মঙ্গলবার, ৫ জুন, ২০১৮ ০০:০০ টা

শেয়ারবাজারে উত্থান-পতন

তপন কুমার ঘোষ

শেয়ারবাজারে উত্থান-পতন

সময়টা শেয়ারবাজারে বিনিয়োগকারীদের জন্য ভালো নয়। শেয়ারবাজারে যেন শনির দশা লেগেছে। বিনিয়োগকারীদের কপালে ভাঁজ। আর ভাঁজ পড়বেই না কেন? এক মাসের বেশি সময় ধরে সূচকের টানা পতন চলছে শেয়ার-বাজারে। টানা দরপতনের ফাঁকে একদিন সূচক সামান্য বাড়ে তো পরদিন আবার পতনের বৃত্তে ঢুকে পড়ে। মে মাসের শেষ কার্যদিবসে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের সূচক ৫ হাজার ৩৪৪ পয়েন্টে নেমে আসে, যা ছিল গত ১৫ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন। টানা দরপতনে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আস্থাহীনতা দেখা দিয়েছে।

শেয়ারবাজারে কেন এ অস্থিরতা? টানা দরপতনের সঠিক কারণ খুঁজে পাচ্ছেন না অনেকেই। বাজার বিশ্লেষকদের একাংশের মতে, বাজারে তারল্য সমস্যা এখনো রয়ে গেছে। তাদের ধারণা, ব্যাংক আমানতে সুদের হার ও ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ার প্রভাব পড়েছে পুঁজিবাজারে। অনেকে মনে করছেন, একটি চক্র নানা ধরনের গুজব ছড়িয়ে দরপতন ঘটিয়ে কম দামে শেয়ার কেনার চেষ্টা চালাচ্ছে। পরে কারসাজি করে বাজার বাড়িয়ে বেশি দামে শেয়ার বিক্রি করে বাজার থেকে কেটে পড়বে এরা।

রোজকার খবরের কাগজ ঘাঁটলে দেখা যাবে, অবাক করার মতো অনেক কিছুই ঘটছে আমাদের শেয়ারবাজারে। জানুয়ারির ঘটনা। ২০১৬ সালের জুন থেকে কোম্পানির উৎপাদন বন্ধ। কোম্পানির পুঞ্জীভূত লোকসানের পরিমাণ দিন দিন বাড়ছে। দুর্বল মৌলভিত্তির ‘জেড’ শ্রেণিভুক্ত এ কোম্পানিটি স্বাভাবিক কার্যক্রমে ফিরতে পারবে কিনা এ নিয়ে সংশয় আছে খোদ কোম্পানির নিরীক্ষকদের। কিন্তু এসবে বয়েই গেছে বিনিয়োগকারীদের। বাজারে হু হু করে বাড়ছে কোম্পানির শেয়ারের দাম। তিন মাসে দাম বেড়ে হয়েছে প্রায় দ্বিগুণ। না, এটা কোনো গল্প নয়। ঢাকার একটি বহুল প্রচারিত দৈনিকে ৮ জানুয়ারি এ খবরটি ছাপা হয়েছে। খবরে বলা হয়, কোম্পানির শেয়ারের বাজারমূল্যের এমন উত্থানে হতবাক কোম্পানি কর্তৃপক্ষ। এই হচ্ছে ঢাকার শেয়ারবাজার।

শেয়ারমূল্যের ওঠানামা সাধারণত চাহিদা ও সরবরাহের ওপর নির্ভরশীল। দেখা গেছে, কিছু কিছু শেয়ারের বাজারমূল্য কোম্পানির নিট সম্পদ কিংবা আয়ের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। অতীতে দেখা গেছে, শেয়ারের মূল্যবৃদ্ধি ঘটেছে কোনো নিয়মনীতি ছাড়াই। মূলত, ছোট মূলধনী কোম্পানিগুলোই বাজার অস্থির করে তোলে। বিনিয়োগকারীদের মনে এ ধারণা বদ্ধমূল হয়েছে যে, শেয়ারবাজারে সিন্ডিকেট কাজ করছে। এ সিন্ডিকেট কারসাজির মাধ্যমে কিছু কিছু শেয়ারের দাম অযৌক্তিকভাবে বাড়িয়ে দেয়। শেয়ারের দাম যখন বাড়তে থাকে তখন অনেকেই ওই শেয়ার কিনতে হুমড়ি খেয়ে পড়েন। তখন দাম আরও বেড়ে যায়। সুযোগ বুঝে চড়া দামে শেয়ার বিক্রি করে কেটে পড়েন সুযোগসন্ধানীরা। এ ধরনের মূল্যবৃদ্ধি খুব বেশিদিন স্থায়ী হয় না। ‘যা দ্রুত বাড়ে তার পতনও হয় দ্রুত’। অবধারিতভাবে শুরু হয় দরপতন। পড়তি বাজারে আতঙ্কিত হয়ে অনেকে শেয়ার বিক্রি করে দেন। এ সময় ধৈর্য ধরতে হয়। কিন্তু আতঙ্ক তো আর যুক্তি মানে না। বিক্রির চাপে বাজার আরও পড়ে যায়। পুঁজি হারিয়ে পথে নামেন ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা। প্রবাদ আছে, ‘কেনার সময় পাগল, বেচার সময় ছাগল’।

সবাই লাভের আশায় বিনিয়োগ করেন। কিন্তু শেয়ার কিনলেই যে লাভ হবে, এটা ভ্রান্ত ধারণা। আমাদের শেয়ারবাজার অনেকটাই গুজবনির্ভর। এমনিতেই শেয়ারে পুঁজি খাটানো ঝুঁকিপূর্ণ। তার ওপর শুধু স্পেকুলেশন ও গুজবের ওপর ভিত্তি করে বিনিয়োগ করা হলে তা আরও বেশি ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠে। শেয়ারবাজারে স্পেকুলেশন থাকবে। কিন্তু তা হাওয়ার ওপর নির্ভর করে নয়।

আমাদের শেয়ারবাজারের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, এখানে ব্যক্তি-শ্রেণির অর্থাৎ সাধারণ বিনিয়োগকারীর সংখ্যা বেশি। প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী কম। অনেক ভালো কোম্পানি এখনো স্টক এক্সচেঞ্জে তালিকাভুক্ত নয়। বিনিয়োগকারীদের একটি অংশ শুধু গুজবের ওপর ভিত্তি করে বিনিয়োগ করেন। এটাই বড় সমস্যা। বিনিয়োগের ক্ষেত্রে অনেকে ঝুঁকি নিতে পছন্দ করেন। ঝুঁকি নিয়ে অনেকে লাভের কড়ি ঘরে তুলছেন, এও সত্য। শেয়ার ব্যবসাকে আলু-পটোলের ব্যবসার মতো মনে করলে ভুল করা হবে। খোঁজখবর না নিয়ে বিনিয়োগ করা অন্ধকারে ঢিল ছোড়ার শামিল। পণ্ডিতরা সেই কবে সাবধান করে দিয়েছেন, ‘ভাবিয়া করিও কাজ, করিয়া ভাবিও না’। যারা সময়ের অভাবে বা অন্য কোনো কারণে যাচাই-বাছাই করে বিনিয়োগ করতে পারেন না তাদের জন্য রয়েছে ‘মিউচুয়াল ফান্ড’।

শেয়ারে বিনিয়োগ করার আগে কোম্পানির ইতিহাস, আর্থিক অবস্থা, উৎপাদন, পণ্যের বাজার, আয়-ব্যয়, লাভ-ক্ষতি, সম্পদ, দায়-দেনা ও মূলধন সম্পর্কে জানতে হবে। কোম্পানি পরিচালনার দায়িত্বে যারা আছেন তাদের সম্পর্কেও জানতে হবে। কোম্পানির ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী? কোম্পানির প্রতিযোগী কারা? প্রতি বছর নিয়মিত বার্ষিক সাধারণ সভা অনুষ্ঠিত হয় কিনা? বিগত বছরগুলোয় কী হারে লভ্যাংশ দেওয়া হয়েছে? সিদ্ধান্ত গ্রহণের আগে এসব তথ্য জানা জরুরি। কোম্পানির শক্তি-দুর্বলতা-সম্ভাবনা সম্পর্কে জানতে কোম্পানির আর্থিক বিবরণী, বিশেষ করে ব্যালান্স শিট ও লাভ-লোকসান হিসাব বিশ্লেষণ করতে হবে। শেয়ারে বিনিয়োগসংক্রান্ত বহুল প্রচলিত অনুপাতগুলো হচ্ছে— শেয়ারপ্রতি আয় (ইপিএস), মূল্য-আয় অনুপাত (পি-ই রেশিও) ও নিট সম্পদ মূল্য (ন্যাভ) বা শেয়ারপ্রতি সম্পদের মূল্য। কর-পরবর্তী নিট মুনাফাকে মোট শেয়ারসংখ্যা দিয়ে ভাগ করে শেয়ারপ্রতি আয় নির্ধারণ করা হয়। অন্যপক্ষে, শেয়ারের বর্তমান বাজারমূল্যকে শেয়ারপ্রতি আয় দিয়ে ভাগ করে মূল্য-আয় অনুপাত পাওয়া যায়। যে কোম্পানির মূল্য-আয় অনুপাত যত বেশি, ওই কোম্পানিতে বিনিয়োগ তত বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। ম্যানিপুলেশনের মাধ্যমে কারা শেয়ারবাজার অস্থির করে তুলছে, তা খুঁজে বের করা তথ্যপ্রযুক্তির এ যুগে কি খুবই কঠিন কাজ? অনভিজ্ঞ ও ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের পকেট খালি করার এ অনৈতিক খেলা আর কতদিন চলবে?

 

লেখক : সাবেক উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক, জনতা ব্যাংক লিমিটেড।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর