মাননীয় নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খানের এক হাসিতেই দেশের ওপর দিয়ে এক ভূমিকম্প ও সুনামি বয়ে গেল। শহীদ রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের দুই নিরীহ শিক্ষার্থী বাসচালকের বেপরোয়া আচরণে প্রাণ হারায়। সে নিয়ে সাধারণ ছাত্ররা রাস্তায় নামলে শাজাহান খানের হাসি পায় এবং ব্যঙ্গ করেন, ‘৩৩ জন মরে গেল কিছু হলো না, দুজনের জন্য কী হবে।’ লাশ নিয়ে হাসাহাসি। মন্ত্রিসভার কোনো সদস্য এমন আচরণ করতে পারেন, ভাবা যায় না। কিন্তু তিনি করেছেন। ৩৩ জন কিছু না হলেও দুজনে কী হয় তাও দেশবাসী দেখিয়েছে। এরশাদবিরোধী আন্দোলনে কত মানুষ মারা গেছে, দেশ জ্বলে ওঠেনি। কিন্তু ডা. মিলনের মৃত্যুতে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের পতনঘণ্টা বেজেছিল। তারও আগে পাকিস্তানের শেষের দিকে আইয়ুববিরোধী আন্দোলনে কত শহীদ হয়েছে, আইয়ুবের সিংহাসন টলেনি। কিন্তু আসাদের মৃত্যুতে আইয়ুবের সিংহাসনের কবর হয়েছিল। ’৫২-এর ভাষা আন্দোলনেও একই কথা। যদিও আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল ১৯৪৮ সালে, সফল পরিণতি ১৯৫২-এর একুশে ফেব্রুয়ারি। এমনি ঘটনা অনেক। কখন দেশ-জাতি-সমাজ স্ফুলিঙ্গের মতো জ্বলে ওঠে আগে থেকে বলা যায় না। আর এটা খুবই সত্য, লাঠির জোরে জমিদারি রক্ষা করা গেলেও দেশ শাসন করা যায় না। তার প্রমাণ গত এক সপ্তাহ একেবারে অতিসাধারণ ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষাঙ্গন ছেড়ে দেশের অব্যবস্থা সঠিক করার প্রয়াস। আমাদের সন্তানদের এ আন্দোলন সরকারবিরোধী ছিল না। এ আন্দোলন ছিল অব্যবস্থাবিরোধী, সুব্যবস্থার আন্দোলন। এবারের আন্দোলনে বাইরের কারও কোনো ভূমিকা ছিল না। এখন দু-চারটা ঘটনা যা ঘটছে, তা পরিবেশ সৃষ্টির জন্য নানা জন নানা কিছু করার চেষ্টা করছে। এখানে প্রকৃত ছাত্রদের কোনো ভূমিকা নেই। পাকিস্তানের সময় আমরা যারা ছাত্রলীগ করতাম, যে কোনো মানুষের সরকারবিরোধী আন্দোলনে পাশে দাঁড়াতাম। এখন সরকারি ছাত্রলীগ সব সময় গণবিরোধী ভূমিকা নেয়। আমরা মশালমিছিল ছাড়া কখনো হাতে অস্ত্র নিতাম না। অস্ত্র বলতে আমাদের হাতে মশালের চোঙা ছাড়া আর কোনো কিছু থাকত না। হ্যাঁ, কখনো কখনো আইয়ুবি পুলিশের বিরুদ্ধে ইট-পাটকেল ছোড়াছুড়ি হয়েছে। কিন্তু কোনো আন্দোলনকারীর বিরুদ্ধে নয়, সে ছাত্র-শ্রমিক-কৃষক-জনতা কারও বিরুদ্ধে নয়। আমরা ছাত্র-শ্রমিক একাকার হয়ে মালিকের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছি। এখন মালিক-শ্রমিক ভাই-ভাই, ছাত্র-যুবকের ফাঁসি চাই। কী বিচিত্র ব্যাপার! ভাবতেই গা শিউরে ওঠে। নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান একাধারে মন্ত্রী অন্যদিকে সব বিশৃঙ্খলার মূল। শ্রমিক না হয়েও সুবিধাভোগী শ্রমিকনেতা। ছাত্রদের বিরুদ্ধে শ্রমিক, শ্রমিকদের বিরুদ্ধে জনগণ— এই হলো বর্তমান বাংলাদেশ; যা আমাদের কল্পনায়ও ছিল না। ‘মালিক-শ্রমিক ভাই ভাই’ আমরা কল্পনাও করিনি। কিন্তু তাই হয়েছে। কতজন কত সময় গলা ফাটিয়ে বলে আইন সবার জন্য সমান। কিন্তু সরকার, সরকারি প্রশাসন কখনো তা প্রমাণ করতে পারেনি। দেশের ভবিষ্যৎ আমাদের সন্তানরা এই প্রথম তা প্রমাণ করেছে। লাইসেন্সবিহীন ড্রাইভারের কারণে মন্ত্রী-এমপিকে ‘স্যার’ সম্বোধন করে গাড়ি থেকে নামিয়ে দিয়েছে। বিচারপতিদের গাড়িরও কাগজপত্র দেখেছে। পুলিশ-র্যাব-মিলিটারি-বিজিবি কেউ বাদ যায়নি। আনন্দের কথা, আমার মতো উঁচা-লম্বা আমার এক ড্রাইভার হোসেনের ড্রাইভিং লাইসেন্সের মেয়াদ শেষ। বিআরটিএ পাঁচ বছরের সময় দেয়। সেই পাঁচ বছরে লাইসেন্সের সময় আছে কি নেই চোখ বুলিয়ে দেখেনি। কিন্তু আমাদের সন্তানরা ঠিকই দেখেছে। তারা হোসেনকে পুলিশে সোপর্দ করলে পুলিশ তার নামে মামলা দিয়েছে। ট্রাফিক পুলিশরা একেওকে ধরে। যাকে ধরে সে অনুনয়-বিনয় করলে পাত্তা দেয় না। দেশের ভবিষ্যৎ ছাত্রছাত্রীরা লাইসেন্স না থাকলে পুলিশের সঙ্গেও একই আচরণ করেছে। এদের কেউ ভবিষ্যতে শেরেবাংলা, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মওলানা ভাসানী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, জননেত্রী শেখ হাসিনা, বেগম খালেদা জিয়া হবে। আমাদের চাইতে অনেক ভালো দেশ চালাবে। অনেকটা হতাশার মধ্যেও সূর্যের কিরণ দেখতে পেয়েছি এই আন্দোলনের মধ্য দিয়ে।
আমাদের সূর্যসন্তানরা! দেশের জন্মের বেদনার সঙ্গে জড়িত একজন মানুষ হিসেবে তোমাদের কাছে আমার আবেদন— আর রাস্তায় নয়, কিছু সময় নিরীক্ষণ কর। এখন তোমরা রাস্তায় থাকলে তোমাদের নানা জন নানা দিকে ব্যবহার করার চেষ্টা করবে। নানা দিকে টানাটানি করে সুনাম ক্ষুণ্ন করে আসল উদ্দেশ্যই ব্যর্থ করে দেবে। আলামত তো ইতোমধ্যে শুরু হয়ে গেছে। যে সন্তানরা প্রায় এক সপ্তাহ রাস্তায় কাউকে আপনি ছাড়া তুমি বলেনি তারা জিগাতলা বা ধানমন্ডিতে অফিস ভাঙতে পারে? বাস ছাড়া শত শত হাজার হাজার ছোট গাড়ি কেউ কাউকে কিছু বলেনি। এমন সুশৃঙ্খল নিয়ন্ত্রিত গণআন্দোলন দেশের আপামর জনসাধারণকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে, দেশবাসী ফেলনা নয়। ছাত্রছাত্রীর সঙ্গে এক পর্যায়ে তাদের মা-বাবা শরিক হয়েছেন। হাজার হাজার লাখ লাখ মানুষ দোয়া করেছে, সমর্থন করেছে। কিন্তু প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ করেনি। তাতেই পুলিশের লাঠি হাঁটুর ওপরে ওঠেনি। মানুষ রাস্তায় নামলে পায়ের পাতার ওপর কোনোকালে ওঠেনি, এখনো উঠবে না। পুলিশ, প্রশাসন, দেশের রাজনীতির জন্য কোনো শক্তি নয়, রাজনীতির শক্তি জনগণ। জনগণের ইচ্ছা-অনিচ্ছার ব্যাপারটা হয়তো সরকার এবার ভালোভাবে বুঝবে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা শহীদ রমিজ উদ্দিন কলেজের নিহত দুই শিক্ষার্থীর পরিবারকে ২০ লাখ টাকা করে ক্ষতিপূরণ দিয়েছেন। ব্যাপারটা খুবই প্রশংসনীয়। কিন্তু আরও যারা নিহত হয়েছেন তাদের কী হবে? রাষ্ট্র তো এক চোখে নুন আরেক চোখে তেল বেচতে পারে না। রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রীয় নীতি সব ক্ষেত্রে এক ও অভিন্ন হওয়া উচিত। তাই সরকারের প্রতি অবশ্যই আমার পরামর্শ— একই রকম ঘটনায় যারা নিহত হয়েছেন তাদের পরিবার-পরিজনের প্রতি সরকারের একই রকম আচরণ করা উচিত। এই অব্যবস্থার জমানায় যারা নিহত হন তারা তো বেঁচে যান। কিন্তু যারা আহত হয়ে অন্যের গলগ্রহ হয়ে বেঁচে থাকেন তাদের সে যে কী দুরবস্থা! সরকারের কি একবারও ভেবে দেখতে হবে না? বিএনপি জমানায় জননেত্রীর সভায় গ্রেনেড হামলা হয়েছিল, ২৩-২৪ জন মারা গেছেন। তারা তো বেঁচে গেছেন। কিন্তু যারা আহত হয়েছিলেন তাদের কী যে দুরবস্থা! সরকারের তো না জানার কথা নয়। হ্যাঁ, দু-চার জন সুবিধা পেয়েছেন। কিন্তু সবাই পাননি। সেজন্য আমার পরামর্শ— রাষ্ট্রের আচরণ করা উচিত রাষ্ট্রের মতো। অনতিবিলম্বে নৌপরিবহনমন্ত্রীকে বরখাস্ত করে মানুষের অভিশাপ থেকে সরকার বেরিয়ে আসবে, এমনটাই দেশবাসীর প্রত্যাশা।
সরকারকে আন্তরিক শুভ কামনা জানাতে চেয়েছিলাম যে, তারা পুলিশ ব্যবহার করে সবকিছু তছনছ করে দেয়নি। কিন্তু শেষের দিকে এখানেওখানে পুলিশের আচরণ সরকারের প্রতি বিশ্বস্ত নয়। চারদিকে অসন্তুষ্টি এ কথা এখন আর সরকারের না বোঝার কারণ নেই। তাই সময় থাকতে সাধু সাবধান!
সরকারি কর্মচারীরা কোনোকালেই কারও ছিল না। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সব সময় ক্ষমতার, সব সময় যে সরকার তার। যে যখন সরকারে থাকে তারা তখন তার সঙ্গেই থাকে— এটাই নিয়ম। বিরোধী দল সব সময় চাইবে সরকারকে অপ্রিয় করে তারা প্রিয় হতে। এটা কোনো দোষের নয়। সরকারবিরোধী সবকিছু করা বিরোধী দলের প্রধান কাজ। এজন্য কাউকে দোষ দিয়ে খুব একটা লাভ নেই। সরকারও বিরোধী দলের সব কাজকে ষড়যন্ত্র বলবে, রাষ্ট্রবিরোধী বলবে। আমাদের নামে এতকাল তা-ই বলা হয়েছে। তার পরও সরকার অদলবদল হয়েছে। সরকারের চোখে যারা রাষ্ট্রবিরোধী তারা আবার অনেক সময় সরকারে গিয়ে অতীতের সরকারকে গণবিরোধী, ব্যর্থ হিসেবে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করেছে। এসবই চিরাচরিত বিধিবিধান, চিরাচরিত প্রতিষ্ঠিত নিয়ম। সরকারি প্রশাসনে ঘাপটি মেরে থাকা অনেককেই পাওয়া যাবে, যারা ছিল এতদিন অতিভক্ত, তারাই এখন হবে সব থেকে বেশি উদাসীন। তারপর ঘরের শত্রু বিভীষণ! এটাই প্রাকৃতিক নিয়ম। এ নিয়মের ব্যত্যয় ঘটানো খুব একটা সহজ নয়। তাই সরকারকে, সরকারি দলকে লাঠি দিয়ে নয়, তাদের যোগ্যতা, দক্ষতা দিয়ে জনগণকে সঙ্গে নিতে হবে। মাননীয় সেতুমন্ত্রী এবারই প্রথম ছাত্রদের আন্দোলনে যথাযথ ভূমিকা রাখতে পেরেছেন। যদি নৌপরিবহনমন্ত্রী ওভাবে কার্যকলাপ না করতেন, তাহলে আমার বিশ্বাস এত কিছু হতো না। কোনো অহংকারই ভালো নয়। তিনি সেই অহংকারই করেছেন। মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে সত্যিই খুবই ভালোবাসার চোখে দেখি। কিন্তু তিনি হঠাৎ কেন সেদিন বলতে গেলেন, ‘ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেলে ভালো হবে না।’ রাষ্ট্রের ধৈর্য রাষ্ট্রের মন্ত্রীর ধৈর্য এ কি কচুপাতার পানি যে, মৃদুমন্দ বাতাসেই উবে যাবে? রাষ্ট্রের ধৈর্য হবে গণ্ডারের চামড়ার চাইতে পুরু। বহু ক্ষেত্রে এফোঁড়-ওফোঁড় হবে না। যা-ও দু-এক ক্ষেত্রে হবে তা হতে হতে পরিস্থিতি অনেক শীতল হয়ে আসবে। আবারও বলছি, সবই শুধু ষড়যন্ত্র না দেখে বাস্তবতার দিকে নজর দিন। দেশের কল্যাণে সবাইকে এক হয়ে অগ্রসর হওয়ার কথা। দেশ যেমন কারও পৈতৃক সম্পত্তি নয়, তেমন কোনো নাগরিককে দেশের প্রচলিত অধিকার থেকে বঞ্চিত করা যায় না। তাই ব্যাপারগুলো ধীরস্থিরভাবে শান্তমনে ভেবে দেখা দরকার। বিক্ষোভ হবে রাস্তাঘাটে, বিক্ষোভ থাকবে বিক্ষুব্ধদের মধ্যে। যারা দেশ পরিচালনা করবেন বিক্ষোভ কেন তাদের উতালা করবে? ছাত্র-যুবক-সাধারণ মানুষের জীবনের কথা যেমন ভাবতে হবে তেমন শ্রমজীবী মানুষের জীবনের কথা, তাদের নিরাপত্তার কথা, তাদের রুটি-রুজির কথা আরও বেশি দরদি মন নিয়ে ভাবতে হবে। কাউকে বাদ দিয়ে কেউ নয়। ছাত্রদের আন্দোলন শ্রমিকবিরোধী হলে, শ্রমিকদের আন্দোলন গণবিরোধী হলে কোনো দেশ শান্তিতে চলে না, কোনো দেশের সুস্থিতি-উন্নতি আসে না। কৃষক-শ্রমিক-ছাত্র-জনতা যখন হাতে হাত ধরাধরি করে এক মন এক প্রাণ হয়ে দৃঢ়পায়ে এগোয় তখন তরতর করে দেশ ও জাতি এগিয়ে যায়। আমাদের দেশে সেটারই সব থেকে বেশি অভাব। সেই অভাব দূর করাই এখন আমাদের প্রধান কাজ।
লেখক : রাজনীতিক।