বৃহস্পতিবার, ৯ আগস্ট, ২০১৮ ০০:০০ টা

হিরোশিমা নাগাসাকি ধ্বংসযজ্ঞ

আফতাব চৌধুরী

আজ থেকে ৭৩ বছর আগে ১৯৪৫ সালের ৬ ও ৯ আগস্ট যথাক্রমে জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকি শহরকে পরমাণু বোমায় ধ্বংস করেছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এ বিধ্বংসী বোমায় মুহূর্তে কেড়ে নিয়েছিল দুই লক্ষাধিক মানুষের প্রাণ।  এ আক্রমণ থেকে যারা বেঁচে গিয়েছিলেন বাকি জীবনটা তাদের পঙ্গু ও বিভিন্ন শারীরিক প্রতিবন্ধকতা নিয়ে অতিবাহিত করতে হয়েছে। লক্ষাধিক মানুষের প্রাণের বিনিময়ে আজও হিরোশিমা-নাগাসাকিবাসী পরমাণু বোমার অভিশাপ থেকে মুক্ত হতে পারেনি। আক্রান্তদের মধ্যে বেঁচে যাওয়া মানুষদের পরবর্তী প্রজন্ম আজও শরীরে বয়ে নিয়ে চলেছে পরমাণু বোমার বিষ। পরমাণু বোমায় ব্যবহৃত ভারী মৌলিক পদার্থগুলোর তেজস্ক্রিয় বিকিরণের ক্ষমতা থাকে বহুদিন, যা শুধু প্রজন্ম থেকে প্রজন্মের মানুষেরই অঙ্গ ও শারীরিক বিকৃতি ঘটায় না, যা প্রাণীকুলকে ধ্বংস এবং পানি, মাটিকেও দূষিত করে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষলগ্নে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সত্যিই কি এ বোমা ফেলার প্রয়োজন ছিল! ইতিহাস কিন্তু অন্য কথাই বলে। সব অর্থেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের এ সময়টা ছিল মিত্রশক্তির অনুকূলে। এর আগে ১৯৪৫ সালের মে মাসে জার্মানি সোভিয়েত ইউনিয়নের কাছে আত্মসমর্পণ করে। জুলাই মাসে মিত্রশক্তির দেশগুলো পটসডামে এক সম্মেলনে মিলিত হয়। এ সম্মেলনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ৮ আগস্ট থেকে জাপানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরুর কথা ঘোষণা করে সোভিয়েত ইউনিয়ন। এক কথায় জাপানের আত্মসমর্পণ ছিল শুধু সময়ের অপেক্ষা। দুই কোটি মানুষের প্রাণ এবং বিরাট ক্ষতির বিনিময়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন ফ্যাসিবাদী শক্তি জার্মানিকে পরাজিত করে। সোভিয়েত ইউনিয়নের আত্মত্যাগ সারা বিশ্বের মুক্তিকামী গণতান্ত্রিক মানুষের কাছে এক আলাদা বার্তা পৌঁছে দিয়েছিল। একই সঙ্গে বিশ্ববাসী প্রত্যক্ষ করেছিল মিত্রশক্তি অপর শরিক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকাকেও।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সবচেয়ে কঠিন সময় ছিল, যখন হিটলারের জার্মানি ইউরোপের একের পর এক দেশ ধ্বংস করে সোভিয়েত ইউনিয়নকে আক্রমণ করে। এ সময়ে সোভিয়েত রাষ্ট্র নেতৃত্ব যুদ্ধে দ্বিতীয় ফ্রন্ট খোলার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে বারবার আবেদন জানায়। সে আবেদনে কর্ণপাত করেনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। সে সময়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যদি দ্বিতীয় ফ্রন্ট খুলত, যুদ্ধও অনেক আগে শেষ হয়ে যেত এবং সোভিয়েত ইউনিয়নকে এ ক্ষতির সম্মুখীন হতে হতো না।

তাই স্বাভাবিকভাবে দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধোত্তর পৃথিবীতে নিজেদের রাজনৈতিক ও সামরিক প্রভাব নিয়ে অতিমাত্রায় চিন্তিত ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এ প্রসঙ্গে তৎকালীন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বার্নাসের উক্তি ছিল যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ। তিনি বলেছিলেন, ‘মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হাতে পারমাণবিক বোমা থাকার প্রয়োজন জাপানের পরাজয়ের জন্য নয় উদ্দেশ্য যুদ্ধোত্তর ইউরোপে রাশিয়াকে ভয় দেখিয়ে বেশি সুযোগ আদায় করা।

জার্মানি থেকে ফ্যাসিস্টদের দ্বারা বিতাড়িত পদার্থবিজ্ঞানী এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিজ্ঞানীরা এক বিশেষ পরিস্থিতিতে তৎকালীন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি রুজভেল্টকে পারমাণবিক বোমা তৈরি প্রকল্প গ্রহণের আবেদন জানায়। আসলে সে সময়ে বিজ্ঞানীদের কাছে খবর ছিল ফ্যাসিস্ট জার্মানি ঠিক এ ধরনের গবেষণা নিজের দেশে চালাচ্ছে। আইনস্টাইন, জিলার্ডের মতো পদার্থবিজ্ঞানীরা আবেদনপত্রে এ অভিমত প্রকাশ করেছিলেন যে, ‘এ শক্তি কেবল ব্যবহার করা হবে ফ্যাসিস্টদের বিরুদ্ধে আত্মরক্ষার জন্য’। এ শক্তি কখনই ব্যবহার করা হবে না সামরিক উদ্দেশ্য সাধনের জন্য। যুদ্ধের শেষদিকে খবর আসে জার্মানি এ বোমা তৈরিতে ব্যর্থ হয়েছে। তার কিছু দিন পরে জার্মানি আত্মসমর্পণ করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিজ্ঞানীরা পরমাণু বোমা তৈরিতে সফল হয়। একই সঙ্গে বিজ্ঞানীরা এ বোমা ধ্বংস করার ক্ষমতার কথা জানিয়ে তা ব্যবহার না করার আবেদন জানিয়ে মার্কিন সরকারকে স্মারকলিপি প্রদান করেন। এসব কোনো আবেদন-নিবেদনে মার্কিন রাষ্ট্রনেতারা কর্ণপাত করেননি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সমাপ্তের মধ্য দিয়ে বিশ্ব ফ্যাসিবাদের হাত থেকে মুক্ত হয়েছিল। কিন্তু এক নতুন বিপদের সম্মুখীন হয়েছিল বিশ্ব, তা হলো আণবিক বোমার বিপদ। গত শতাব্দীর পঞ্চাশের দশকে শুরু হয় শান্তির আন্দোলন। গত শতাব্দীর নয়ের দশকের গোড়ায় সোভিয়েত ইউনিয়নসহ পূর্ব ইউরোপের সমাজতান্ত্রিক শিবিরের বিপর্যয় ঘটেছে। তা সত্ত্বেও বিশ্ববাসী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন থেকে মুক্ত হয়নি। গেল ক’বছরে তারা একে একে ধ্বংস করেছে যুগোস্লাভিয়া, আফগানিস্তান, ইরাক। এখন এদের লক্ষ্য কিউবা, উত্তর কোরিয়া, ভেনেজুয়েলা, ইরান, সিরিয়া প্রভৃতি দেশ।

ক’দিন পরপর মার্কিন সমর্থনে বলীয়ান হয়েই ইসরায়েল— লেবানন, সিরিয়া, প্যালেস্টাইনের ওপর যথেচ্ছ আক্রমণ চালাচ্ছে। নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্ব, ভুল বোঝাবুঝি, একে অন্যের ওপর প্রভাব বিস্তার লোভে বিশ্বের বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলো সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে ব্যর্থ হয়েছে। পক্ষান্তরে তাদের নীতি মার্কিনমুখী হয়ে পড়েছে। আসলে পুঁজিবাদী দর্শনের মধ্যেই আর্থিক সংকটের বীজ লুকিয়ে আছে। এর থেকেই পুঁজিবাদমুক্ত হতে চাইছে যুদ্ধের মধ্য দিয়ে। তাই পুঁজিবাদ যতদিন না ধ্বংস হবে, ততদিন বিশ্ববাসী যুদ্ধ থেকে মুক্ত হবে না।  সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন এবং যুদ্ধের বীভৎসতা সম্পর্কে মানুষের সচেতন করার উপযুক্ত দিন ৬ এবং ৯ আগস্ট। সারা বিশ্বে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার অনুগামী শক্তি বিশ্বায়ন, উদার অর্থনীতি, সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের নামে মানবতা, গণতন্ত্র এবং স্বাধীন দেশের সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে যে নৃশংস আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছে তার বিরুদ্ধে সোচ্চার  প্রতিবাদের মধ্য দিয়ে হিরোশিমা ও  নাগাসাকি দিবস পালনের সময় এসেছে।

লেখক : কলামিস্ট।

 

সর্বশেষ খবর