শনিবার, ১৯ মে, ২০১৮ ০০:০০ টা

একজন মাহাথির আমাদেরও প্রয়োজন

নূরে আলম সিদ্দিকী

একজন মাহাথির আমাদেরও প্রয়োজন

মালয়েশিয়ার মাহাথির মোহাম্মদ ৯২ বছর বয়সে দেশের অতি দুর্বল বিরোধী দলকে সংগঠিত করে ১২০টি আসন পেয়ে প্রধানমন্ত্রীর আসনে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। তার এ বিজয় বিস্ময়কর তো বটেই, পৃথিবীর রাজনৈতিক ইতিহাসে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে এটি শুধু অভূতপূর্ব, অবিস্মরণীয় ও অসাধারণই নয়, অদ্বিতীয়ও বটে। মালয়েশিয়ার প্রান্তিক জনতার কাছে তিনি নির্ভীক, সৎ ও সত্যাশ্রয়ী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত।  বাংলাদেশে তার বিজয়ে নানারকম প্রতিবেদন ও প্রতিক্রিয়া আসছে। মূলত সবাই এ বিজয়টির কারণ হিসেবে নাজিব রাজাকের সীমাহীন দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতিকেই দায়ী করছেন।  ঘটনাটি সত্য বিধায় কোনোমতেই ভিন্নমত পোষণ করার অবকাশ নেই। তবুও এ কথাটি অস্বীকার করার উপায় নেই যে, ১২০টি আসনে বিজয়ী হওয়ার পেছনে দুর্বল বিরোধী দলকে ঢেলে সাজানো এবং প্রার্থী বাছাই করা শুধু অচিন্ত্যনীয় ব্যাপারই নয়, মাহাথির মোহাম্মদের কল্পনাতীত সাংগঠনিক শক্তি ও দূরদর্শিতার পরিচয় বহন করে। তা সত্ত্বেও তার শারীরিক শক্তি ও মনোবল এবং চিত্তের প্রত্যয়দৃঢ়তা যে কতখানি তা কল্পনা করাও কঠিন। এখানে ছোট্ট করে একটি মন্তব্য করে রাখি। মাহাথির মোহাম্মদের বিজয়ে বাংলাদেশে প্রচণ্ড উল্লসিত হয়েছেন হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। তার উল্লাসের বিশেষ কারণ হলো, তিনি তার দলের কর্মী, নেতৃবৃন্দ এবং প্রান্তিক জনতাকে জানান দিতে চান, ‘দুই নেত্রী’র অপশাসন, দুঃশাসন, একনায়কতান্ত্রিক মানসিকতা ও দুর্নীতির অতল গহ্বর থেকে তিনিও বাংলাদেশকে টেনে তুলতে পারেন। এটি তার ব্যক্তিগত প্রত্যাশা। প্রত্যাশা থাকা ভালো। মানুষ প্রত্যাশার ওপরই বেঁচে থাকে। কিন্তু বাংলার সাধারণ মানুষ, এমনকি তার নিজ দলের নেতা-কর্মীরাও আদৌ উজ্জীবিত, অনুপ্রাণিত বা উদ্বেলিত নন। কারণ মাহাথির মোহাম্মদের যে নিষ্কলুষ ভাবমূর্তি মালয়েশিয়াতে সুপ্রতিষ্ঠিত, বাংলাদেশে তা শুধু এরশাদ সাহেবই নয়, কোনো রাজনৈতিক নেতৃত্বই মাহাথির মোহাম্মদের মতো এমন নিষ্কলুষ ভাবমূর্তি বহন করেন না। ২২ বছরের শাসনামলে মাহাথির মোহাম্মদ তার প্রজ্ঞা, দূরদর্শিতা, নিষ্কলুষ এবং দুর্নীতি-বিবর্জিত আলোকছটায় উদ্ভাসিত যে বিমূর্ত আঙ্গিকে তাকে মালয়েশিয়ার প্রান্তিক জনতার কাছে অভিষিক্ত করেছে, বাংলাদেশে সেরূপ দৃষ্টান্ত সরকার এবং বিরোধী দলে কারোরই নেই। দুর্নীতি তো বটেই, ভয়ভীতি, প্রাপ্তি-প্রত্যাশার বাইরে তেমন কেউই নন। পেশিশক্তি ও কালো টাকার বিরুদ্ধে যিনি বা যারা বিরামহীন বুলি কপচান, ডিজিএফআইর একজন মেজর বা সামরিক গোয়েন্দা সংস্থার মধ্যম শ্রেণির একজন সেনাকর্তা টেলিফোনে ধমক দেওয়া তো দূরে থাক, একটি হুঁশিয়ারি প্রদান করলেই তল্পিতল্পা গুটিয়ে বেশ কিছু দিনের জন্য প্রবাসী জীবনযাপন করতে তড়িঘড়ি করে তারা বিদেশ গমন করেন। শুধু সে কারণেই তাদের তর্জনগর্জন কর্মীদেরও যেমন অনুপ্রাণিত বা উদ্বেলিত করে না, তেমনি জনগণের কাছেও হাস্যস্পদ মনে হয়।

দুর্নীতি, মূল্যবোধের অবক্ষয়, মৌলিক অধিকার-বিবর্জিত সমাজ ও মানুষকে শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা থেকে উদ্ধার, দেশ ও সমাজে মানুষকে রাজনৈতিক অধিকারসচেতন করে তোলা কেবল কথার কথা নয়, এটি দলনেতার জন্য একটি সংকল্প ও প্রত্যয়ের আওতায় পড়ে। আর সেটি অর্জন করতে হলে অনেক চড়াই-উত্রাই পার হতে হয়, অনেক নির্যাতন-নিগ্রহের শিকার হতে হয়; অনেক লোভ-লালসা ও প্রাপ্তি-প্রত্যাশাকে বিসর্জন দিতে হয়। নেতৃত্বের নিষ্কলুষ মানসিকতা সাধারণ কর্মীর মনে প্রতীতি ও প্রত্যয়ের জন্ম দেয়। যেটি লক্ষ্য করে ধীরে ধীরে মানুষ ওই আন্দোলনটির সঙ্গে সক্রিয়ভাবে জড়িয়ে পড়ে। তখন আর ভাড়া করে জনসভায় লোক আনতে হয় না। সংবাদমাধ্যমগুলোকে তোয়াজ করে সংগঠনের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে হয় না। বরং নির্যাতন-নিগ্রহ সহ্য করে নির্ভুল ও কল্যাণমুখী কর্মসূচি সঙ্গে নিয়ে সম্মুখে চলার ব্রতী হলে কর্মী ও সাধারণ মানুষ একাত্ম হয়ে ওঠে। আর তখনই একেকটি আন্দোলনের সোপান উত্তরণের মধ্য দিয়ে নেতৃত্ব সাফল্যের সৈকতে পৌঁছে যায় এবং বিজয়কেতন উড়িয়ে সবাইকে বিস্ময়াভিভূত করে জানান দিতে পারেন তার বিজয় বার্তা। যেমনটি করে দেখালেন মাহাথির মোহাম্মদ।

মাহাথির মোহাম্মদ শুধু দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বলেননি। মালয়েশিয়ার নাজিব রাজাকের সরকার ছিল আপাদমস্তক দুর্নীতিগ্রস্ত। এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদে জ্বলে ওঠা মাহাথির মোহাম্মদ শুধু বুলি কপচাতেন না, তিনি ছিলেন প্রত্যয়দৃঢ়, অকুতোভয়, সৎ ও সাহসী হিসেবে মালয়েশিয়ানদের হৃদয়ের সিংহাসনে অধিষ্ঠিত মুকুটহীন সম্রাট। ক্ষমতাসীন প্রধানমন্ত্রী তারই একসময়ের শিষ্য মাহাথিরের পৃষ্ঠপোষকতায়ই ক্ষমতায় আরোহণ করতে সক্ষম হন। আধুনিক মালয়েশিয়ার জনক মাহাথির মোহাম্মদ টানা ২২ বছর দেশটিতে ক্ষমতাসীন ছিলেন। তিনি যে রাজনৈতিক দলের মাধ্যমে ক্ষমতাসীন ছিলেন, সেই দলটি টানা দীর্ঘ ৬০ বছর দেশটির ক্ষমতায় থেকে বিশ্বে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।

লক্ষ্য করার মতো বিষয় হলো, মাহাথির মোহাম্মদের নির্বাচনের এজেন্ডা ছিল। তার উপ-প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিমকে ২০ বছর আগের বিভিন্ন অপরাধে, বিশেষ করে দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির দায়ে তিনি কারারুদ্ধ করেন। তার নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি ছিল, ক্ষমতায় এসে যত শিগগিরই সম্ভব রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার সাধারণ ক্ষমার আওতায় তিনি আনোয়ার ইব্রাহিমের দণ্ড মওকুফ তো করবেনই, রাষ্ট্রীয় ক্ষমা ঘোষণার আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্নের প্রয়োজনে অল্প কিছু দিন ক্ষমতায় থেকে আনোয়ার ইব্রাহিমকে প্রধানমন্ত্রীর আসনে অধিষ্ঠিত করবেন। আনোয়ার ইব্রাহিমের স্ত্রী ওয়ান আজিজাহর সযত্নে লালিত সংগঠনটির মাধ্যমেই এ লড়াইয়ে তিনি বিজয়ী হয়েছেন। তার এ বিজয় দুর্নীতিগ্রস্ত নাজিব রাজাকের পরাজয় যেমন নিশ্চিত করেছে, তেমনি আনোয়ার ইব্রাহিমের প্রধানমন্ত্রী পদে অধিষ্ঠিত হওয়ারও সুযোগ সৃষ্টি করেছে। বিষয়টি সত্যিই বড় চমৎকার। ২০ বছর আগে দুর্নীতির দায়ে যাকে কারারুদ্ধ করলেন, তাকেই ক্ষমতাসীন করার জন্য এ নির্বাচনী লড়াইয়ে তাকে অবতীর্ণ হতে হলো। আনোয়ার ইব্রাহিমকে কারারুদ্ধ করার পর নাজিব রাজাককে ক্ষমতায় বসানো হলে দুর্নীতি তো কমেইনি, বরং বিশাল আকার ধারণ করে। মাহাথির মোহাম্মদ মরুভূমির নিষ্কলুষ সূর্যরশ্মির মতো স্বচ্ছ ও সাবলীল একটি সত্তা। তাই তার হৃদয়ে একটা অদ্ভুত প্রতিক্রিয়ার জন্ম নেয়। তার হয়তো মনে হয়েছে, আনোয়ার ইব্রাহিম ২০ বছর কারাভোগ করে পাপের চাইতে বেশি শাস্তি ভোগ করেছেন; তার প্রায়শ্চিত্ত হয়ে গেছে। এখন ক্ষমতাসীন হলে তিনি নিশ্চয়ই শুচিশুদ্ধ মন নিয়ে দেশ শাসন করবেন। কারাগারে অবস্থানকালে নিশ্চয়ই আত্মশুদ্ধির যে সাধনা আনোয়ার ইব্রাহিম করেছেন তা হয়তো মাহাথির মোহাম্মদ পর্যবেক্ষণ করেছেন এবং পর্যবেক্ষণ করেই একটি নতুন নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় এসে তিনি তারই রাজনৈতিক শিষ্য, যাকে তিনি নিজেই কারাদণ্ড দিয়েছিলেন তাকে দেশ শাসনের সুযোগ দিয়ে তিনি শুধু আত্মতৃপ্তি লাভ করতে চাননি, জনগণের কাছে তার প্রদত্ত যে প্রতিশ্রুতি ছিল তা পূরণ ও আগের কিছু ভুল সংশোধনের সুযোগ গ্রহণ করেছেন। জনগণের কাছে তার প্রদত্ত অঙ্গীকার পূরণ হলে আনোয়ার ইব্রাহিমও অবশ্যই অতীতের সব তিক্ততা বিস্মৃত হয়ে শুচিশুদ্ধ মন নিয়ে মালয়েশিয়াবাসীর কাছে প্রমাণ করতে উদ্যোগী হবেন, মাহাথির মোহাম্মদের অনুতপ্ত মনের সিদ্ধান্ত ভুল ছিল না। তার পোড়-খাওয়া হৃদয়ের মধ্যে ২০ বছরে তিলে তিলে গড়ে ওঠা দেশপ্রেমের অমিত শক্তি নিয়ে মালয়েশিয়াকে নতুন করে বিনির্মাণে তিনি বিশ্বকে চমকে দিতে ব্রতী হবেন। মাহাথির মোহাম্মদের নিয়তে কোনো কৃত্রিমতা ছিল না বলেই আমার বিশ্বাস। ভবিষ্যতের প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিমও এ বিশ্বাসকে লালন করেই দুর্নীতি-বিমু্ক্ত শুচিশুদ্ধ মন নিয়ে মালয়েশিয়াকে সুচারুরূপে পরিচালিত করবেন— এটি আশা করা যায়। গুরুর সিদ্ধান্তটিকে তিনি শুধু সম্মান প্রদর্শনই করবেন না, তিনিও একটি যুগান্তকারী দৃষ্টান্ত স্থাপন করবেন— এ আশায় বুক বেঁধে মালয়েশিয়াবাসী উদগ্রীব হয়ে আছে। শুধু মাহাথির মোহাম্মদই নন, পতিব্রতা ওয়ান আজিজাহ অঙ্গীকার করেছেন তার স্বামীর পক্ষ থেকে। বলার অপেক্ষা রাখে না, আগামী দিনের শাসনকালে তার স্ত্রীর অঙ্গীকার আনোয়ার ইব্রাহিমকে আলোর পথে থাকতেই উদ্বুদ্ধ করবে। স্বামীকে ২০টি বছর কারাগারে অবরুদ্ধ থাকতে দেখে তার হৃদয়ে যে রক্তক্ষরণ হয়, তারই প্রেক্ষাপট ওয়ান আজিজাহকে অনুপ্রাণিত করে তিল তিল করে গড়ে তোলা সংগঠনটির মাধ্যমে আনোয়ার ইব্রাহিমের কারামুক্তির আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য। এটা মোটেও সহজসাধ্য কর্ম নয়। মালয়েশিয়া এমনিতেই রক্ষণশীল একটি দেশ। সেখানে একজন মহিলা হিসেবে তাকে যে কী কঠোর অধ্যবসায় ও প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে বিরোধী দলটিকে পরিচালিত করতে হয়েছে এবং তারই মাধ্যমে আন্দোলন গড়ে তুলতে হয়েছে সেটি অনুমান ও অনুধাবন করতে কষ্ট হয় না। তারই ফলশ্রুতি, তিনি দেশটির উপ-প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পেয়েছেন। তারা সুচারুরূপে তাদের দায়িত্ব পালন করতে পারলে মালয়েশিয়া সন্দেহাতীতভাবে উন্নয়নের আরও কয়েকটি ধাপ তো এগিয়ে যাবেই, বরং বিস্ময়কর উন্নয়নের শিখর চূড়ায়ও অবস্থান নিতে পারে।

মালয়েশিয়ার প্রতিবন্ধকতাও অনেক। মাহাথির মোহাম্মদ যখন বলতেন— look towards east; তখন উন্নত দেশগুলো বিশেষ করে পাশ্চাত্যের আমেরিকার আত্মসম্মানে আঘাত লাগত। পার্শ্ববর্তী দেশ চীন মালয়েশিয়াকে শিল্প ও বাণিজ্যের ক্ষেত্রে অত্যন্ত শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করত। তারপরও মালয়েশিয়া শিল্প ও বাণিজ্যে স্থির লক্ষ্যে এগিয়ে গেছে এবং এর অগ্রদূত ছিলেন মাহাথির মোহাম্মদ। তার পরিকল্পনা ছিল নিখুঁত এবং পরিকল্পনা বাস্তবায়নে প্রত্যয়ও ছিল অভূতপূর্ব। প্রধানমন্ত্রী হওয়ার আগে তিনি দেশটির শিক্ষামন্ত্রী ছিলেন। তখন তিনি শিক্ষাখাতে বাজেটের সবচেয়ে বেশি বরাদ্দ নিতেন এ যুক্তিতে যে, আধুনিক মালয়েশিয়া বিনির্মাণে যোগ্য, শিক্ষিত ও দক্ষ জনগোষ্ঠী অত্যাবশ্যক এবং এর কোনো বিকল্প নেই। শুধু মালয়েশিয়ার জন্য নয়, পৃথিবীজুড়ে বিশেষ করে বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের ক্ষেত্রেও এটা অবশ্যই প্রযোজ্য।

বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করার জন্য শিল্প বিনির্মাণের অবকাঠামো সৃষ্টিতেও তিনি সবিশেষ গুরুত্ব দিয়েছিলেন। মালয়েশিয়া খনিজসমৃদ্ধ দেশ নয়, কিন্তু বনজ সম্পদ তাদের রয়েছে। দক্ষ জনগোষ্ঠী, শিল্প বিনির্মাণের অবকাঠামো, বিদ্যুৎ ও যোগাযোগ ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন ও আধুনিকীকরণের মাধ্যমে তিনি বিশ্বের শিল্পোদ্যোক্তাদের দৃষ্টি নিবিড়ভাবে আকর্ষণ করতে সক্ষম হন। ফলে বৈদ্যুতিক ও টেলিযোগাযোগসহ মধ্যম শ্রেণির পণ্য উৎপাদনে মালয়েশিয়ায় যুগান্তকারী বিপ্লব সৃষ্টি হয়। বিভিন্ন উন্নত দেশের বিনিয়োগের মাধ্যমে দেশটির শিল্পখাত এত দ্রুত বিকাশ লাভ করে যে, শিল্পোন্নত দেশগুলোর মালয়েশিয়াতে প্রতিস্থাপিত ইলেক্ট্রনিক সামগ্রীসহ সব ধরনের পণ্য বিশ্ববাজারকে অনেকটাই দখল করে ফেলে। জাপানি পণ্য উৎপাদনে মূলত কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয় মালয়েশিয়া। দক্ষ জনগোষ্ঠী ও আপেক্ষিকভাবে কম অর্থায়নে উৎপাদিত শিল্পসামগ্রীতে মান ঠিক ছিল কিন্তু দাম অনেক কম। তাই মালয়েশিয়ায় উৎপাদিত শিল্পসামগ্রী সহজেই দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বাজার তো বটেই, মধ্যপ্রাচ্য এমনকি পাশ্চাত্য দেশের বাজারেও অনায়াসে সুদৃঢ় স্থান করে নেয়। সমগ্র মালয়েশিয়ার আয়তন বাংলাদেশের চারগুণের কাছাকাছি। কিন্তু জনসংখ্যা এক-তৃতীয়াংশেরও নিচে। ফলে মালয়েশিয়ার দক্ষ জনগোষ্ঠী তো বটেই, সাধারণ মানুষেরও কর্মসংস্থান হলো অতি দ্রুতগতিতে। শিল্প-কারখানা, বৃহৎ বৃহৎ অট্টালিকা, সুপ্রশস্ত নির্ভরযোগ্য বিস্তীর্ণ রাস্তা বিনির্মাণে সরগরম হয়ে উঠল গোটা দেশটি। বাংলাদেশ থেকেও প্রচুর শ্রমিকের কর্মসংস্থান হলো মালয়েশিয়ায়। বর্তমানে দেশটিতে পাঁচ লক্ষাধিক বাংলাদেশি শ্রমিক কাজ করছে।

তাদের বনজ সম্পদকে প্রায় অক্ষত রেখেই আধুনিক মালয়েশিয়া হিমাচলের মতো মাথা তুলে দাঁড়াতে সক্ষম হলো একটিমাত্র মানুষের সততা ও সদিচ্ছার ওপর ভিত্তি করে। মালয়েশিয়াবাসী তাদের অভ্যন্তরীণ খুঁটিনাটি বিদ্বেষ ও বিরোধ ভুলতে শুরু করল আধুনিক মালয়েশিয়া বিনির্মাণে আত্মনিয়োগ করে। প্রবাদ আছে, কর্মব্যস্ততা মানুষকে শুধু সচল ও সচ্ছল করে না, অলস মস্তিষ্কের অনেক হীনমন্যতা থেকেও রক্ষা করে। ঝঞ্ঝা-বিক্ষুব্ধ উপকূলের মতো বাংলাদেশের অর্থনীতি আজ বিপর্যস্ত। আর্থিক কোষাগার কেবলই নিচের দিকে নেমে আসছে। ব্যাংকগুলো তারল্য সংকটে জর্জরিত। দুর্নীতি রাহুর মতো দেশটিকে গ্রাস করে ফেলেছে। দুর্নীতির বিস্তার আজ যেন অপ্রতিরোধ্য। দুর্নীতি কোথায় নেই, সেটি খুঁজে বের করা দুষ্কর। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ভুল সিদ্ধান্ত ‘টিক’ মারা পদ্ধতির পরীক্ষার উদ্ভাবন। পদ্ধতিটি শিক্ষার মান বিনষ্ট তো করেছেই, যারা এ পদ্ধতিতে ডিগ্রি নিয়েছে তারা চাকরি-বাকরির নিয়োগের ক্ষেত্রে অসহায় বোধ করছেন। শিক্ষাবিষয়ক বিশেষজ্ঞরা মন্তব্য করছেন, এ প্রবর্তিত ধারাটি অব্যাহত থাকলে অচিরেই পূর্ণ এক পৃষ্ঠা শুদ্ধ বাংলা বা ইংরেজি লেখার মতো যোগ্যতাসম্পন্ন যুবক-যুবতী খুঁজে বের করা দুষ্কর হবে। যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে প্রাচ্যের অক্সফোর্ড বলা হতো, সেই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেরিয়ে আসা ডিগ্রিধারী শিক্ষার্থীরা যদি সৃজনশীলতা ও বুদ্ধিমত্তায় দেউলিয়াত্বে ভোগেন— তার চেয়ে বেদনাদায়ক ও মর্মান্তিক কিছু হতে পারে না। এখানে আমি বার্টান্ড রাসেলকে উদ্ধৃত করতে চাই। তিনি মন্তব্য করে গেছেন— প্রাকৃতিক দুর্যোগের বিশাল ও বিপুল ক্ষয়ক্ষতি অচিরেই কাটিয়ে ওঠা যায়।  কিন্তু মূল্যবোধের অবক্ষয় ও শিক্ষা-সংস্কৃতির দেউলিয়াত্বে কোনো জাতি নিপতিত হলে তার থেকে বেরিয়ে আসতে এক শতাব্দী সময় লেগে যেতে পারে।

এ সত্যটিকে মাহাথির মোহাম্মদ পরিপূর্ণভাবে হৃদয়ঙ্গম করতে পেরেছিলেন বলেই তিনি আজ সারা বিশ্বের বিস্ময়। আমাদের দেশের নেতৃত্ব নতুন প্রজন্মকে মেধাহীন জড়পদার্থে দলীয় অনুগত বাহিনীতে পরিণত করার যে আত্মঘাতী খেলায় উন্মত্ত, তা থেকে বেরিয়ে আসতে হবেই। তাই আমাদের দেশেও একজন মাহাথির মোহাম্মদ খুবই প্রয়োজন।  সেই মাহাথির মোহাম্মদকে বরমাল্যে ভূষিত করার জন্য হৃদয়ের দুয়ার খুলে অধীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষায় বসে আছি।

লেখক : স্বাধীন বাংলা ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের অন্যতম নেতা।

সর্বশেষ খবর