মঙ্গলবার, ৩ জুলাই, ২০১৮ ০০:০০ টা

জনগণের স্বাস্থ্যসেবা এবং সরকারের করণীয়

অধ্যাপক ডা. প্রাণ গোপাল দত্ত

জনগণের স্বাস্থ্যসেবা এবং সরকারের করণীয়

জনগণের স্বাস্থ্যসেবা এবং সরকারের করণীয় ও স্বাস্থ্যসেবার সঙ্গে স্বাস্থ্যবীমার সম্পর্ক নিয়ে অনেক আলোচনা হয়েছে। চিকিৎসা শব্দটির আগে প্রচলিতভাবে জরুরি শব্দটি ব্যবহৃত হয় যা শিক্ষার আগে ব্যবহৃত হয় না। যেমন চিকিৎসা শব্দটির আগে জরুরি শব্দটি ব্যবহৃত হয় তেমন সামনে ব্যবহৃত হয় সেবা অর্থাৎ পূর্ণাঙ্গ রূপ হলো ‘জরুরি স্বাস্থ্যসেবা’ অথবা স্বাস্থ্যসেবা। অর্থাৎ স্বাস্থ্য কোনো পণ্য বা বিক্রিযোগ্য উপকরণ নয়। শিক্ষার আগে মৌলিক শব্দটিই খুব ভালোভাবে খাপ খায়। মানুষের পাঁচটি মৌলিক অধিকারের অন্যতম হলো শিক্ষা। মৌলিক শিক্ষা মানুষের জীবনে কতটা পার্থক্য গড়ে দিতে পারে যা সহজে অনুমেয়। দুটি ধারণা এখনো প্রচলিত। প্রথমটি বিলুপ্তির পথে যা হলো মা-বাবা কন্যাশিশুদের লেখাপড়া শেখাতে আগ্রহী নন, এমনকি তারা বিরোধিতা করে থাকেন। দ্বিতীয়টি এখন শুধু সন্তান লেখাপড়া করে না, তাদের মা অথবা বাবা রীতিমতো ভালো গ্রেডিংয়ের জন্য সন্তানের সঙ্গে একই ক্লাসের ছাত্র বনে যান। একান্ত গরিব ও সবচেয়ে বঞ্চিত মানুষটিও বর্তমানে তার সন্তানের লেখাপড়ার প্রয়োজনটাকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করছেন। সন্তানের জ্ঞানের পরিধির দিকে এখন মা-বাবার নজর নেই, আছে গ্রেডিংয়ের তীক্ষ দৃষ্টি।

বিভিন্ন প্রত্যক্ষ অনুসন্ধানমূলক সমীক্ষা থেকে এটাই দেখা যাচ্ছে যে, নাগাল ও আর্থিক সংগতির মধ্যে কার্যকর ও সুরক্ষিত কোনো স্কুল থাকলে কোনো মা-বাবাই শিশুকে স্কুলে পাঠানোর ব্যাপারে ইতস্তত করেন না, সে ছেলেই হোক বা মেয়ে। যেখানে কিছুটা দ্বিধাগ্রস্ত মনোভাব দেখা যায়, তার কারণ কিন্তু স্কুলের ব্যবস্থাপনাগত ত্রুটি। যেমন স্কুলের দূরত্বের কারণে শিশুদের, বিশেষত মেয়েদের নিরাপত্তাজনিত আশঙ্কা বা বিদ্যালয়ে মাত্র দু-এক জন শিক্ষক থাকা এবং মাঝে মাঝে তাদের অনুপস্থিত থাকা, এসব কারণে শিশুদের লেখাপড়ার ব্যাপারে মা-বাবার আশঙ্কা থাকলে সেটাকে তাদের আগ্রহের অভাব বলে একেবারেই ধরা ঠিক নয়। বরং সত্যটা এর বিপরীত— মা-বাবারা আসলে এ ব্যাপারে খুবই আগ্রহী।

নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক অমর্ত্য সেন তার ‘ভারত : উন্নয়ন ও বঞ্চনা’ বইতে উন্নয়ন ও শিক্ষা কলামে যা লিখেছেন তা হলো— ‘অ্যাডাম স্মিথের ধ্রুপদী বিশ্লেষণে বাজারব্যবস্থার কার্যকারিতার দিকটা খুব জোরালোভাবে ধরা পড়েছে। সেই অ্যাডাম স্মিথই ২০০ বছর আগে শিক্ষা ও উন্নয়নের সংযোগটা অত্যন্ত স্পষ্টভাবে তুলে ধরে বলেছিলেন, এ সংযোগের একটা বড় দিক হলো শিক্ষাগত পরিবর্তনে সরকারি পরিসেবার কেন্দ্রীয় গুরুত্ব। তিনি সরকারি শিক্ষাব্যবস্থার জন্য অনেক বেশি রাষ্ট্রীয় সংসাধন সরবরাহের দাবি তুলে বলেছিলেন, ‘রাষ্ট্রীয় কোষাগারের একটা সামান্য অংশ ব্যয় করেই সরকার প্রায় সব জনসাধারণকে মৌলিক শিক্ষা গ্রহণে উৎসাহিত করতে পারে, এমনকি তাদের পক্ষে এটা আবশ্যিক করে তুলতে পারে। ইউরোপ ও আমেরিকার অভিজ্ঞতাগুলোকে নিবিড়ভাবে অনুধাবন করলে খুব পরিষ্কার দেখা যায়, কীভাবে অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নে শিক্ষা একটা বহুপ্রসারী ভূমিকা পালন করেছ; এ শিক্ষা প্রসার কিন্তু সম্ভব হয়েছে সরকারি উদ্যোগেই।’ উনবিংশ শতাব্দী থেকেই এশিয়ার উদীয়মান অর্থনৈতিক শক্তিগুলো ইউরোপ ও আমেরিকার অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা গ্রহণ শুরু করে। এশিয়ায় আধুনিক অর্থনৈতিক বিকাশের পথিকৃৎ হচ্ছে জাপান; উনবিংশ শতকের মাঝামাঝি থেকেই এখানে স্কুল-শিক্ষার পরিবর্তনকারী ভূমিকাটা অত্যন্ত স্পষ্ট দেখা গিয়েছিল। ১৮৬৮ খ্রিস্টাব্দে মেইজি শাসনের পুনঃপ্রতিষ্ঠার সময়ই জাপানের সাক্ষরতার হার ইউরোপের চেয়ে বেশি ছিল, যদিও সেখানে তখনো সেই শিল্পায়ন বা আধুনিক অর্থনৈতিক উন্নয়ন হয়ে ওঠেনি, যা নাকি ইউরোপে তত দিনে এক শতাব্দী ধরে চলে আসছিল। এটা ছিল একটা অবিমিশ্র সরকারি দায়বদ্ধতার নীতি, যা শিক্ষা ক্ষেত্রে এমন একটা নিশ্চিয়তা দেবে, যাতে দেশে ‘কোনো কমিউনিটি বা জনসমষ্টিতে একটিও নিরক্ষর পরিবার থাকবে না, কোনো পরিবারেই একজন লোকও নিরক্ষর থাকবে না।’ জাপানে সর্বজনীন স্কুল-শিক্ষার এ নিশ্চয়তা এসেছিল সেখানকার গঠনমূলক রাষ্ট্রের উদ্যোগে, যদিও সেই রাষ্ট্র ছিল স্বৈরতন্ত্রী। মেইজি যুগে (১৮৬৮-১৯১২) জাপানে উন্নয়নের নীতিতে শিক্ষার ওপর অত্যন্ত বেশি জোর দেওয়া হয়। তার একটি উদাহরণ। ১৯০৬-১১ সালের মধ্যে সমগ্র জাপানের গ্রাম ও নগরাঞ্চলের মোট বাজেটের শতকরা ৪৩ ভাগ শিক্ষার জন্য বরাদ্দ হয়েছিল। এ কালপর্বে মৌলিক শিক্ষার অতি দ্রুত অগ্রগতি হয়। সেনাবাহিনীতে নিয়োগের দায়িত্বে থাকা পদাধিকারীরা অত্যন্ত আনন্দের সঙ্গে দেখেন যে, যেখানে ১৮৯৩ খ্রিস্টাব্দে সৈন্যদের এক-তৃতীয়াংশই ছিল নিরক্ষর, সেখানে ১৯০৬ সালে এসে দেখা গেল সেনাবাহিনীতে আর প্রায় কেউই নিরক্ষর নেই। ১৯১০ সালের মধ্যে জাপান প্রায় পূর্ণ-সাক্ষর একটি দেশ হয়ে ওঠে, অন্তত কম বয়সীদের ক্ষেত্রে এবং ১৯১৩ সালে পৌঁছে দেখা গেল, জাপান, যে নাকি তখন ইংল্যান্ড বা আমেরিকার তুলনায় নিতান্ত গরিব দেশ, সে ব্রিটেনের চেয়ে বেশি ও আমেরিকার তুলনায় দ্বিগুণ সংখ্যক বই প্রকাশ করে। জাপানে শিক্ষার ওপর কেন্দ্রীভূত মনোযোগ তার অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রগতিতে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। আধুনিক জাপানের ইতিহাসের পুরোটা জুড়েই তার উন্নয়ন, পরিকল্পনায় একটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অনুধাবনের ছাপ পড়েছে; মানব উন্নয়ন, বিশেষত স্কুল-শিক্ষা দরিদ্র মানুষের প্রথম এবং প্রধান মিত্র, এটা শুধু ধনী ও সচ্ছলদেরই ব্যাপার নয়। পরবর্তীকালে দক্ষিণ কোরিয়া, তাইওয়ান, সিঙ্গাপুর, হংকং এবং অবশ্যই চীনও একই পথ অনুসরণ করে মৌলিক শিক্ষার ওপর দৃষ্টিনিবদ্ধ করে এবং এটা করা হয় প্রধানত রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে। পূর্ব এশিয়ার দ্রুত অর্থনৈতিক প্রগতির কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে প্রায়ই এবং সংগত কারণেই বিশ্বায়িত বাজার অর্থনীতিকে ব্যবহার করার বিষয়ে এ অঞ্চলের দেশগুলোর আগ্রহের ওপর জোর দেওয়া হয়। কিন্তু এও মনে রাখা দরকার, এ প্রক্রিয়াটা এখানকার জনশিক্ষাগত অর্জন থেকে বিপুল সাহায্য পেয়েছে। লোকেরা যদি পড়তে লিখতে না পারত তাহলে বিশ্ব অর্থনীতিতে এত ব্যাপকভাবে অংশগ্রহণ করা এ দেশগুলোর পক্ষে খুবই কঠিন হতো। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার মতো প্রজ্ঞা ও বহুমাত্রিক দর্শনের মাধ্যমে শিক্ষা, চিকিৎসা একই সঙ্গে শিল্পায়নকে অগ্রাধিকার দিয়েছেন। চিকিৎসা ক্ষেত্রে কমিউনিটি ক্লিনিক কনসেপ্ট বা ধারণা বিশ্বকে নাড়া দিলেও কমিউনিটি ক্লিনিকে কর্মরত হেলথ কেয়ার প্রোভাইডারদের কর্মে অনীহা অথবা সরকারি চাকরি নয় বলে যে অবজ্ঞা তা নিদারুণভাবে প্রধানমন্ত্রীর দর্শনকে যেমন ক্ষতিগ্রস্ত করছে ঠিক একইভাবে বিশাল জনগোষ্ঠীকে প্রাথমিক সেবা বঞ্চিত করছে। শিক্ষার ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে শিক্ষাকে যেভাবে অবৈতনিক করে তোলা হয়েছে, শিক্ষাবৃত্তি ও উপবৃত্তি দেওয়া হচ্ছে, স্কুল থেকে ড্রপ আউট যেভাবে কমিয়ে আনা হয়েছে, এমনকি ১ জানুয়ারি দেশব্যাপী বই উৎসব কচি ছাত্র-ছাত্রীদের যেভাবে স্কুলের প্রতি আগ্রহী করে তুলেছে, তাতে আমার অটল বিশ্বাস বাংলাদেশ জাপান, তাইওয়ান, হংকং ও সিঙ্গাপুরের মতো হয়ে উঠবে। এ প্রসঙ্গে অধ্যাপক অমর্ত্য সেনের আর একটি উক্তি— ‘বাংলাদেশ দরিদ্র একটা দেশ হওয়া সত্ত্বেও মেয়েদের শিক্ষার ব্যাপারে ভারতকে শুধু ছুঁয়ে ফেলেনি, ছাড়িয়েও গেছে। নেপাল তো আরও দরিদ্র এবং ১৯৮০ সাল পর্যন্ত তার সাক্ষরতার হার ভারতের অর্ধেক ছিল। কিন্তু কম বয়সীদের সাক্ষরতায় নেপালও ভারতকে ধরে ফেলেছে। এমনকি ভারতের সঙ্গে পাকিস্তানের সাক্ষরতার হারের ব্যবধানটাও ৩০ বছর আগের তুলনায় অনেক কমে এসেছে, যদিও ভারত এখনো কিছুটা এগিয়ে আছে। এখানে যে সত্যটা উঠে আসছে, তা আসলে মৌলিক শিক্ষার বিপজ্জনক অবহেলার কাহিনী, বিশেষত মেয়েদের শিক্ষাগত বঞ্চনার তীব্র বিপদসংকেত। অথচ মৌলিক শিক্ষা হচ্ছে অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়ন প্রক্রিয়ার একটা মুখ্য প্রয়োজন।’

আমার বিবেচনায় সরকারের সদিচ্ছা থাকলেও শিক্ষার উন্নয়নের জন্য স্থানীয় নেতৃত্ব কোটারী স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠতে ব্যর্থ হয়েছেন। যেমন বিভিন্ন সংসদীয় এলাকার একেকজন ক্ষমতাসীন নেতার পরিবারের সদস্যই স্কুল কমিটিগুলোর সদস্যপদ অলঙ্কৃত করেন, যোগ্যতার মাপকাঠিই বিবেচিত হয়নি। কোনো স্কুলের একজন অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র, সরকারের উচ্চ এবং সম্মানিত পদ থেকে অবসর নিয়ে গ্রামে থাকলেও তাদের মূল্যায়ন করা হয় না, যাকে নতুন প্রজন্ম মডেল হিসেবে নিতে পারত, বড় হওয়ার আকাঙ্ক্ষা জাগত। এ উপমহাদেশের উদাহরণ হিসেবে নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা ধরা যাক, ‘একটি বৌদ্ধ সংঘ পরিচালিত এ প্রতিষ্ঠান হিন্দু রাজন্যবর্গসহ অন্যদের সহায়তায় সমগ্র এশিয়ার বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে গড়ে উঠেছিল : এশিয়ার বিভিন্ন দেশ থেকে ছাত্ররা এখানে পড়তে আসতেন। ১০৮৮-তে বলন্যা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠার ৬০০ বছর আগেই নালন্দার প্রতিষ্ঠা। নালন্দা ছিল উচ্চতর জ্ঞানচর্চার এমন এক প্রাচীন কেন্দ্র যেখানে চীন, কোরিয়া, জাপান, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া এবং অবশিষ্ট এশিয়ার বিভিন্ন দেশের ছাত্রদের আগমন ঘটত। শুধু তাই নয়, এমনকি সুদূর তুরস্ক থেকেও কিছু ছাত্র এখানে পড়তে আসতেন। সপ্তম শতাব্দীতে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শ্রেষ্ঠ সময়ে এর সম্পূর্ণ আবাসিক ছাত্রাবাসগুলোয় ১০ হাজার শিক্ষার্থী থাকতেন।

২০১১-এর পরে বিভিন্ন জরিপ সংস্থা প্রত্যেক বিশ্ববিদ্যালয়ের যেসব গ্রেডিং প্রকাশ করে, সেখানে প্রথম ২০০-এর মধ্যে ভারত, বাংলাদেশ পাকিস্তানসহ সার্কভুক্ত দেশগুলোর একটি বিশ্ববিদ্যালয়ও নেই। এই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যাকে প্রাচ্যের অক্সফোর্ড বলা হয় তার অবনমনের পেছনে কী কারণ তা খুঁজে বের করতে না পারা অবশ্যই সরকার তথা ইউজিসি ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ব্যর্থতা। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মান উন্নয়নে সবচেয়ে বড় সমস্যাগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষার্থীদের জ্ঞান ও গ্রেডিং সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়, দ্বিতীয়ত : ভর্তিসংক্রান্ত সীমাবদ্ধতা, তৃতীয়ত : জ্ঞান অর্জনের পরিবর্তে উচ্চ গ্রেডিংয়ে আগ্রহ, চতুর্থত : শিক্ষকদের শিক্ষাদান ও গবেষণায় অনীহা। গবেষক শিক্ষকের সঙ্গে তার মেধাবী এবং প্রিয় ছাত্রছাত্রীদের অনেকেই বিভিন্ন স্তরে কাজ করে, টিউশনির পরিবর্তে কিছু উপার্জন করতে পারেন এবং গবেষণায় আগ্রহী হবেন। এ ক্ষেত্রে উন্নতি ঘটাতে হলে দেশের গোটা স্কুল-শিক্ষাব্যবস্থাটাই সংস্কার, বস্তুত পুনর্নির্মাণ ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। বাংলাদেশের স্কুলগুলোর শিক্ষার মান ধরে রাখতে হলে সব ছাত্রকে যেভাবে স্কুলে আনা হচ্ছে, সেখান থেকে তাদের ড্রপ আউট কমিয়ে আনতে হবে, শিক্ষার মান পর্যাপ্ত পরিমাণে বাড়াতে হবে। শিক্ষণ পদ্ধতিতে মুখস্থের পরিবর্তে চিন্তাশক্তির বিকাশ ঘটাতে হবে। শিশুদের দিয়ে স্কুলশিক্ষকের সামনে শ্রেণিভেদে উপস্থিতভাবে কিছু সম্পর্কে বলতে এবং লিখতে দিতে হবে। যেমন প্রথম শ্রেণির ছাত্রকে তোমার বাবা সম্বন্ধে বল, মা সম্পর্কে বল, ভাই সম্পর্কে বল ইত্যাদি। তখন দেখা যাবে শিশুটি এমন কিছু বলবে যা বিনোদন বা হাসির খোরাক জোগাবে। একই সঙ্গে তার বলার সাহস জোগাবে। আমার এখনো মনে পড়ে আমি যখন চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র তখন আমার প্রধান শিক্ষক আসগর আলী স্যার এসে বললেন, আজকে আমরা কোনো লেখাপড়া করব না। আমরা সবার পরিবার সম্পর্কে পরিচয় লাভ করব। এবং প্রত্যেকে তার পরিবারের একজন সদস্য হিসেবে পাঁচটি বাক্য বলবে এবং তা নির্জলা সত্য হতে হবে। ক্লাসের ১ নম্বর রোলধারী হওয়ায় আমার বক্তব্যই প্রথম। আমাকে বললেন বাবা সম্বন্ধে বল, অথবা মা সম্বন্ধে বল। আমি বললাম, আমি ঠাকুর মা সম্পর্কে বলব। ক্লাসে হাসির রোল। স্যার অনুমতি দিলেন। যেই বললাম আমার ঠাকুরমা খুব সুন্দরী ও সাহসী। হাসির বন্যা। শতকরা একশ ভাগ সত্য। স্যার সবাইকে থামিয়ে দিলেন, আবার অনুমতি দিয়ে বললেন তুমি বল। আবার শুরু, আমার ঠাকুর মা শুধু সাহসী নয়, দাদু থেকে শুরু করে তার ছেলেমেয়েরা সবাই তাকে যমের মত ভয় পায় কিন্তু আমি ভয় পাই না। এবার হাসি আর থামছিল না, পরবর্তীতে স্যারকে বেতের সাহায্য নিতে হয়েছিল। এই যে সত্য বলার সাহস জোগানোর জন্য আমি এখনো আমার প্রধান শিক্ষক আসগর আলী স্যারকে সশ্রদ্ধচিত্তে স্মরণ করি।

দ্বিতীয় শ্রেণির ছাত্রকে তোমাদের পোষা বিড়াল অথবা পালিত গরু সম্পর্কে বল, তৃতীয় শ্রেণির ছাত্রকে বই কী, বই সম্পর্কে বল ইত্যাদি ইত্যাদি। তাহলে ছোটবেলা থেকেই বাচ্চাদের বলার অভ্যাস যেমন গড়বে তেমন ভয়হীন ও আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠবে। শিক্ষা ক্ষেত্রে অবিচল সতর্কতাই জ্ঞান বৃদ্ধির অন্যতম উপায় এবং অর্থবোধক স্বাধীনতার মূল ভিত্তি। শিক্ষা ও স্বাস্থ্যকে জনগণের কাছে পৌঁছে দেওয়ার ক্ষেত্রে অবিচল সতর্কতা থাকতে হবে এবং মনে রাখতে হবে ‘শিক্ষা এবং চিকিৎসা যদি পণ্য হয়ে যায় তবে তার গুণগত মান থাকে না’। গুণগত মানহীন শিক্ষা এবং চিকিৎসা জাতিকে এমনকি রাষ্ট্রকে ধ্বংসের পথে ঠেলে দিতে পারে।

লেখক : সাবেক উপাচার্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়।

সর্বশেষ খবর