বুধবার, ৬ জুন, ২০১৮ ০০:০০ টা

মাদকের পক্ষে সুশীল আলোচনা এবং কতিপয় প্রসঙ্গ

আলম রায়হান

মাদকের পক্ষে সুশীল আলোচনা এবং কতিপয় প্রসঙ্গ

শিশুতোষ একটি গল্প আছে। এক কিশোরের কলা খাবার খুবই ইচ্ছা হলো। তার আবদার পূরণ করার জন্য দৃষ্টিনন্দন এক কাঁদি কলা আনা হলো। এবার সে আবদার করল কলা ছিলে দিতে হবে। তাই করা হলো, শিশুর আবদার বলে কথা। কিন্তু এ ছিলা কলা খাবার পরিবর্তে কিশোরটি চিৎকার করে কাঁদতে শুরু করল। এবার তার আবদার হলো, ছিলা কলা আবার বুঝিয়ে দিতে হবে। কিন্তু তা কি সম্ভব? প্রকৃতির নিয়মে তা সম্ভব নয়। কিন্তু কিশোরটি অমোঘ এ নিয়ম মানতে নারাজ। কেঁদে-কেটে পুরো এলাকা মাথায় তোলার অবস্থা করল এবং সে তার কথা বলেই যাচ্ছে, ছিলা কলা বন্ধ কর!

অবুঝ এই কিশোরটির মতোই আচরণ করছেন কতিপয় সুশীল ব্যক্তি। তবে প্রসঙ্গ ভিন্ন। কিশোরটি অবাস্তব আবদার করেছিল ছিলা কলা নিয়ে, আর কথিত সুশীল সমাজের কতিপয় ব্যক্তি অবাস্তব কথা বলছেন চলমান মাদকবিরোধী চলমান অভিযান নিয়ে। মাদকের আগ্রাসনে দেশ ধ্বংসের অতল গহ্বরের কিনারে এসে দাঁড়িয়েছে বহু আগে। আর ব্ল্যাক হোলের গ্রাসে যাওয়ার ঠিক আগের মুহূর্তে শুরু হয়েছে মাদকবিরোধী বিশেষ অভিযান। অতি বিলম্বে হলেও বিষয়টিকে এক প্রকার রহমত হিসেবেই দেখছেন দেশবাসী। এবং কাকতালীয়ভাবে এটি শুরু হয়েছে রহমতের রমজান মাসে। এর এক বিশেষ তাৎপর্য আছে।

চলমান অভিযানের আগেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মাদকের ভয়াবহতার চিত্র বহুবার তুলে ধরেছেন। এ নিয়ে করণীয় বিষয়েও নির্দেশ দিয়েছেন সংশ্লিষ্টদের। তাও একাধিকবার, বলা চলে বহুবার। তিনি যতবার জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে বলেছেন, ততবারই বলেছেন মাদকের ভয়াবহতা সম্পর্কে। জঙ্গিবাদের রাশ কিছুটা টেনে ধরা সম্ভব হলেও মাদকের ব্যাপারে কিছুই হচ্ছিল না। বরং মাদকের পাগলা ঘোড়া ছুটছিল বল্গাহীন। এ অবস্থায় মানুষ যখন হতাশ এবং মাদক ব্যবসায়ীরা সীমা ছাড়া বেপরোয়া অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে সক্রিয়; তখন শুরু হয় মাদকবিরোধী অভিযান। যা সাধারণের কাছে দেশ রক্ষার অভিযান হিসেবে এরই মধ্যে পরিচিতি লাভ করেছে। কিন্তু এর বিরুদ্ধে একটি গ্রুপ দাঁড়িয়ে গেল। এরা সামনে নিয়ে এলো, অভিযানে আদম সন্তানের মৃত্যু প্রসঙ্গ। এর বিপরীত মতও বেশ জোরালো। নূরুজ্জামান খোকন ফেসবুকে সাংবাদিক মোস্তফা ফিরোজের এক স্ট্যাটাসে মন্তব্য করেছেন, “সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে অধিক সংখ্যক মাদক ব্যবসায়ী নিহত হওয়ার খবর না দেখলে এখন মানুষের ভালো লাগে না...। ভালো কিছু করতে গেলে কিছু ঘটনা ঘটবেই...। মানুষ চায় মাদকের একজনও বেঁচে না থাকুক... টকশো ওলারা কাঁদে, ওদের সঙ্গে জনগণের কোনো সম্পর্ক নাই...।”

কোনো সন্দেহ নেই, কেবল আদম সন্তান নয়; যে কোনো প্রাণীর মৃত্যুই অসীম বেদনার। মানুষের ক্ষেত্রে এ বেদনা ব্যক্তি থেকে সমাজে ছড়িয়ে পড়ে। আর এ বেদনা পরিমাপের বাইরে চলে যায় স্বজন হারানো পরিবারগুলোর জন্য। এই হিসাবে দেশ রক্ষার জন্য চলমান মাদকবিরোধী অভিযানে প্রতিটি মৃত্যুই বেদনার এবং অনাকাঙ্ক্ষিত। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, বিরাজমান অবস্থায় বিকল্পটা কী?

ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানির আমল থেকে ব্রিটিশ রাজের ছলচাতুরীতে এ অঞ্চলে মাদকের যে আগ্রাসন শুরু হয়েছিল তা কালের পরিক্রমায় চলে গেছে অপকর্মের হোতা মাফিয়া চক্রের নিয়ন্ত্রণে। বাংলাদেশের মাদক ব্যবসাও নিয়ন্ত্রণ করে বিশ্ব মাফিয়ারা। তবে পার্থক্য হচ্ছে, আর দশটা দেশের চেয়ে মাদক ব্যবসার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ খুবই উদার জমিন। এর পেছনে নানান কারণ রয়েছে। বন্ধুরাষ্ট্র ভারত থেকে আসা ফেনসিডিলে বাংলাদেশের যুবসমাজের সর্বনাশ হওয়ার পর দেশ সয়লাব হলো মিয়ানমার থেকে আসা ইয়াবায়। বানের জলের মতো ইয়াবা ট্যাবলেট ছড়িয়ে পড়েছে সারা দেশে। কেবল ঘরে ঘরে নয়, হাতে হাতে মাদক পৌঁছে দেওয়ার জন্য নানান কৌশল অবলম্বন করা হচ্ছে। ইয়াবা পাচারের কৌশলে পায়ুপথ থেকে যোনিপথ—কোনো কিছুই বাদ যায়নি। মানব দেহই হয়ে দাঁড়িয়েছে মাদক বহনের অন্যতম অবলম্বন। এটি চরম একপর্যায়ে পৌঁছেছে। এমনই একটি ঘটনা উন্মোচিত হয়েছে ৩০ মে বরিশালে। বরিশাল শেরেবাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নূরে আলম নামে এক ব্যক্তির পেট কেটে এক হাজার পিস ইয়াবা ট্যাবলেট উদ্ধার করা হয়েছে। মাদক পাচারে মাদক ব্যবসায়ী যে কতটা বেপরোয়া এবং কৌশলী এটি তার ছোট উদাহরণ মাত্র।

এই ভয়াবহ বিষয়টি বিবেচনায় না নিয়ে মাদকবিরোধী চলমান অভিযানের বিরুদ্ধে যারা ইনিয়ে-বিনিয়ে নানান জ্ঞানের কথা বলেন, তাদের মধ্যে অনেকেই আসলে মাদকের পক্ষের লোক; তারা কোনো না কোনোভাবে বেনিফিশিয়ারি। কেউ নিজেকে জ্ঞানী হিসেবে জাহির করার সুযোগ নেন, কেউ আবার লাভবান হন সরাসরি। এদের মধ্যে অনেকে ছিলেন মাদক ব্যবসায়ীদের নিয়মিত পেরোলে। কেউ আবার সংযুক্ত হয়েছেন নতুন করে ইস্যুভিত্তিক পেমেন্টের আওতায়। এমনটি ধারণা করার যথেষ্ট কারণ আছে। বিবেচনায় রাখা দরকার, মাদক হচ্ছে বহু বিলিয়ন ডলার লাভের ব্যবসা। এই ব্যবসার ভাগ যে কত কেন্দ্রে যায় তা জানা কঠিন, তবে অনুমান করা সহজ। এই সহজ কাজটি বিবেচনায় না নিয়ে কেবল অভিযানের বিরোধিতা করা হচ্ছে বিভিন্ন কেন্দ্র থেকে। এ বিরোধিতা রাজনীতি, সুশীল সমাজ, মানবাধিকার সংস্থা, কূটনীতিক থেকে শুরু করে জাতিসংঘ পর্যন্ত পৌঁছেছে। কিন্তু একটি বিষয় বিবেচনায় নেওয়া প্রয়োজন। তা হচ্ছে, যারা আজ মাদকবিরোধী চলমান অভিযানের বিপক্ষে শক্ত অবস্থান নিয়েছেন তারা কি মাদকের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে শক্তভাবে কখনো কিছু বলেছিলেন? বলেননি। মাদকের বিরুদ্ধে মহাজ্ঞানীদের যৌথ বিবৃতি প্রদান এবং উদ্বেগ প্রকাশ করা তো অনেক পরের বিষয়।

আর একটি বিষয় বিবেচনায় নেওয়া প্রয়োজন। তা হচ্ছে প্রকাশ্য বিরোধিতার বাইরেও মাদকবিরোধী চক্রের অন্যরকম নানা খেলা রয়েছে। অবস্থাদৃষ্টে এমনটি মনে করার যথেষ্ট কারণ আছে। এ খেলার আওতায় ওয়ার্ড কাউন্সিলর একরামের নাটকীয় মৃত্যু, ইয়াবাসহ ষাটোর্ধ্ব এক আইনজীবী গ্রেফতার এবং বদির ওমরাহ গমনের বিষয়টি রয়েছে কিনা, তাও গভীরভাবে ভেবে দেখা প্রয়োজন।

ওয়ার্ড কাউন্সিলর একরাম মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ছিলেন কি ছিলেন না, সেটি নিশ্চয়ই অধিকতর তদন্তের বিষয়। আর মাদক ব্যবসায়ী হলেই যে ঠাণ্ডা মাথায় গুলি করে মারতে হবে—তা নিয়েও সঙ্গত নানান প্রশ্ন আছে। আর এতসব প্রশ্নকে ছাপিয়ে একটি প্রশ্ন মিলিয়ন ডলার প্রশ্ন হিসেবে দেখা দিয়েছে। তা হচ্ছে, মাদকবিরোধী অভিযানে কাউন্সিলর ও যুবলীগ নেতা একরামের মৃত্যুর ঘটনা হিন্দি সিনেমার রূপ পেল কীভাবে! একটি লোককে ধরে নিয়ে যাওয়া, গাড়িতে তোলা থেকে শুরু করে গুলির শব্দ এবং মৃত্যু যন্ত্রণার গোঙানির অডিও রেকর্ড হচ্ছে পরিবারের মুঠোফোনে। এ রেকর্ড হওয়ার রহস্য কী? এ বিষয়টি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের অসাবধানতা হিসেবে বিবেচনা করার ভিত্তি ততটা জোরালো নয়। বরং অনেকেই মনে করেন, এটি করা হয়েছে মাদকবিরোধী অভিযানকে ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইলের আওতায় এনে ব্যর্থ করার নীলনকশা অনুসারে। এর পেছনে মাদক চক্রের বড়খেলা থাকার আশঙ্কাই বেশি। এ ক্ষেত্রে উদ্বেগজনক পরিস্থিতি কিন্তু সৃষ্টিও হয়েছে। যে অডিও প্রকাশ পেয়েছে তাতে হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হয়নি এমন লোক খুঁজে পাওয়া কঠিন, অসম্ভব বললেও বেশি বলা হবে না।

একরামের পরই চলমান অভিযান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বয়োবৃদ্ধ অ্যাডভোকেট সমর চৌধুরীর কারণে। তার হাতে বন্দুক ধরিয়ে দিয়ে বলা হলো, সে ইয়াবা ব্যবসায়ী। এতেও চলমান অভিযান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে ভাগ্য ভালো, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের এই সিনিয়র নাগরিককে ফাঁসানোর জন্য অভিযুক্ত নাটেরগুরুও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের এবং সংশ্লিষ্ট থানার ওসিও সংখ্যালঘু দাবিদার শ্রেণিভুক্ত। তা না হলে হয়তো এ গ্রেফতারের বিষয়টি ইস্যু করে হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ মাঠে নেমে লঙ্কাকাণ্ড ঘটিয়ে ফেলত। যেমনটি তারা করেছিল রংপুরে স্ত্রীর পরকীয়া প্রেমের তাড়নায় এক সংখ্যালঘু নাগরিক খুন হওয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে। তবে ভাগ্য ভালো, অল্প সময়ের মধ্যে আসল রহস্য উন্মোচন করতে পেরেছে র‌্যাব। এটি ভালো খবর।

কিন্তু খারাপ খবর হচ্ছে, ওমরার নামে সংসদ সদস্য বদির দেশত্যাগ। তার নামের সঙ্গে নানান বিশেষণ এতটাই জড়িয়ে গেছে যাতে তার আসল নামে আর তাকে চটকরে চেনার উপায় নেই। হতে পারে, তার বিরুদ্ধে এসব অপপ্রচার। কিন্তু তার বিরুদ্ধে দেশব্যাপী এক ধরনের পাবলিক পারসেপশন দাঁড়িয়ে গেছে। আর পাবলিক পারসেপশনই কেবল নয়, তাকে এই সেদিন আইনের আওতায়ও আনা হয়েছিল মাদক মামলায়ই। এ মামলায় তিনি উচ্চ আদালতের জামিনে আছেন। আদালত তাকে জামিন দিয়েছে, অভিযোগ থেকে দায়মুক্তি দেয়নি। কিন্তু এই ব্যক্তিটির দায় থেকে চলমান মাদকবিরোধী অভিযান মোটেই মুক্তি পাচ্ছে না। মাদক ব্যবসার রাঘব বোয়ালরা ধরা-ছোঁয়ার বাইরে থাকার প্রসঙ্গ এলেই মাননীয় সংসদ সদস্য বদির নাম প্রথমেই আসে। এত কিছুর পরও তিনি বাধাহীনভাবে ওমরাহর নামে বিদেশ যেতে পেরেছেন। প্রায় এমনটিই ঘটেছিল খালেদা সরকারের আমলে শাহনাজ রহমতউল্লাহর কিশোরী কন্যা নওরিনকে নিয়ে মাফিয়া ডন আজিজ মোহাম্মদ ভাইর দেশত্যাগের বেলায়। গুরুতর অভিযোগের পরও দেশত্যাগের ক্ষেত্রে এ দুটি ঘটনার মধ্যে বেশ মিল আছে। কিন্তু অমিল হচ্ছে, দেশত্যাগের পর পরিস্থিতি থিতিয়ে যাওয়া পর্যন্ত আজিজ মোহাম্মদ ভাই নীরবে ছিলেন। কিন্তু জনাব বদি পুরো উল্টো। তিনি নানান ভঙ্গিতে সেলফি ফেসবুকে দিয়ে প্রকারান্তরে দম্ভ প্রকাশ করছেন। যার বিরূপ প্রভাব পড়েছে মাদকবিরোধী অভিযানের ওপর।

দেশবাসী চায় না, দেশ রক্ষার জন্য চলমান মাদকবিরোধী অভিযানে বড় রকমের কোনো ইমেজ সংকটে পড়ুক। সাবধান থাকতে হবে, যাতে চলমান অভিযান প্রশ্নবিদ্ধ না হয়। কারণ, অতিমাত্রায় প্রশ্নবিদ্ধ কাজ এবং ত্রুটিপূর্ণ ধনুক—দুটোই লক্ষ্য অর্জনে মোটেই সহায়ক হাতিয়ার নয়।

লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক।

সর্বশেষ খবর