শুক্রবার, ৮ জুন, ২০১৮ ০০:০০ টা

জাকাত ও ঈদসামগ্রী বিতরণে আর ট্র্যাজেডি দেখতে চাই না

মাওলানা সেলিম হোসাইন আজাদী

জাকাত ও ঈদসামগ্রী বিতরণে আর ট্র্যাজেডি দেখতে চাই না

শাওয়ালের চাঁদ ওঠার সঙ্গে সঙ্গে শুরু হবে পবিত্র ঈদ। মুসলিম জাহান মেতে উঠবে সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসবে। দুনিয়ার তৃতীয় বৃহত্তম মুসলিম দেশ বাংলাদেশেও এ দিনটি উদ্যাপিত হবে ধর্মীয় ও রাষ্ট্রীয় মর্যাদায়। ঈদ হলো সিয়াম সাধনার সফল সমাপ্তির পর আল্লাহর তরফ থেকে বান্দাকে দেওয়া এক উপহার। ঈদ মানে আনন্দ। এ আনন্দ-উৎসবের সূচনা ১৪০০ বছর আগে। ইসলামের সূতিকাগার আরব উপদ্বীপে। ইসলামের অভ্যুদয়ের আগে আরবের মানুষ ওকাজের মেলাকে কেন্দ্র করে আনন্দ-উৎসবে মেতে উঠত। এ মেলা ছিল আরববাসীর হৃদয়ের মেলা। নানা ধরনের খেলাধুলা, নাচ-গান, হাসি-ঠাট্টা, কবিতা পাঠ ও নানা ধরনের শারীরিক কসরতের প্রদর্শনী হতো সে মেলায়। চলত মদ্যপান এবং আরও অনেক ধরনের বেলেল্লাপনা। মহানবী হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুসলমানদের মধ্যে ধর্মীয় ভাবাবেগসংবলিত এক পূতপবিত্র আনন্দ-উৎসব প্রবর্তনের তাগিদ অনুভব করলেন। তিনি সাহাবিদের সঙ্গে এ বিষয়ে আলোচনা করলেন। কথা বললেন মদিনার মুসলমানদের সঙ্গে। তার পরই আল্লাহর নির্দেশনা অনুযায়ী দুটি ঈদ পালন শুরু হলো। শাব্দিক দিক থেকে ঈদের উৎপত্তি আরবি আওদুন থেকে। যার অর্থ বার বার ফিরে আসা আনন্দ। আর ফিতর শব্দটির উৎপত্তি আরবি শব্দ ফুতুর থেকে। যার অর্থ সকালবেলার নাশতা বা মহামূল্যবান পুরস্কার। ধর্মীয় বিশ্বাসমতে, ঈদ হলো সিয়াম সাধকদের জন্য মহান আল্লাহর পুরস্কার। যারা এক মাস সিয়াম সাধনার মাধ্যমে তাকওয়ার গুণে নিজেদের গুণান্বিত করেছেন তারাই এ পুরস্কারের জন্য মনোনীত। ঈদ মুসলমানদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব। বাংলাদেশের মানুষের প্রধান উৎসবও এটি।

তিন যুগ ধরে ঘটা করে জাকাতের শাড়ি-লুঙ্গি বিতরণ সমাজের একশ্রেণির ধনাঢ্য ব্যক্তির ফ্যাশন হয়ে দাঁড়িয়েছে। জাকাত প্রদানের নামে নিজেদের আত্মগরিমা প্রচারের জন্য তারা মাইকে ঘোষণা দিয়ে অভাবী মানুষকে জাকাত নেওয়ার জন্য প্রলুব্ধ করেন। গত তিন যুগে জাকাতের শাড়ি ও লুঙ্গি নিতে গিয়ে প্রাণহানি ও আহত হয়েছে শত শত মানুষ। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, জাকাত-ফিতরা সংগ্রহ করতে গিয়ে বার বারই লাশ হচ্ছে হতদরিদ্র জনগোষ্ঠী। ঈদুল ফিতর সামনে রেখে প্রতি বছর রমজান মাসে ধনাঢ্য ব্যক্তিরা জাকাত-ফিতরা প্রদান করেন। কোনো কোনো ব্যক্তি নিজের প্রচার-প্রচারণার জন্য মাইকিং করেন, পোস্টার টাঙিয়েও জাকাতের শাড়ি-লুঙ্গি বিতরণের আয়োজন করেন। ফলে অভাবী মানুষজনের স্রোত শুরু হয়। অসম্ভব ভিড়ে পদদলিত হয়ে প্রাণ হারান অনেকে। প্রতি বছর জাকাত-ফিতরা আনতে গিয়ে অনেকে মারা গেলেও ঢাকা, চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহসহ কয়েকটি স্থানে বিপুলসংখ্যক জাকাতপ্রার্থীর করুণ মৃত্যুর ঘটনা দেশবাসীর মনে গভীর ক্ষতের সৃষ্টি করেছে। ১৯৮০ সালের রমজান মাসে জাকাতের কাপড় সংগ্রহ করতে গিয়ে ঢাকার জুরাইনে পদদলিত হয়ে ও ভিড়ের চাপে শিশুসহ ১৩ জন নিহত হন। ১৯৮৩ সালের ৯ জুলাই বেলা ১১টার দিকে জাকাতের টাকা ও কাপড় গ্রহণ করতে গিয়ে তিন শিশু গুরুতর আহত হয়। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ঈদ উপলক্ষে এ টাকা ও কাপড় বিতরণের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। ভিড়ের মধ্যে প্রচণ্ড চাপে এ দুর্ঘটনা ঘটে। শিশু তিনটির নাম নূর জামান (৬), ঝন্টু (৪) ও আবুল কালাম (৪)। ১৯৮৭ সালের ২৩ মে আরও একটি মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে। তৎকালীন প্রেসিডেন্ট হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ঢাকার ক্যান্টনমেন্টের শিখা অনির্বাণের বিপরীতে একটি খোলা চত্বরে জাকাতের কাপড় বিলি করার সময় বিপুলসংখ্যক লোকের সমাগম হয়। একপর্যায়ে উপস্থিত জনতা উচ্ছৃঙ্খল হয়ে পড়লে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষ হয়। ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ায় চার ব্যক্তি নিহত ও আহত হন শতাধিক। ১৯৮৯ সালের ৫ মে শুক্রবার সকালে চাঁদপুর শহরে জাকাতের কাপড় সংগ্রহ করতে গিয়ে প্রচণ্ড ভিড়ের মধ্যে জাকাত সংগ্রহকারীদের পায়ের তলায় পিষ্ট হয়ে ঘটনাস্থলেই ১৪ জন নিহত হন। এ ঘটনায় আহত হন ৫০ জন। ১৯৯০ সালের ২৬ এপ্রিল চট্টগ্রামের ঢাকা ট্রাংক রোডের পাশে পাহাড়তলীতে আবুল বিড়ি ফ্যাক্টরিতে সবচেয়ে ভয়াবহ মর্মান্তিক দুর্ঘটনা ঘটে। জাকাতের কাপড় ও টাকা আনতে গিয়ে সেখানে প্রচণ্ড ভিড় জমে। ভিড়ের চাপে পিষ্ট হয়ে শিশু, মহিলাসহ ৩৫ জন নিহত ও প্রায় ২০০ জন আহত হন। নিহতদের মধ্যে ১৮ জন মহিলা, ১৫ জন শিশু ও দুজন বৃদ্ধ ছিলেন। আহতদের মধ্যে ৭৬ জনকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসার পর ছেড়ে দেওয়া হয়। ১৯৯১ সালের ১৩ এপ্রিল সকালে নওয়াবপুর রোডে জাকাতের কাপড় সংগ্রহ করতে গিয়ে ভিড়ের সৃষ্টি হয়। ভিড়ের চাপে ঘটনাস্থলেই এক পুরুষ ও এক মহিলা নিহত হন। এতে আহত হন ২৫ জন। গত বছর জাকাতের কাপড় আনতে গিয়ে রাজধানীর ফকিরাপুলেও তিনজন লাশ হন। তাদের কপালে জোটেনি শাড়িকাপড়। রাজধানীর ফকিরাপুলে বড় মসজিদের পাশে আবদুল মালেক নামে এক ব্যক্তির বাড়িতে জাকাতের কাপড় আনতে গিয়ে পায়ের তলায় পিষ্ট হয়ে মারা যান ওই তিন নারী। বরিশালেও তিনজনের মৃত্যু ঘটে। মানিকগঞ্জে মারা যান দুজন। এসব ঘটনায় পদপিষ্ট হয়ে সহস্রাধিক নারী, পুরুষ, শিশু গুরুতর আহত হন। জাকাত-ফিতরা যেন মৃত্যুফাঁদ হয়ে দাঁড়িয়েছে। জাকাতের কাপড়-লুঙ্গি দেওয়ার কথা জানাজানি হলেই হাজারো অভাবী মানুষের ভিড় জমে ওঠে। শুরু হয় ঠেলাঠেলি, ধাক্কাধাক্কি। পদদলিত হয়ে নারী, শিশু, পুরুষের করুণ মৃত্যু ঘটে। ১০ জুলাই, ২০১৫ ময়মনসিংহে জাকাতের কাপড় সংগ্রহ করতে গিয়ে ২৭ জনের বেশি মানুষের জীবনহানি ঘটে। অর্থনৈতিকভাবে সবচেয়ে অসচ্ছল ব্যক্তিদের অর্থনৈতিক দুরবস্থা থেকে মুক্তির জন্য সমাজের সচ্ছল বা ধনী ব্যক্তিদের ওপর জাকাত ফরজ করা হয়েছে। আল্লাহর এ বিধান যারা লঙ্ঘন করে আসছেন তাদের কথা ভিন্ন। কিন্তু এ আইনকে যারা মেনে চলেছেন তাদের একাংশই জাকাত আদায়ের এ ফরজ ইবাদতকে গরিবের প্রতি অনুগ্রহ বলে মনে করেন। জাকাত প্রদানের নামে মাইকিং ও পোস্টারিং করে লোক দেখানোর উদ্দেশ্যে সর্বনিকৃষ্ট মানের কাপড় বিতরণ করা কতটুকু সমর্থনযোগ্য তা নিয়ে জনমনে নানা প্রশ্নের উদ্রেক ঘটেছে।

দেশের ইতিহাসে জাকাতের জন্য বিয়োগান্ত ঘটনার এটিই সবচেয়ে বড় ঘটনা। ময়মনসিংহ পৌরসভার সামনেই একটি জর্দা ফ্যাক্টরি থেকে ১০ জুলাই, ২০১৫ শুক্রবার সকালে জাকাতের শাড়ি ও লুঙ্গি বিতরণ করার কথা হচ্ছিল। জাকাত নিতে রাতেই জড়ো হয় শত শত গরিব মানুষ। ভোর ৫টার দিকে তারা কাপড়ের জন্য ভিতরে ঢোকার চেষ্টা করলে ফ্যাক্টরির দারোয়ান ও কর্মচারীরা তাদের বাধা দেয়। এক পর্যায়ে লাঠিপেটা শুরু করে তারা। এ সময় হুড়াহুড়ি শুরু হলে পায়ের তলায় পিষ্ট হয়ে ঘটনাস্থলেই এবং তার পরে মারা যায় প্রায় ২৭ জন।

১৪ মে, ২০১৭ চট্টগ্রামের সাতকানিয়ায় একটি ইস্পাত কারখানার পক্ষ থেকে ইফতারসামগ্রী বিতরণের সময় হুড়াহুড়ি শুরু হলে পায়ের চাপে পিষ্ট হয়ে নয় নারী ও শিশু নিহত হন।

জাকাত ইসলামের একটি অবশ্যপালনীয় ইবাদত। তবে এ ইবাদতের বাধ্যবাধকতা শুধু তাদের জন্য যারা অবস্থাপন্ন। ইসলামের বিশ্বাস অনুযায়ী সব সম্পদের মালিক মহান স্রষ্টা আল্লাহ। তিনিই মানুষকে সম্পদ দেন। যারা অবস্থাপন্ন তাদের সম্পদে গরিব মানুষেরও হক থাকে আল্লাহর বিধানে। এ হকই হলো জাকাত। জাকাত কোনোভাবেই গরিবের প্রতি ধনীদের দয়াদাক্ষিণ্য বা অনুগ্রহ নয়। এটি ধনীদের সম্পদে গরিবদের আল্লাহ-প্রদত্ত হিস্সা। যাদের ওপর জাকাত ফরজ তাদের কর্তব্য থাকে গরিবের সে হক তাদের কাছে সসম্মানে পৌঁছে দেওয়া। ধর্মীয় দৃষ্টিতে জাকাত দেওয়ার নামে নিজেকে দাতা হিসেবে তুলে ধরা কিংবা আত্মগরিমার প্রচার কোনোভাবেই বাঞ্ছনীয় নয়। কিন্তু প্রায় প্রতি বছরই জাকাত দেওয়ার নামে মানুষের জীবন কেড়ে নেওয়ার ঘটনা ঘটছে। পুলিশের পক্ষ থেকে বড় আকারের জাকাত প্রদানে তাদের সহায়তা নেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হলেও তা মানা হয় না বললেই চলে। আমরা আশা করব এ ধরনের গণহত্যার  ঘটনাগুলোকে সরকার যথাযথভাবে আমলে নেবে এবং বিপুলসংখ্যক মানুষের প্রাণহানির জন্য যারা দায়ী তাদের বিচারের সম্মুখীন করা হবে। ভবিষ্যতে যাতে জাকাতের নামে আত্মপ্রচারের জন্য লোক জড়ো করে পায়ে পিষে মানুষ মারার ব্যবস্থা না করা হয় সে বিষয়টিও নিশ্চিত করা হবে।

লেখক : মুফাসসিরে কোরআন ও গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব।

www.selimazadi.com

সর্বশেষ খবর