শনিবার, ১৮ আগস্ট, ২০১৮ ০০:০০ টা
বায়তুল মোকাররমের খুতবা

কোরবানির গুরুত্ব ফাজায়েল ও মাসায়েল

হাফেজ মাওলানা মুহিউদ্দিন কাসেম
পেশ ইমাম, বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদ

কোরবানি একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। হাদিস শরিফে এ ইবাদতের প্রতি উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে।  একটি হাদিসে এসেছে, ‘রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হজরত ফাতেমা (রা.)-কে তার কোরবানির কাছে উপস্থিত থাকতে বলেন এবং ইরশাদ করেন, এই কোরবানির প্রথম রক্তবিন্দু প্রবাহিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আল্লাহতায়ালা তোমার গুনাহসমূহ ক্ষমা করে দেবেন। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, ‘ইয়া রসুলুল্লাহ, এটা কি শুধু আহলে বাইতের জন্য নাকি সব মুসলিমের জন্য? উত্তরে তিনি ইরশাদ করেন, এই ফজিলত সব মুসলিমের জন্য’ (মুসনাদে বাজজার, আত্তারগীব ওয়াত্তারহীব ২/১৫৪)। অপরদিকে যারা সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও এই ইবাদতটি পালন করে না তাদের ব্যাপারে বলা হয়েছে, ‘যে ব্যক্তির কোরবানির সামর্থ্য রয়েছে, কিন্তু কোরবানি করে না সে যেন আমাদের ঈদগাহে না আসে।’ (মুস্তাদরাকে হাকেম, আত্তারহীব ২/১৫৫)। সারকথা হলো, রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যুগ থেকে আজ পর্যন্ত উম্মতের মধ্যে এই ইবাদত ‘তাওয়ারুছ’ ও ‘তাওয়াতুর’-এর সঙ্গে চলমান রয়েছে এবং প্রতি বছর ‘শিয়ার’ রূপে (ইসলামের একটি প্রকাশ্য ও সম্মিলিতভাবে আদায়যোগ্য ইবাদত হিসেবে) তা আদায় করা হয়েছে। অতএব কেউ যদি মনে করে, কোরবানি ইবাদত নয় এবং ইসলামী শিক্ষার অন্তর্ভুক্ত নয়, তবে সে শরিয়ত অস্বীকারকারী।

তবে এক্ষেত্রে স্মরণ রাখতে হবে ইবাদতের মূলকথা হলো আল্লাহতায়ালার আনুগত্য এবং তাঁর সন্তুষ্টি অর্জনের প্রেরণা। তাই যে কোনো ইবাদতের পূর্ণতার জন্য দুটি বিষয় জরুরি। ইখলাস তথা একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে আদায় করা এবং শরিয়তের নির্দেশনা মোতাবেক মাসআলা-মাসায়েল অনুযায়ী তা সম্পাদন করা। তাই এ সংক্ষিপ্ত আলোচনায় কোরবানির জরুরি মাসায়েলগুলো উপস্থাপিত হলো। মহান রাব্বুল আলামিন আমাদের একমাত্র তাঁর সন্তুষ্টি অর্জনের আশায় মাসায়েল অনুযায়ী এ গুরুত্বপূর্ণ ইবাদতটি আদায় করার তৌফিক দিন।

কোরবানির প্রয়োজনীয় মাসআলাসমূহ।

* ১০ জিলহজ ফজর থেকে ১২ জিলহজ সূর্যাস্ত পর্যন্ত যে প্রাপ্তবয়স্ক সুস্থ মস্তিষ্কসম্পন্ন নর-নারীর কাছে প্রয়োজনের অতিরিক্ত সাড়ে ৫২ তোলা রুপার মূল্য পরিমাণ সম্পদ থাকবে তার কোরবানি করা ওয়াজিব। টাকা-পয়সা, সোনা-রুপার অলঙ্কার, ব্যবসায়িক পণ্য, প্রয়োজনের অতিরিক্ত জমি, শৌখিন বা অপ্রয়োজনীয় আসবাবপত্র— এ সবকিছুর মূল্য কোরবানির নেসাবের ক্ষেত্রে হিসাবযোগ্য (ইবনে মাজাহ ২২৬; বাদায়ে ৪/১৯৬; শামী ৬/৩১২; আলমগীরী ৫/২৯২)।

* কোরবানির নেসাব পুরো বছর থাকা জরুরি নয়; বরং কোরবানির দিনগুলোয় থাকলেই তা ওয়াজিব হবে। (বাদায়েউস সানায়ে ৪/১৯৬; রদ্দুল মুহতার ৬/৩১২)। নাবালেগ সন্তানাদি (তেমনি যে সুস্থ মস্তিষ্কসম্পন্ন নয়) নেসাবের মালিক হলেও ওদের ওপর কোরবানি ওয়াজিব নয়। (বাদায়েউস সানায়ে ৪/১৯৬; রদ্দুল মুহতার ৬/৩১৬)।  গরিব ব্যক্তির ওপর কোরবানি করা ওয়াজিব নয়; কিন্তু সে যদি কোরবানির নিয়তে কোনো পশু কিনে তাহলে তা কোরবানি করা ওয়াজিব হয়ে যায় (বাদায়েউস সানায়ে ৪/১৯২)।

* মোট তিন দিন কোরবানি করা যায়। জিলহজের ১০, ১১ ও ১২ তারিখ সূর্যাস্ত পর্যন্ত। তবে সম্ভব হলে জিলহজের ১০ তারিখেই কোরবানি করা উত্তম। (মুআত্তা মালেক ১৮৮; বাদায়েউস সানায়ে ৪/১৯৮; ২৩; আলমগীরী ৫/২৯৫)

* কেউ যদি কোরবানির দিনগুলোয় ওয়াজিব কোরবানি দিতে না পারে তাহলে পরে তার ওপর কোরবানির উপযুক্ত একটি ভাগের মূল্য সদকা করা ওয়াজিব। (বাদায়েউস সানায়ে ৪/২০৩; কাজিখান ৩/৩৪৫)। উট, গরু, মহিষ, ছাগল, ভেড়া ও দুম্বা দ্বারা কোরবানি করা জায়েজ। এসব গৃহপালিত পশু ছাড়া অন্যান্য পশু যেমন— হরিণ, বন্য গরু ইত্যাদি দ্বারা কোরবানি করা জায়েজ নয়। (কাজিখান ৩/৩৪৮; বাদায়েউস সানায়ে ৪/২০৫)। যেসব পশু কোরবানি করা জায়েজ সেগুলোর নর-মাদা সবই কোরবানি করা যায়। (কাজিখান ৩/৩৪৮; বাদায়েউস সানায়ে ৪/২০৫)। কোরবানির পশুর বয়সসীমা : উট কমপক্ষে পাঁচ বছরের হতে হবে। গরু ও মহিষ কমপক্ষে দুই বছরের হতে হবে। আর ছাগল, ভেড়া ও দুম্বা কমপক্ষে এক বছরের হতে হবে। তবে ভেড়া ও দুম্বা যদি এক বছরের কিছু কমও হয় কিন্তু এমন হৃষ্টপুষ্ট হয় যে, তা দেখতে এক বছরের মতো মনে হয় তাহলে তা দ্বারাও কোরবানি করা জায়েজ। অবশ্য এক্ষেত্রে কমপক্ষে ছয় মাস বয়সের হতে হবে। উল্লেখ্য, ছাগলের বয়স এক বছরের কম হলে কোনো অবস্থাতেই তা দ্বারা কোরবানি জায়েজ হবে না। (কাজিখান ৩/৩৪৮; বাদায়েউস সানায়ে ৪/২০৫-২০৬)। একটি ছাগল, ভেড়া বা দুম্বা দ্বারা শুধু একজনই কোরবানি দিতে পারবে। একাধিক ব্যক্তি মিলে কোরবানি করলে কারওটা সহিহ হবে না। আর উট, গরু, মহিষে সর্বোচ্চ সাতজন শরিক হতে পারবে। সাতের অধিক শরিক হলে কারও কোরবানি সহিহ হবে না। (সহিহ মুসলিম ১৩১৮; মুআত্তা মালেক ১/৩১৯; কাজিখান ৩/৩৪৯; বাদায়েউস সানায়ে ৪/২০৭-২০৮)।

* সাতজন মিলে কোরবানি করলে সবার অংশ সমান হতে হবে। কারও অংশ এক সপ্তমাংশের কম হতে পারবে না। যেমন— কারও আধাভাগ, কারও দেড়ভাগ। এক্ষেত্রে কোনো শরিকের কোরবানিই সহিহ হবে না। (বাদায়েউস সানায়ে ৪/২০৭। উট, গরু, মহিষ সাত ভাগে এবং সাতের কমে যে কোনো সংখ্যা যেমন— দুই, তিন, চার, পাঁচ ও ছয় ভাগে কোরবানি করা জায়েজ। (সহিহ মুসলিম ১৩১৮; বাদায়েউস সানায়ে ৪/২০৭)

যদি কেউ আল্লাহতায়ালার হুকুম পালনের উদ্দেশ্যে কোরবানি না করে শুধু গোশত খাওয়ার নিয়তে কোরবানি করে বা লোক দেখানোর নিয়তে কোরবানি করে তাহলে কারও কোরবানি হবে না। তাই অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে শরিক নির্বাচন করতে হবে।  (বাদায়েউস সানায়ে ৪/২০৮-২০৯; কাজিখান ৩/৩৪৯)।

সর্বশেষ খবর