শুক্রবার, ২২ জুন, ২০১৮ ০০:০০ টা

প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের ‘লিটল রকেটম্যান’ দর্শন

শামীম আল আমিন

প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের ‘লিটল রকেটম্যান’ দর্শন

শান্তির সপক্ষে নিঃসন্দেহে এটি অনেক বড় একটি উদ্যোগ। এমন উদ্যোগের কারণে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে নোবেল পুরস্কার দেওয়া উচিত, এমন দাবিও তোলা হয়েছে। কোরীয় উপদ্বীপে দীর্ঘ অশান্তি এবং অস্থিরতার অবসানে আলোচনা আর কূটনৈতিক প্রচেষ্টারও কোনো বিকল্প দেখছেন না বেশির ভাগ বিশ্লেষক। ফলে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প  সিঙ্গাপুরের সানতোসা দ্বীপে উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং উনের সঙ্গে যে ঐতিহাসিক বৈঠকটি করলেন, তার গুরুত্ব বলে শেষ করা যাবে না।  ১২ জুনের সেই বৈঠকটির দিকে চোখ ছিল গোটা বিশ্বের মানুষের। এটাই দায়িত্বে থাকা কোনো আমেরিকার প্রেসিডেন্টের উত্তর কোরিয়ার কোনো শীর্ষ নেতার সঙ্গে বৈঠক। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যে শেষ পর্যন্ত সেটা করতে পেরেছেন, তার জন্য ইতিহাস নিশ্চয়ই তাকে কৃতিত্ব দেবে, মনে রাখবে। আর সাম্প্রতিককালে কেবল একটি বৈঠককে ঘিরে পৃথিবীর মানুষের এতটা আগ্রহের কোনো উদাহরণও বোধ করি আর একটিও নেই।

ঐতিহাসিক সেই সম্মেলনের মধ্য দিয়ে, সংঘাতের অতীত পেছনে ফেলে নতুন দিনের ‘প্রতিশ্রুতি’ দিয়েছেন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং উত্তর কোরিয়ার ক্ষমতাসীন ওয়ার্কার্স পার্টির চেয়ারম্যান কিম জং উন। দুই নেতার সেই বৈঠকে উত্তর কোরিয়া পুরোপুরি পরমাণু নিরস্ত্রীকরণে রাজি হয়েছে। বিনিময়ে এক সময়ের শত্রু দেশের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে আমেরিকা। মোটামুটি এই হচ্ছে খবর। এ নিয়ে সমঝোতা স্মারকে সইও করেছেন দুই নেতা। তবে পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণের জন্য সুনির্দিষ্ট রূপরেখা না থাকা এবং দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে যৌথ সামরিক মহড়া বন্ধে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের ঘোষণা নিয়ে সংশয় জানিয়েছেন বিশ্লেষকরা।

কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, ‘স্বৈরশাসক’ ‘একনায়ক’ ‘মানবাধিকার লঙ্ঘনকারী’ এত অভিধায় যাকে বিশ্ব গণমাধ্যম দীর্ঘদিন ধরে বর্ণনা করে আসছে, এতটা মর্যাদা কি তার প্রাপ্য ছিল! দৃশ্যটি কল্পনা করুন। সানতোসার কাপেলা হোটেলের বারান্দায় যেন বিশাল এক নাটকের মঞ্চ। নাটকের গুরুত্বপূর্ণ দুই চরিত্র, তারা যেন সমানে সমান। সামনে অসংখ্য ক্যামেরার ঝলকানি। দুজন দুপাশ থেকে এলেনও নাটকীয় ভঙ্গিতে। এসে এমনভাবে হাত মেলালেন, যেন কেউ কারও চেয়ে কম নন। কোনো বৈঠকে বসে প্রতিপক্ষকে ছোট করার প্রয়োজন নেই, অনুচিতও। তবে যার যা প্রাপ্য নয়, তা দেওয়াও কি ঠিক! প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প পৃথিবীর সবচেয়ে বড় গণতান্ত্রিক দেশের নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট। আর আরেকজন পরিবারতন্ত্র থেকে আসা ‘একনায়ক’। অর্থনীতি আর বৈশ্বিক প্রভাবেও দেশ দুটো ধারেকাছে নয়। ফলে এ নিয়ে আমেরিকায় কঠোর সমালোচনার মুখে পড়েছেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। ট্রাম্পের সঙ্গে ঐতিহাসিক সম্মেলনে অংশ নিয়ে রীতিমতো আন্তর্জাতিক নেতা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করলেন উত্তর কোরিয়ার ‘স্বৈরশাসক’ কিম জং উন। সমালোচকদের মতে, এর মাধ্যমে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বিশ্বে সবচেয়ে বাজেভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘনকারী এক ব্যক্তিকে বৈধতা দিলেন। একই সঙ্গে কিম প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সঙ্গে সমপর্যায়ের একজন নেতা হিসেবে দুনিয়াব্যাপী সমাদৃত হলেন। কেবল তাই নয়, বৈঠকের আগে, বৈঠক চলাকালীন এবং পরে ৩৪ বছর বয়সী যুবক কিম জং উন সম্পর্কে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের অসম্ভব মুগ্ধতা, যেভাবে তিনি কিমকে ‘প্রতিভাবান’ বলেছেন কিংবা তার সঙ্গে বৈঠক করতে পেরে নিজের ভালোলাগা প্রকাশ করেছেন, অনেকের কাছে তা ছিল রীতিমতো ‘দৃষ্টিকটু’। আর এসব কিছুই সমালোচনা ও হাস্যরসের খোরাক জুগিয়েছে খোদ আমেরিকার প্রভাবশালী গণমাধ্যমগুলোর জন্য। এখানকার বেশির ভাগ টেলিভিশন চ্যানেলের কমেডি শো’র প্রধান উপজীব্য হয়ে দাঁড়িয়েছে ‘প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের লিটল রকেটম্যান দর্শন’। যাকে দেখে নাকি প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প মূল যে আলোচনার বিষয় ‘পরমাণু কর্মসূচি’, তা নিয়ে কথা বলতেই নাকি ভুলে গেছেন। ফলে সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের মতো অনেকে আবার বৈঠকটিকে কেবল ফটোসেশনের একটি উপলক্ষ ছাড়া আর কিছু বলতে রাজি নন। কেউ কেউ বলছেন, আমেরিকার মধ্যবর্তী নির্বাচনে নিজ দল রিপাবলিকান পার্টির প্রভাব ধরে রাখতে এবং নিজের রাজনৈতিক ভবিষ্যতের জন্য এই বৈঠককে কাজে লাগাতে চান প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প।

অথচ এই প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পই জাতিসংঘে দেওয়া বক্তব্যে কিমকে ‘রকেটম্যান’ সম্বোধন করে তিনি নিজের এবং তার দেশের জন্য ‘সুইসাইড মিশন’-এ আছেন বলে উল্লেখ করেছিলেন। তিনি তুলে ধরেছিলেন কিম জং উন কীভাবে নিজ দেশে একের পর এক মানবাধিকার লঙ্ঘন করে চলেছেন। একটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে কীভাবে নিজের ভাইকে নিষিদ্ধ নার্ভ এজেন্ট দিয়ে হত্যা করা হয়েছে, কীভাবে আমেরিকার তরুণ অটো ওয়ার্মবিয়ারকে নির্মম নির্যাতন চালিয়ে হত্যা করা হয়েছে কিংবা জাপানের কিশোরীকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে তার চিত্র তুলে ধরে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন। সেই সঙ্গে কিম জং উনকে কয়েকটি দেশের ইন্ধনে ভয়ঙ্কর পারমাণবিক অস্ত্রের খেলায় মেতে উঠেছেন, সেই কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে ট্রাম্প বলেছিলেন, উত্তর কোরিয়াকে পুরোপুরি ধ্বংস করে ফেলা ছাড়া আর কোনো বিকল্পই থাকবে না। পরে বিভিন্ন সময়ে কিম জং উনকে ‘লিটল রকেটম্যান’ সম্বোধন করে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথাও বলেছিলেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। উত্তরে কিমও কড়া জবাব দিতে ছাড়েননি। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, আগে কথার যুদ্ধ চলেছে বলে কি, শান্তি আলোচনা সম্ভব নয়? একে অপরের সঙ্গে সৌহার্দ্য প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়? অবশ্যই সম্ভব। কিন্তু যার যা মর্যাদা, তাকে তো সেটাই দেখাতে হবে, এমনটাই মত অনেকের। তাহলে বৈঠকটি থেকে লাভবান হয়েছে কারা? এমন একটি প্রশ্নও ঘুরপাক খাচ্ছে সর্বত্র। বৈঠক শেষে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প দেশে ফিরে বলেছেন, বিশ্বের জন্য উত্তর কোরিয়া এখন আর পরমাণু হুমকি নয়। এমনকি আমেরিকার জন্যও দেশটি আর ‘সবচেয়ে বড় এবং বিপজ্জনক কোনো সমস্যা’ নয়। এক টুইটে ট্রাম্প লিখেন, তিনি যখন দায়িত্ব নিয়েছিলেন, সেই তুলনায় এখন সবাই অনেক বেশি নিরাপদবোধ করতে পারেন।

খুবই ভালো কথা। বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠা যদি হয়; তাহলে এর চেয়ে বড় সুফল তো কিছু হতেই পারে না। যদিও উত্তর কোরিয়ার রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন বৈঠকটিকে ঘিরে নিজেদের জয় দেখাচ্ছে। কিমকে বর্ণনা করা হচ্ছে ‘দেবতুল্য’ হিসেবে। আর বৈঠকের সময় পরিচিতি পর্বে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ভদ্রতা করে উত্তর কোরিয়ার জেনারেলের স্যালুটের জবাবে, স্যালুট দেওয়ার যে ভঙ্গি করেছেন, সেটা নিয়েও নাটক সাজিয়েছে দেশটি। বারবারই সেই দৃশ্য দেখিয়ে নিজেদের প্রভাব বোঝানোর চেষ্টা করছে উত্তর কোরিয়ার রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম।

যদিও প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বৈঠকটি থেকে গোটা বিশ্বের লাভ দেখছেন। এবিসি নিউজের সঙ্গে এক বৈঠকে তিনি দাবি করেন, ধীরে ধীরে পরমাণু কর্মসূচি থেকে ‘সম্পূর্ণ’ সরে আসবে, উত্তর কোরিয়া। তবে তিনি এটাও বলেন, এক বছর পর সেই বিশ্বাস যে বদলে যাবে না, সেই নিশ্চয়তা দিতে পারছেন না তিনি। তাহলে একটা ‘কিন্তু’ তো রয়েই যাচ্ছে; নাকি!

এদিকে বৈঠকের সঙ্গে সরাসরি না থেকেও বড় খেলোয়াড় হচ্ছে চীন। বৈঠকে আসার আগে দুবার দেশটিতে গিয়ে প্রেসিডেন্ট শি জিন পিংয়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন কিম জং উন। এমনকি বৈঠক শেষেও দৌড়ে গেছেন চীনে। সম্ভবত বৈঠক-পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেওয়া এবং ফলাফল বিশ্লেষণের জন্য। বিশ্লেষকরা বলছেন, উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে বৈঠককে ঘিরে চীন ভীষণভাবে লাভবান হবে। কেননা একপর্যায়ে তারা হয়তো নর্থ কোরিয়ার সঙ্গে প্রকাশ্যে ব্যবসা করতে পারবে। এ ছাড়া সামরিক অনেক সুবিধাও দেখছে তারা। প্রভাবশালী রিপাবলিকান সিনেটর লিন্ডসে গ্রাহাম বলেছেন, নর্থ কোরিয়াকে ব্যবহার করে চীন নাকি প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সঙ্গে খেলছে। তিনি বলেছেন, কোরীয় উপত্যকা থেকে আমেরিকার সেনা ফিরিয়ে আনা হলে এশিয়া অঞ্চলে চীনের একক কর্তৃত্ব বিস্তারের দীর্ঘদিনের স্বপ্ন বাস্তবায়িত হবে। এদিকে দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে যৌথ সামরিক মহড়া বন্ধ করার সিদ্ধান্ত আমেরিকার জন্য ‘বিপর্যয়’ হতে পারে বলে সতর্ক করেছেন অবসরপ্রাপ্ত নৌবাহিনীর প্রধান এবং জয়েন্ট চিফস অব স্টাফের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান স্যান্ডি ইউনিফল্ড। সিবিএস নিউজকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি আরও বলেন, যৌথ সামরিক প্রশিক্ষণ বন্ধ না করে, কোরীয় উপদ্বীপে আমেরিকার সেনা সদস্যদের রাখাটা বুদ্ধিমানের কাজ হবে। উত্তর কোরিয়া পরমাণু অস্ত্রের জন্য আর হুমকি নয়; প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের এমন যুক্তিও মানতে নারাজ জয়েন্ট চিফ স্টাফের সাবেক এই ভাইস চেয়ারম্যান।

এদিকে ট্রাম্প-কিমের বৈঠকের পেছনে দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট মুন-জায়ে ইনের অবদান অনেক। এ কারণে, দেশটিতে তার জনপ্রিয়তা ও সমর্থন বেড়েছে বহুগুণ। তবে সম্প্রতি একটি জায়গায় তিনি ধাক্কা খেয়েছেন। কোরীয় উপদ্বীপে সামরিক মহড়া বন্ধে ট্রাম্পের ঘোষণার পরই মুনের সমালোচনা করেছে তার দেশের রক্ষণশীল দল এবং ডানপন্থিরা। এ নিয়ে শঙ্কিত জাপানও।

বৈঠকে উত্তর কোরিয়ার ওপর প্রদর্শিত ভবিষ্যৎ অগ্রগতির ওপর তৈরি করা একটি তথ্যচিত্র দেখানো হয়। প্রথমে এটি উত্তর কোরিয়ার পক্ষ থেকে করা হয়েছে বলে অনেকে ভুল করেছিলেন। আসলে সেটি নির্মাণ করে হোয়াইট হাউস। অর্থাৎ এটিই বোঝানো যে, যদি উত্তর কোরিয়া ধ্বংসাত্মক পথ থেকে সরে আসে, তাহলে দেশটির জন্য অপেক্ষা করছে সোনালি ভবিষ্যৎ। বিশ্লেষকরাও সেই সম্ভাবনাই দেখছেন। কিন্তু ‘ছেলের হাতের মোয়া’র মতো উত্তর কোরিয়াকে এতটা সহজে বোঝানো যাবে! রহস্যে ঘেরা দেশটিকে কি আদৌ নিয়ন্ত্রণ করা যাবে, নাকি অতীতের মতো তারা আবারও ফসকে যাবে। এবারের উদ্যোগ অনেক বড়। ফলে সফলতাই সবার কামনা। সেই অর্থে একটু বিনীত হয়ে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যদি উত্তর কোরিয়াকে শান্তি ও স্থিতিশীলতার পথে ফিরিয়ে আনতে পারেন, তাহলেই তো স্বার্থকতা।  সেক্ষেত্রে প্রতিশ্রুতি পূরণ করতে হবে আমেরিকাকে। চালাকি না করে, কথা রাখতে হবে নর্থ কোরিয়াকেও; ত্যাগ করতে হবে সব ধরনের মানবতাবিরোধী অপরাধ। তাহলেই হয়তো এক ধরনের শান্তির সুবাতাস বইবে পৃথিবীজুড়ে। কিন্তু ভুলে গেলে চলবে না;  বর্তমান সময়ে আন্তর্জাতিক রাজনীতির সমীকরণ অতটা সহজ নয়।

লেখক : হেড অব নিউজ, টিবিএন২৪ টেলিভিশন, নিউইয়র্ক।

[email protected]

সর্বশেষ খবর