মঙ্গলবার, ৩ জুলাই, ২০১৮ ০০:০০ টা

এ কেমন নির্বাচন?

বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম

এ কেমন নির্বাচন?

কোটাবিরোধীদের ওপর সরকারি দলের ছাত্রদের এ ধরনের নির্মম আচরণ খুবই অমানবিক। এটা মনে রাখতে হবে কাউকে মাটিতে ফেলে লাথি মারা কোনো সভ্যতা নয়। অনেক দিন ভাবছি নির্বাচন নিয়ে লিখি। মনে হয় এখনই লেখা উচিত। বয়স হয়েছে ন্যায়নীতির বাইরে, ইচ্ছার বিরুদ্ধে কিছু করতে মন সায় দেয় না। প্রভাবমুক্ত ভালো নির্বাচন দেশে খুবই প্রয়োজন। মানুষ যদি মনের মতো নির্বাচন করতে পারে, দেশ চালাতে পারে তাহলে অর্ধেক সমস্যা আপনাআপনি দূর হয়ে যাবে। যে উন্নতি-অগ্রগতি হচ্ছে অতিরিক্ত পরিশ্রম ছাড়াই তা দ্বিগুণ হবে। সরকার ভাবছে তারা খুবই জনপ্রিয়। কিন্তু নিজেদের কর্মকাণ্ডেই তারা সাধারণ মানুষ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে। চিন্তা-চেতনা, ন্যায়নীতিতে সাবলীল মানুষ এখন আর প্রাণ খুলে সরকারকে সমর্থন করে না বা করতে পারে না। মে-জুন ছিল নির্বাচনের মাস। অতিসম্প্রতি ৩০ জুন বাসাইল পৌর নির্বাচন হয়েছে। তার আগে ২৬ জুন গাজীপুরে তামাশার নির্বাচন ছিল। গাজীপুরের ভোটের আবার বস্তা খুলে গণনা করলে আওয়ামী লীগ প্রার্থী দেড়-দুই লাখ ভোটে হারবে। সে নির্বাচনের শুরু থেকেই সরকারি প্রভাব বিস্তার শুরু হয়েছিল। এখন যেহেতু সব নির্বাচনেই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী প্রার্থী মনোনয়ন দেন, সরকারি বাসভবন বা গণভবন থেকে প্রার্থী মনোনয়ন দেওয়া হয়, যা একেবারেই বেআইনি; তাই কখনো প্রভাবমুক্ত নির্বাচন হয় না।

গাজীপুরে ৪-৫টি কেন্দ্রে বেলা ১১টার মধ্যে সব ব্যালট পেপার শেষ! একি সম্ভব? যে কেন্দ্রে যত ভোট তার চেয়ে সামান্য ব্যালট সব সময় বেশি নেওয়া হয়। ৫-১০টা ভোট বেশি হলেও পুরো ১০০ ব্যালটের বই নেওয়া হয়। সে ক্ষেত্রে কেন্দ্রে ব্যালট কম হওয়ার কথা নয়। শতকরা ১০০ ভাগ ভোট পড়লেও ৫০-৬০-৭০ বা ৮০-৯০টা ব্যালট বেশি থাকার কথা। কিন্তু কেন্দ্রের বাইরে ভোটার দাঁড়িয়ে, ব্যালট পেপার নেই! এ এক অভাবনীয় ব্যাপার। গত সংসদ নির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বা বিনা ভোটে ১৫৩ আসনে জয়ী! যে সংসদের অর্ধেকের বেশি বিনা ভোটে সে সংসদের বৈধতা কোথায়? বিএনপিরও অনেকে এখন মনে করেন তাদের নির্বাচনে না যাওয়া ভুল হয়েছে। সরকার সেই কথাই বার বার বলছে। কিন্তু গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে ২০১৪ সালের ভোট বর্জনে বিরোধী সবার সাড়া দেওয়া বিএনপি নেত্রীর শ্রেষ্ঠ বিজয়। কিন্তু সেই বিজয় তিনি বা তার দল কাজে লাগাতে ব্যর্থ হয়েছে। তাই সরকার তাদের জয়কে পরাজয় হিসেবে চালিয়ে দিচ্ছে। কোনো অন্যায়ের যথাযথ প্রতিবাদ বা প্রতিরোধ করতে না পারায় সরকারের সাহস বেড়ে গেছে। গাজীপুরে এই যে ১১টায় ব্যালট ফুরিয়ে গেল এ তো সপ্তম আশ্চর্য তাজমহলের চেয়ে বড় আশ্চর্য। মধ্যযুগের দার্শনিক নাসির উদ্দিন হোজ্জার এক গল্প প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খানের অনুবাদে পড়েছিলাম। এক শিক্ষক স্কুলে যাওয়ার পথে তার বউকে দুই সের মাংস দিয়ে যান। শিক্ষকের বউ ছিলেন চমৎকার গৃহিণী। খুব সুন্দর করে রান্নাবান্না করে স্বামীর অপেক্ষায় ছিলেন। সে সময় তার বাপের বাড়ির আত্মীয়রা আসে। সাধারণত বিবাহিত জীবন যত আনন্দের এবং দীর্ঘ হোক বাপের বাড়ির আত্মীয় এলে বউয়ের পাওয়ার বাড়ে। শিক্ষকের বউয়েরও বেড়েছিল। স্বামীর আসতে দেরি দেখে বাপের বাড়ির আত্মীয়দের খাইয়ে দেন। পাওয়ার দেখিয়ে বাড়াবাড়ি করতে গিয়ে আস্তে আস্তে সব মাংস খাইয়ে ফেলেন। স্বামী এলে তাকে বেশ যত্ন করে খেতে দিয়ে হাতপাখার বাতাস করছিলেন। খেতে খেতে পেট ভরে আসায় লজ্জাশরমের মাথা খেয়ে মাস্টার বউকে বললেন, আর তো পারি না। দু-এক টুকরো মাংস দেবে না? বউ একেবারে জ্বলে ওঠেন, ‘কী বল, মাংস থাকলে দিতাম না!’ থাকলে দিতা না? তাহলে মাংসের কী হলো? বাইরে তোমার বাপের বাড়ির আত্মীয় দেখলাম তারা খেয়েছে? বউ আরও অগ্নিমূর্তি ধরেন, ‘কী বল! আগাগোড়াই দেখছি তুমি আমার বাপের বাড়ির লোকজন দেখতে পার না। তারা খেতে যাবে কেন? তারা কি মাংস খায় না?’ তাহলে কে খেল? ‘কেন, এই যে তোমার আদরের বিড়াল কাঁটা চিবাচ্চে, ও-ই খেয়েছে।’ ‘কী বল? দুই সের মাংস এই বিড়ালে খেল! বউয়ের জবাব, ‘তবে কি আমি খেয়েছি?’ হাতের ভাত ঝাড়া দিয়ে শিক্ষক বিড়াল নিয়ে বাইরে যান। দোকানিকে বলেন দাঁড়িপাল্লা দাও, আর দুই সের পাথর দাও। এক পাল্লায় বিড়াল আর অন্য পাল্লায় পাথর দিয়ে উঁচু করে দেখেন সমান সমান। দৌড়ে আসেন বাড়ির ভিতর। ‘বউগো! ২৪ বছর অঙ্কের মাস্টারি করি। দুই সের মাংস খেয়ে বিড়াল দুই সের থাকে এমন তো কখনো দেখিনি। এটা যদি বিড়াল হয় তাহলে আমার মাংস কই? আর এটা মাংস হলে আমার বিড়াল কই?’ গাজীপুরের সিটি নির্বাচনে ১১টায় ব্যালট ফুরিয়ে গেল, তার পরও কেন্দ্রের বাইরে ভোটারের লাইন থাকলে নাসির উদ্দিন হোজ্জার বিড়ালের গল্প থেকে আলাদা কিছু বলা বা ভাবা যায় না। বিএনপি নেতারা বলেছেন, ১০০-এর ওপর কেন্দ্র থেকে পোলিং এজেন্ট বের করে দিয়েছে। তারা তো আরও দেড় শ কেন্দ্রে পোলিং এজেন্টই দেনইনি। ৪২৫ কেন্দ্রের ২২০-৫০টিতে তাদের পোলিং এজেন্ট ছিল। পোলিং এজেন্ট থাকলেই কী আর না থাকলেই কী? যথাযথ প্রতিরোধ না হলে কোনো এজেন্টে কাজ হবে না, গাজীপুরের নির্বাচন তারই জ্বলন্ত প্রমাণ। কেন ব্যালট শেষ হলো এজন্য কি প্রিসাইডিং বা সহকারী প্রিসাইডিং অফিসারের শাস্তি হয়েছে? হয়নি। নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিতরা প্রিসাইডিং অফিসারের কথা না শুনলে তাদের কি শাস্তি হয়েছে? না। তাহলে এভাবেই চলবে?

৩০ জুন বাসাইলে দেখার মতো এক পৌর নির্বাচন হলো। সরকার বা সরকারি দল এমন নির্লজ্জ কর্মকাণ্ড করতে পারে ভাবা যায় না। নির্বাচনে প্রার্থী ছিলেন তিনজন। আওয়ামী লীগের আবদুর রহিম আহমেদ, বিএনপির এনামুল করিম অটল ও কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের রাহাত হাসান টিপু। আওয়ামী লীগ প্রার্থী স্বাধীনতার পর গণবাহিনী করতেন। টাঙ্গাইলে গণবাহিনীর হাতে যত মুক্তিযোদ্ধা এবং আওয়ামী লীগার নিহত হয়েছেন মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি হানাদারদের হাতে তত নিহত হননি। পাকিস্তানি হানাদাররা গ্রাম-হাট-বাজার জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে সাধারণ মানুষকে হত্যা করেছে। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে এঁটে উঠতে পারেনি। অথচ গণবাহিনী অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধা হত্যা করেছে। কাউলজানির কলিবুর রহমান বাঙালি, ফুলকীর মোস্তফা বীরপ্রতীক, দেউপাড়ার রিয়াজ কমান্ডার, ত্রিরঞ্জ মাদ্রাসায় দিনে দুপুরে ১৬ জন সাধারণ মানুষকে হত্যা এসবই ছিল গণবাহিনীর কাজ। এরপর জনাব রহিম মরিশাসে যান। সেখানে আছেন এখন পর্যন্ত। মাঝে দেশে ফিরে চাকা মার্কা নিয়ে নির্বাচন করেন। গতবার উপজেলা নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী হওয়ার চেষ্টা করে মনোনয়ন না পেয়ে ঘোড়া মার্কা নিয়ে স্বতন্ত্র নির্বাচন করে হারেন। বছরখানেক আগেও জননেত্রী শেখ হাসিনা ছিলেন তার চোখের বালি। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে, জননেত্রীকে নিয়ে বাংলা অভিধানে কুরুচিকর এমন কোনো শব্দ নেই যা তিনি প্রয়োগ করেননি। সেই আবদুর রহিম কী করে আওয়ামী লীগের নৌকা মার্কা পেলেন সেসব এখনো আমাদের অজানা। বিএনপি প্রার্থী এনামুল করিম অটল দলটির একজন নিবেদিত কর্মী। আমাদের রাহাত হাসান টিপু ছাত্র থেকে আমাদের দলের একজন নিবেদিত কর্মী। গতবারও প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিল। বিজয়ী প্রার্থীর চেয়ে ৭৩ ভোট কম পেয়ে পরাজিত হয়েছিল। আওয়ামী লীগ প্রার্থী হয়েছিল ৪ নম্বর। গতবারের ভোটে কোনো খোঁজখবর করিনি। কারণ টিপু যে প্রার্থী হতে পারে, অত ভোট পেতে পারে আমাদের মনে হয়নি। সেজন্য এবার অংশ নিয়েছিলাম। নির্বাচন করতে গিয়ে মনে হয়েছিল সবাই মিলে নৌকার বিরুদ্ধে নির্বাচন করলে নির্বাচনে কারচুপির সম্ভাবনা যেমন কমে যাবে তেমন নৌকা পরাজিত হবে। সেজন্য বিএনপির নেতৃবৃন্দকে প্রার্থী না দেওয়ার অনুরোধ করেছিলাম। তারা আমার অনুরোধ রেখেছিলেন। তবে নির্বাচন হওয়ার কথা ছিল মে মাসে। ঠিক গাজীপুরের মতো মামলা-মোকদ্দমা করে নির্বাচন ঠেকিয়ে রাখা হয়েছিল। তাই বিএনপির প্রার্থী অটল ধানের শীষ নিয়ে নির্বাচন করছিলেন। বিএনপি যখন কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের গামছায় সমর্থন দেয় সরকারি দলের লোকেরা তখন ধানের শীষকে সব রকম সহযোগিতা করে কোলে তোলে। আগে বিএনপি প্রার্থী ঘর থেকে বেরোতেন না। বিএনপি প্রার্থী প্রত্যাহার করলে ধানের শীষ গিয়ে নৌকায় ওঠে। শত্রুর সঙ্গে এত মিত্রতা আমি আর কখনো দেখিনি। তবে এটা সত্য, সখীপুর-বাসাইলে বিএনপির মূল বিরোধী আওয়ামী লীগ নয়, মূল বিরোধী কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের গামছা। সেটাই ফুটে উঠেছে বাসাইলের নির্বাচনে। ১৬৪০০ ভোটের কাস্টিং ১২৮৯০ ভোটের নৌকা ৪৭৬০, ধানের শীষ ৩৯৪৫, গামছা ৩৭৯৬। এতেই বোঝা যায় সবাই মিলে নির্বাচন করলে কোথাও নৌকার বিজয়ী হওয়ার সম্ভাবনা নেই। নির্বাচনী প্রচারণা মোটামুটি মনোরম ছিল। প্রথম দিকে পুলিশের কিছু বাড়াবাড়ি ছিল। কিন্তু শেষে চোখে পড়ার মতো তেমন কিছু করেনি। গোলমাল-চুরি-চামাড়ি যা হওয়ার হয়েছে নির্বাচনের দিন। সব কেন্দ্রে নৌকার পক্ষে ধীরলয়ে জাল ভোট পড়েছে। মরা, বিদেশে অবস্থান, অসুস্থ ও অনুপস্থিত এসব ভোট নিয়ে কিছু জালিয়াতি করেছে নৌকা।

মাগুরা ছিল দেশে সব থেকে আলোড়ন সৃষ্টিকারী কারচুপির নির্বাচন। সে নির্বাচনে নৌকার পক্ষে প্রায় ১৫ দিন প্রচারণা করেছিলাম। নির্বাচনের দিন ২১টি কেন্দ্রে গিয়েছিলাম। কেন্দ্রে কেন্দ্রে বেশ ভিড় ছিল, ভোটার ছিল। ১১টি কেন্দ্রে পরিদর্শনের কথা লিখে এসেছিলাম, ‘আমি যখন কেন্দ্রে এসেছি তখন কেন্দ্রের পরিবেশ মনোরম। প্রকৃত ভোটাররা ভোট দিচ্ছে।’ ২১টি কেন্দ্রের ১৬টায় নৌকা বিজয়ী হয়েছিল। বিশেষ করে যে ১১ কেন্দ্রের পরিদর্শন বইয়ে লিখে এসেছিলাম তার ৯টিতে নৌকা জিতেছিল। মাগুরার চেয়ে হাজার গুণ বেশি জোর-জুলুম ও কারচুপি হয়েছিল বাসাইল-সখীপুর ’৯৯ সালের উপনির্বাচনে সংসদ এবং আওয়ামী লীগ থেকে পদত্যাগের পর। কিন্তু সখীপুর-বাসাইলের নির্বাচনের কারচুপি অত ব্যাপকভাবে আমরা তুলে ধরতে পারিনি। মস্তবড় বিরোধী দল বিএনপি ছিল উদাসীন। এখনো তাদের অলসতা, উদাসীনতা পুরোপুরি কাটেনি। বাসাইল পৌর নির্বাচনে ভোট পরিদর্শনের অনুমতি চেয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে চিঠি দিয়েছিলাম। তিনি তার উত্তরে আমায় এই সবক দিয়েছেন—

‘বিষয় : টাঙ্গাইল জেলার বাসাইল নির্বাচনে ভোট গ্রহণের দিন গাড়িসহ নির্বাচনী এলাকা এবং ভোট কেন্দ্র পরিদর্শনের অনুমতি প্রদানের আবেদন।

মহোদয়

উপর্যুক্ত বিষয়ে আপনার ২৪ জুন ২০১৮ তারিখের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে নির্দেশিত হয়ে জানানো যাচ্ছে যে, স্থানীয় সরকার (পৌরসভা) নির্বাচন বিধিমালা, ২০১০-এর বিধি ৩০ উপবিধি (১) এ নিম্নরূপ বিধান রয়েছে : “৩০। ভোটকেন্দ্রে ভোটারদের প্রবেশ নিয়ন্ত্রণে প্রিসাইডিং অফিসারের ক্ষমতা।— (১) প্রিজাইডিং অফিসার, কমিশনের নির্দেশসাপেক্ষে, একসঙ্গে কতজন ভোটার একটি ভোটকক্ষে প্রবেশ করিতে পারিবেন তাহা নির্ধারণ করিবেন এবং উক্তরূপে অনুমোদিত ভোটার ও নিম্নবর্ণিত ব্যক্তিগণ ব্যতীত অন্য সকলকে উক্ত ভোটকক্ষ হইতে বাহির করিয়া দিবেন, যথা— (ক) নির্বাচনে কর্তব্যরত কোন ব্যক্তি; (খ) প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীগণ, তাহাদের নির্বাচনী এজেন্ট ও প্রত্যেক ভোটকক্ষের জন্য প্রত্যেক প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর একজন করিয়া পোলিং এজেন্ট; (গ) রিটার্নিং অফিসার কর্তৃক বিশেষভাবে অনুমতিপ্রাপ্ত অন্য কোন ব্যক্তি; (ঘ) কমিশন কর্তৃক অনুমোদিত নির্বাচনী পর্যবেক্ষক; এবং (ঙ) কমিশন কর্তৃক অনুমতিপ্রাপ্ত যে কোন কর্মকর্তা।”

উক্ত বিধান অনুসারে কোনো নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের সভাপতি বা সাধারণ সম্পাদক হিসেবে নির্বাচনের দিন ভোট কেন্দ্র পরিদর্শনের আইনগত কোনো সুযোগ নেই। তবে তিনি যদি সংশ্লিষ্ট নির্বাচনী এলাকার কোনো ভোট কেন্দ্রের ভোটার হন তাহলে তিনি শুধু ভোট প্রদানের জন্য কেন্দ্রে যেতে পারবেন।

০২। সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ কর্তৃক ২৫ জুন ২০১৮ তারিখে জারিকৃত প্রজ্ঞাপন অনুসারে ভোট গ্রহণের পূর্বদিন মধ্যরাত ১২টা থেকে ভোট গ্রহণের দিন রাত ১২টা পর্যন্ত নির্বাচনী এলাকায় যান্ত্রিক যানবাহন চলাচল বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। শুধু প্রার্থী ও নির্বাচনী এজেন্ট রিটার্নিং অফিসারের অনুমতিসাপেক্ষে গাড়ি ব্যবহার করতে পারবেন। এ ছাড়া অন্য কোনো ব্যক্তির উল্লিখিত সময়ে নির্বাচনী এলাকায় গাড়ি ব্যবহারের কোনো সুযোগ নেই মর্মে মাননীয় নির্বাচন কমিশন সিদ্ধান্ত প্রদান করেছেন।

০৩। বর্ণিতবস্থায়, মাননীয় নির্বাচন কমিশনের উল্লিখিত সিদ্ধান্ত সদয় অবগতির জন্য জানানো হলো।’

রাজনীতিকে আরও কত দেউলিয়া কত মর্যাদাহীন করবেন তা নির্বাচন কমিশনই জানে। নির্বাচন সম্পর্কে অনভিজ্ঞ কিছু লোক নির্বাচনের নীতিমালা করতে গিয়ে প্রার্থীদের চোর-ডাকাতের চেয়েও খারাপ অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত করার চেষ্টা করেছে। রাজনীতি করলে সরকারের চোখের বালি হলে তার নামে মামলা হবেই। কার নামে কত মামলা। হাজার কোটি ব্যাংকে দেনা থাকলে কোনো অসুবিধা হয় না। কিন্তু ৮-১০ হাজার বিদ্যুতের বিল, ৩০-৪০-৫০ হাজার কৃষিঋণ এসবের জন্যে প্রার্থিতা বাতিল। নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের সভাপতি/সাধারণ সম্পাদক নির্বাচনে প্রার্থীদের মনোনয়ন দেন। অথচ তারা ভোট কেন্দ্রে যেতে পারেন না। কিন্তু নির্বাচন কমিশন ইচ্ছা করলেই যাকে-তাকে অনুমতি দিতে পারে। বাসাইল নির্বাচনেও দেখলাম আওয়ামী লীগের কত নেতা কত লোক ভোট কেন্দ্রে গিয়ে কত কিছু করেছে। শুধু সম্মানের ভয়ে আমরা ভোট কেন্দ্রে যেতে পারলাম না। এমন যদি নির্বাচনী নীতিমালা হয় ভবিষ্যৎ অন্ধকার।

গতবার পৌর নির্বাচনে চার প্রার্থীর মধ্যে আওয়ামী লীগ ৪ নম্বর হয়েছিল। এবারও প্রকৃত নির্বাচনে তিনজনের মধ্যে ৩ নম্বর হয়েছে। বিএনপি গামছার পক্ষে নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বিতা প্রত্যাহার করলেও কোনো কাজে আসেনি। বরং বিএনপি তাদের প্রতিদ্বন্দ্বিতা প্রত্যাহারের সঙ্গে সঙ্গে আওয়ামী লীগ ধানের শীষের প্রার্থীকে লুফে নেয়। যে কারণে তারা শেষের কদিন নির্বিবাদে আওয়ামী লীগের সাহায্যে নির্বাচন করেছে এবং প্রকৃত গণনায় ধানের শীষই জয়ী হয়েছে। গামছা দ্বিতীয় এবং নৌকা তৃতীয় স্থান অধিকার করার কথা। কিন্তু তা হয়নি। ১০টি কেন্দ্রের ৪-৫টিতে জাল-জালিয়াতি না হলেও ৫-৬টিতে চরমভাবে ধরা পড়ার মতো জালিয়াতি হয়েছে। ৯ নম্বর ওয়ার্ড বর্ণী কিশোরী, সেখানে সুন্যার রফিক আগাগোড়াই জালিয়াতি করেছে। রফিকের অসাধারণ বুদ্ধি। মানব পাচারের ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। বছর ১৫-২০ আগে তার ৬০-৬২ জনের একদল ভারতের ওপর দিয়ে অন্য কোনো দেশে যাওয়ার পথে ধরা পড়ে। সেখানে তাদের জেল-জরিমানা হয়। বাসাইল-সখীপুরের মানুষ এলাকায় গেলেই এই রফিকসহ আটকে পড়াদের মা-বাবা পাগল করে তুলত। শ্রী প্রণব মুখার্জি তখন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী। তাকে দু-তিনটি চিঠি দিই। পরে আমি নিজে দিল্লি যাই। বন্দীদের আন্দামানের কালাপানিতে রাখা হয়েছিল। সেখানে দেনদরবার করে সবকিছু ঠিকঠাক হলে বাংলাদেশের ১২০ জনসহ পাকিস্তান-নেপাল-মিয়ানমারের তিন শ কয়েকজনকে চার কোটি টাকা খরচ করে ভারত সরকার যার যার বাড়ি পাঠিয়ে দেয়। সেই রফিক বর্ণী কিশোরীতে ভোট জালিয়াতির নেতৃত্ব দিয়েছে। সেখানে একজনের ভোট আরেকজনে দিয়েছে। যারা বিদেশে আছে, মারা গেছে, অসুস্থ বা কোনো কাজে বাইরে এ রকম দেড়-দুই শ ভোট জালিয়াতি করেছে। ওদিকে ব্রাহ্মণপাড়িল সকাল থেকেই জালিয়াতি হয়েছে। তবে খুব বেশি কিছু করতে পারেনি। অন্যদিকে এমদাদ হামিদা কলেজ, জোড়াশাহীবাগে যতটা সম্ভব রয়েসয়ে কায়কারবার করেছে। ভোট গণনার সময় নৌকা পিছিয়ে ছিল। সর্বশেষ জালিয়াতির এক মারাত্মক নজির সৃষ্টি করেছে বাসাইল মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। সাড়ে ৫টা-৬টার মধ্যে সব কেন্দ্রের ফলাফল এসে গিয়েছিল। বাসাইল পাইলট বালিকা উচ্চবিদ্যালয় আর মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় বাদে। যেখানে ফলাফল ঘোষণা করা হচ্ছিল সেখান থেকে বাসাইল বালিকা বিদ্যালয় ৪০-৫০ গজের মধ্যে আর মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় বড়জোর দেড় শ গজ। এত কাছের এ দুই কেন্দ্রের ফলাফল রাত ৮টা পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। হিসাব-কিতাব করে বালিকা বিদ্যালয়ে ৫৫৫, মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ১০৯৬ ভোট নৌকায় দিয়ে জয়ী ঘোষণা করেছে। এ এক অবাক কাণ্ড! বেলা ৩টা পর্যন্ত সব জায়গায় মোটামুটি শান্তিতেই ভোট হয়েছে। ৩টা ১০-১৫র দিকে আবুবকর পীরের ছেলে হারুন দু-তিন শ বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে মডেল স্কুলে গিয়ে জালভোট দেওয়া শুরু করে। এক ছেলে সুফিয়া নামের স্লিপ নিয়ে ধরা পড়লে বলে তার মায়ের বদলি এসেছে। চ্যানেলের ক্যামেরায় তা আবার ধরাও পড়ে। বাসাইল পৌরসভার ভোট ছিল ১৬ হাজার ৪০০, কাস্টিং ভোট ১২ হাজার ৮৯০, বৈধ ভোট ১২ হাজার ৫০১, বাতিল ৩৮৯ তার মধ্যে ২৯২টিই গামছা! অথচ এখনো বস্তা খুলে পুনর্গণনা করলে ভোটের হিসাব মিলবে না। কারণ বেলা ৩টা থেকে মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যে ৪০০-৪৫০ জালভোট দেওয়া হয়েছে তার একটারও মুড়ি বইয়ে ভোটারের টিপ অথবা স্বাক্ষর নেই। প্রিসাইডিং অফিসার অথবা সহকারী প্রিসাইডিং অফিসারের স্বাক্ষর নেই। আসলে নির্বাচন কমিশনের কিছু করার নেই। তারা সাক্ষীগোপাল। দারোগা, পুলিশ, ম্যাজিস্ট্রেট সব হুকুমের দাস। বাসাইল নির্বাচনে তারা ভালো থাকার চেষ্টা করেছে। কিন্তু পারেনি। যতক্ষণ দেশে দায়িত্বশীল সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী না থাকবে ততক্ষণ কোনোমতেই প্রভাবমুক্ত নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টি হবে না। সরকারি দলের নেতা-কর্মীদের সামনে দারোগা-পুলিশ অসহায়। তবে দু-চারটা দুষ্ট ছাড়া আওয়ামী নেতা-কর্মীরাও খুব বেশি অন্যায় করতে যায়নি। তবে একটা জিনিস স্পষ্ট, সবাই মিলে নির্বাচন করলে কোনোখানেই আওয়ামী লীগ প্রকৃত ভোটে জিততে পারবে না। বিশেষ করে বৃহত্তর ময়মনসিংহের কোনোখানেই না। অথচ বর্তমান সরকার বা আওয়ামী লীগের প্রকৃত ভোটেই জেতা দরকার। না হলে তাদের ভবিষ্যৎ অন্ধকার।

লেখক : রাজনীতিক।

www.ksjleague.com

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর