শনিবার, ১৯ মে, ২০১৮ ০০:০০ টা

সমন্বিত খামারে কোটি টাকার বাণিজ্য

শাইখ সিরাজ

সমন্বিত খামারে কোটি টাকার বাণিজ্য

অনেকটা নীরবেই বাংলাদেশের তরুণদের একটা দল কৃষিকে পাল্টে দিচ্ছে। এই মুহূর্তে মনে পড়ছে সাতক্ষীরার সাইফুল্লাহ গাজী, ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়ার আবু বকর সিদ্দিক প্রিন্স, ইজাজুল ইসলাম ইমন, মাগুরার সফল মাশরুম চাষি বাবুল আক্তার, পঞ্চগড়ের দেবীগঞ্জের শরাফত, নারায়ণগঞ্জের মকবুল হোসেনের কথা। না, শুধু কর্মক্ষেত্র তৈরির জন্য নয়, সত্যিকার অর্থেই কৃষিকে ভালোবেসে এসব  তরুণ কৃষিকে ঘিরে স্বপ্ন দেখেছেন, তৈরি করেছেন নিজের সাফল্য।  প্রমাণ করেছেন নিষ্ঠা ও একাগ্রতা থাকলে কাজে সফলতা আসেই। গত ফেব্রুয়ারিতে দেখা মিলল এমন আর এক তরুণের সঙ্গে। নরসিংদীর কিবরিয়া গাজী। যে কিনা একটা গরু দিয়ে শুরু করেছিলেন খামার এবং একটা পুকুর দিয়ে শুরু হয়েছিল তার মাছের চাষ। আর এখন তরুণ এই উদ্যোক্তা কিবরিয়া গাজী বিশাল এক সমন্বিত খামারের গর্বিত মালিক। যেখানে রয়েছে ১০০টি মোটাতাজাকরণের গরু, ৩৫টি দুধের গাভী, ১৮ হাজার লেয়ার মুরগি। আর ৬০টি বড় বড় পুকুরে মাছের চাষ। সঙ্গে ঘাস উৎপাদন খামার আর বায়োগ্যাস প্লান্ট। সব মিলে ২০০ বিঘা আয়তনের বহুমুখী কৃষি উৎপাদন ক্ষেত্র। 

গত ফেব্রুয়ারিতে, তখনো শীতের কিছুটা আমেজ রয়ে গেছে প্রকৃতির চাদরে। হালকা কুয়াশা ভেদ করে সূর্য ঢেলে দিচ্ছে তাপ ও রং। এমন এক সকালে গিয়ে হাজির হলাম হৃদয়ে মাটি ও মানুষের ধারকদলসহ নরসিংদীর শিবপুরে কিবরিয়া গাজীর বিশাল খামারে। ৩৫-৩৮ বছরের এই তরুণকে দেখে বিশ্বাসই হবে না, সে এক বিপ্লব ঘটিয়ে দিয়েছে তার এলাকায়। কথা হলো তার সঙ্গে। জানালেন, খামারের শুরুটা দুই দশকেরও বেশি আগে, ১৯৯৫ সালে। কিবরিয়া গাজীর তখন শিক্ষাজীবন। টেলিভিশনে মাটি ও মানুষের অনুষ্ঠান দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে বাড়ির একটি পুকুরে মাছ চাষ আর একটিমাত্র গাভী দিয়ে শুরু হয় তার খামার। তারপর দিন গেছে আর একে একে সাফল্য এসে ধরা দিয়েছে তার হাতে।

খামারের প্রবেশমুখেই পোলট্রির বিশালাকার ছাউনি। সেখানে ১০ হাজার লেয়ার মুরগি লালন-পালন করছেন তিনি। ভিতরের দিকে আরও একটি খামার রয়েছে। সব মিলে প্রতিদিন উৎপাদিত হচ্ছে ১৪ হাজার ডিম।

একসঙ্গে ৪০টি পুকুর, বিশাল এলাকাজুড়ে তার মাছের কারবার। মাছ চাষের এ উদ্যোগের সঙ্গে আছে সুদূরপ্রসারী হিসাব-নিকাশ। আছে বিনিয়োগ ও মুনাফা তুলে আনার নানামুখী পরিকল্পনা। উদ্যোক্তা কিবরিয়া গাজী জানালেন, আশির দশকে বাংলাদেশ টেলিভিশনে মাটি ও মানুষ অনুষ্ঠানের মাছ চাষে উদ্বুদ্ধকরণ প্রয়াস হাকিম আলীর মৎস্য খামারের কথা। নিজেকে তিনি অগণিত হাকিম আলীর একজন মনে করেন।

কিবরিয়া গাজী মাছ চাষের নানা কৌশল জানতে ছুটেছে দেশের নানা প্রান্তে। অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের জন্য ঘুরেছেন বিদেশের খামারেও। এসব অভিজ্ঞতা প্রয়োগ করেছেন নিজের খামারে। ফলে বছরে প্রায় এক হাজার থেকে এগারোশ টন মাছ উৎপাদন করছেন তিনি। আর যা থেকে বছরে আসছে কোটি টাকার মতো। তখন শুকনো মৌসুম, চাষের মাছের চাহিদা কম। তারপরও প্রতিদিন চার থেকে পাঁচ টন মাছ উঠানো হয়েছে।

কিবরিয়া গাজী ১৫ বিঘা জমিতে চাষ করছেন পাচং ঘাস। তিনি জানান, আখের মতোই লম্বা এ ঘাসে কিছুটা মিষ্টতা রয়েছে বলে গরু খেতে খুব পছন্দ করে। আগে তিনি নেপিয়ার চাষ করেছিলেন। কিন্তু পাচং দ্রুত ফলনশীল বলে লাভজনক বেশি। প্রতিদিন ২-৩ টন ঘাস তিনি উৎপাদন করছেন। শুধু ঘাসই নয়। পাচংয়ের বীজ তিনি বিক্রি করছেন আশপাশের খামারিদের কাছে। এখান থেকেও মিলছে লাভের অংক।

কিবরিয়া গাজীর খামারে প্রতিদিন চলে নানামুখী কর্মযজ্ঞ। মাছ ধরা থেকে বাজারজাত পর্যন্ত কাজে যুক্ত রয়েছেন বহু কর্মী। ৬০ জন নিয়মিত কর্মী কাজ করছে তার খামারে এবং চুক্তিভিত্তিক মৌসুমি শ্রমিক কাজ করে ৫০ জনের মতো। শুধু নিজের কর্মসংস্থানই নয়, কিবরিয়া গাজী শতাধিক মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছেন। সারা দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে কর্মীরা এসে কাজ করছেন এখানে। লালমনিরহাট, ভোলা, শরিয়তপুরসহ নানা অঞ্চলের কর্মীদের সঙ্গে কথা হলো। জানাল কিবরিয়া গাজীর সঙ্গে কাজ করে ভালো আছেন তারা। এমন অনেকেই আছেন যারা এখানে কাজ করছেন ১০-১৫ বছরের অধিক সময় ধরে।

না, এখানেই সমাপ্তি নয়। দৃষ্টি আরও সুপ্রসারিত কিবরিয়া গাজীর। লক্ষ্য বহুদূর। তিনি জানান, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বাড়বে সতেজ ও অর্গানিক খাদ্যের চাহিদা। নতুনভাবে অনুপ্রাণিত হচ্ছেন তিনি। স্বপ্ন দেখছেন এই সমন্বিত খামারকে বহুদূর এগিয়ে নেওয়ার। শহরের আবাসিক এলাকাগুলোর বাজার ধরার পরিকল্পনা রয়েছে তার।

প্রিয় পাঠক, বাণিজ্যিক ও পরিকল্পিত কৃষি সব সময়ই লাভজনক। এর জন্য চাই নিষ্ঠার সঙ্গে জেনে বুঝে একেকটি পদক্ষেপ নেওয়া। জেনে বুঝে পরিকল্পনামাফিক যারা কৃষিতে আত্মনিয়োগ করেছিলেন তারা নিজেরা যেমন সফল হয়েছেন, একইভাবে যুক্তি পরামর্শ ও উৎসাহ দিয়ে গড়ে তুলেছেন অনেক সফল উদ্যোক্তা। দেশের কৃষি অর্থনীতিতে যেমন ভূমিকা রাখছেন একইভাবে পুষ্টি উন্নয়নেও তাদের ভূমিকা অনেক গুরুত্বপূর্ণ।  কিবরিয়া গাজীর মতো উদ্যোক্তা এখনো নতুন প্রজন্মের জন্য দারুণ এক অনুপ্রেরণা।

লেখক : মিডিয়া ব্যক্তিত্ব।

            [email protected]

সর্বশেষ খবর