেলায় কোনো সামাজিক অনুষ্ঠানের নিমন্ত্রিত অতিথিদের বাড়ির উঠানে লাইনে বসিয়ে কলাপাতায় খেতে দেওয়া হতো। এখন ডেকোরেটরের দোকান থেকে টেবিল-চেয়ার-ক্রোকারিজ ভাড়া করে আনা হয়। অধিকাংশ গ্রামে এখন বিদ্যুৎ পৌঁছে গেছে। যেখানে বিদ্যুৎ নেই, সেখানে জেনারেটর ভাড়া করে অনুষ্ঠানে আলোকসজ্জার ব্যবস্থা করা হয়। গ্রামের অবস্থাপন্ন ব্যক্তিরা এখন কমিউনিটি সেন্টারে বিয়ের অনুষ্ঠান করেন। উৎসব উপলক্ষে রমণীরা শহরে গিয়ে কেনাকাটা করেন। পার্লারে গিয়ে সাজেন।

গ্রামের ছেলেরা এখন স্মার্টফোন হাতে নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। মোটরসাইকেল নিয়ে এদিক-ওদিক ছোটাছুটি করে। গ্রামের রাস্তাঘাটের উন্নতি হয়েছে। শণের ছাউনির পরিবর্তে এখন ঘরের চালায় ঢেউটিন চকচক করে। নারী শিক্ষার প্রসারের ফলে নারী তার অধিকার সম্পর্কে এখন অনেক বেশি সচেতন। নিজের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা নারীর বেড়েছে। নারীর ক্ষমতায়নের ব্যাপারে সরকারের অবদানের পাশাপাশি এনজিওগুলোর অবদানও অনস্বীকার্য।

লেখক : সাবেক উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক, জনতা ব্যাংক লিমিটেড।

সর্বশেষ খবর