রবিবার, ২৬ আগস্ট, ২০১৮ ০০:০০ টা

ধর্ম ও রাজনীতি

জাকারিয়া চৌধুরী

ধর্ম ও রাজনীতি

যারা যে ধর্মেই বিশ্বাসী হোন না কেন এবং যে নামেই আল্লাহকে ডাকেন না কেন, তাদের মনে রাখতে হবে ধর্মকে কেন্দ্র করে আল্লাহ নন, আল্লাহকে কেন্দ্র করে ধর্ম। যারাই একক আল্লাহয় আস্থাশীল, আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞ ও অনুগত এবং তাঁর কাছে জবাবদিহিতায় বিশ্বাসী, তারা সবাই আল্লাহর ধর্মে দীড়্গিত। ঐতিহাসিক পরম্পরায় আল্লাহর বাণী নিয়ে বহু পয়গম্বরের আবির্ভাব হয়েছে আদিকাল থেকে। আল্লাহর বাণীর সর্বশেষ প্রচারক হজরত মুহাম্মদ (সা.)। ইসলামের উত্পত্তি সেই বিশ্বাস থেকে। পবিত্র কোরআনে স্পষ্ট ভাষায় বলা হয়েছে, জানা-অজানা অতীতের সব পয়গম্বরের ওপরই বিশ্বাস রাখতে হবে আল্লাহর প্রেরিত বিশেষ প্রতিনিধি হিসেবে। এক হিসেবে মানুষ মাত্রেই আল্লাহর প্রতিনিধি, যে জন্য মানুষকে বলা হয়েছে, ‘আশরাফুল মাখলুকাত’—সব প্রাণিকুলের মধ্যে ‘শ্রেষ্ঠ জীব’।

মানুষ তার চিন্তা ও কল্পনা শক্তির সীমাবদ্ধতার কারণে পৌত্তলিকতার দিকে ঝুঁকে পড়ে। নিরাকার আল্লাহর উপাসনা করতে গিয়ে তারা বস্তুজগতের প্রতীককে পূজা করে। কোরআনে বলা হয়েছে, ‘চেয়ে দেখ আমার প্রতীক সর্বত্র’। চন্দ্র, সূর্য, গ্রহ, তারা রূপে, রসে-গন্ধে ভরা আমাদের বসুন্ধরা সবই স্রষ্টার অপরিসীম সৃষ্টিশক্তির ও সৌন্দর্য বোধের সাড়্গ্য। সবই স্রষ্টার বেঁধে দেওয়া নিয়মে বাঁধা যে জন্য কক্ষচ্যুত হয়ে এক গ্রহের সঙ্গে আরেক গ্রহের সংঘর্ষ বাধে না, নদী তার আপন গতিতে ধেয়ে চলে যুগ যুগ ধরে। পর্বতরাশি অটুট বন্ধনে সমুন্নত থাকে ধসে পড়ে না—তাও কোরআনের ভাষায় ‘সব কিছু নির্দিষ্ট সময়-কালের জন্য’। এখন বিজ্ঞানই বলে, আমাদের সুন্দর পৃথিবী ও মহাবিশ্বও একদিন ধ্বংসপ্রাপ্ত হবে কসমিক নিয়মে। কোরআনের কথা অনুযায়ী—জন্ম নেবে নতুন বিশ্বব্রহ্মা্ল’ (সূরা ইব্রাহিম-৪৮)।

মানব জীবন দুই আইনে বাঁধা—মানুষের বেঁধে দেওয়া ‘আইন’ ও ‘ধর্মীয় বিধান’। মানুষের বেঁধে দেওয়া আইন ভঙ্গ করলে বিচারক হয় মানুষ এবং বিচার হয় এই জীবনেই। সাজাও হয় তাক্ষণিক। আর ধর্মীয় বিধান অমান্য করলে বিচারক হন আল্লাহ এবং বিচার হবে নতুন জন্মে। রাষ্ট্রীয় শাস্তিমূলক আইন দিয়ে ধর্মীয় বিধান মানতে বাধ্য করা ধর্মীয় নীতির বিরোধী। ধর্ম তখন আর ধর্ম থাকে না, হয়ে পড়ে রাষ্ট্রীয় অনুশাসন। মানুষের বেঁধে দেওয়া আইন দিয়ে মানুষের সব অপরাধের বিচার সম্ভব নয়। যেমন ভ্লামি, কার্পণ্য, অভদ্রতা, নিষ্ঠুরতা, স্বার্থপরতা, হীনমন্যতা, সঙ্কীর্ণতা, ঈর্ষা, হিংসা। তা ছাড়া মানুষ অনেক সময় বিচারে ভুল করে, আল্লাহর বেলায় বিচার হবে নির্ভুল।

জ্ঞানে-বিজ্ঞানে মানব জাতি উন্নয়নের এমন এক শিখরে পৌঁছেছে যখন আর শুধু ধর্মের নিরিখেই নয়, জ্ঞানের আলোয় আল্লাহর মাহাত্ম্য অনুধাবন করতে হবে। আমাদের এখন নিজ দায়িত্বে জ্ঞানের আলোকে আল্লাহকে পেতে হবে, বুঝতে হবে এবং তার নির্দেশিত নীতিতে চলতে হবে। আল্লাহর প্রেরণায় অনুপ্রাণিত থেকে বিবেককে সদা জাগ্রত রেখে সমাজ পরিচালনা করতে হবে, নতুন কেনো পয়গম্বর আসবেন না মানব জাতিকে দিক-নির্দেশনা দিতে। পবিত্র কোরআনে বার বার মানুষকে তাগিদ দেওয়া হয়েছে জ্ঞান অর্জনের জন্য। ধর্ম আল্লাহকে অনুধাবন করার জন্য সহায়ক কিন্তু মানুষের উপাস্য ধর্ম বা ধর্ম প্রচারক নয়, মানুষের উপাস্য আল্লাহ। আমরা আল্লাহর চেয়ে বড় করে দেখি ধর্মকে। তার চেয়েও বড় করে দেখি ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানকে। এ নিয়ে মাতামাতি ও মারামারি করি। ধর্মের নাম করে মানবসমাজে প্রতিহিংসা ও অশান্তির আগুন ছড়িয়ে দেই। রাজনৈতিক ফায়দা লোটার জন্য ধর্মকে ব্যবহার করে মানুষে মানুষে ঘৃণা ও সংঘাতের সৃষ্টি করি, যা আল্লাহ প্রেরিত নীতির ঘোর বিরোধী। নীতি-নৈতিকতার প্রশ্নে ধর্মে ধর্মে খুব একটা পার্থক্য দেখি না।

ধর্মের ব্যাপারে বাড়াবাড়ি যেন না করা হয় সেই উদ্দেশ্যে আল্লাহ হজরত মুহাম্মদ (সা.)-কে সম্বোধন করে বলেছেন, ‚If it had been thy Lord্থs Will, They would all have believed,- All who are on earth! অর্থাৎ “আল্লাহ ইচ্ছে করলে পৃথিবীতে সবাইকে বিশ্বাসী করে পাঠাতে পারতেন! Wilt thou then compel mankind against their will, to believe! অর্থাৎ আপনি কি তাহলে মানব জাতিকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে বিশ্বাসী হতে বাধ্য করবেন (সূরা ইউনুস-৯৯)। আবার সূরা বাকারায় আল্লাহ বলেছেন, ‘ধর্মের ব্যাপারে কোনো বাধ্য-বাধকতা যেন না থাকে (সূরা বাকারা-২৫৬)।

মানব জীবন কখনো সম্পূর্ণভাবে অপরাধ ও অশান্তি মুক্ত হতে পারেনি। এক সময়ে ভাবতাম socio-economic system বদলাতে পারলে মানব ইতিহাস থেকে এই কালো মেঘ কেটে যাবে। এক সময়ে ছিল Tribal Szstem, পরে হলো Feudal Szstem, এলো Mercantalism, এলো Capitalism, এলো Socialism, কিন্তু কোনো system-ই সমাজ থেকে অপরাধ প্রবণতা ও অন্যায় নির্মূূল করতে পারেনি। আর পারবেও না সামগ্রিকভাবে mind-set বা মন-মানসিকতা না বদলালে। তা বদলাতে হলে প্রয়োজন নৈতিকতার, প্রয়োজন আত্ম-উপলব্ধি ও আত্ম-সচেতনতার। মানুষের মন গড়ার ব্যাপারে ধর্মীয় নীতি বড় রকমের সহায়ক শক্তি। আমরা ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান নিয়ে ব্যস্ত থাকি, নীতির তোয়াক্কা করি না। আল্লাহর নীতি মানা না মানা নিজ নিজ ইচ্ছার ওপর নির্ভর করে। আমরা সবাই আল্লাহর কাছে সমষ্টিক নই ব্যক্তিগতভাবে দায়ী (individual responsibility) থাকব আমাদের কৃতকর্মের জন্য। আল্লাহ আমাদের চিন্তাশক্তির স্বাধীনতা দিয়ে এই মর্ত্যে পাঠিয়েছেন। যাকে বলা যায় freedom of choice বা intellectual freedom। এই গুরু দায়িত্ব পালনে বা পরীক্ষায় যদি ব্যর্থ হই তাহলে আল্লাহর কাছে আমরা দায়ী থাকব—মানুষের কাছে নয়। মানুষের তৈরি শাস্তিমূলক বা punitive আইন দিয়ে বিবেকের বিকাশ ও বিসত্মার সম্ভব নয়। সেই জন্য প্রয়োজন আধ্যাত্মিক সচেতনতা বা spiritual awareness-এর। যেহেতু পবিত্র কোরআনে আল্লাহর উক্তি অনুযায়ী ‘ধর্ম পালন করা না করার ব্যাপারে কোনো জোর-জবরদস্তি নাই’, সেহেতু মানুষের তৈরি আইন দিয়ে ধর্মীয় বিধান চাপিয়ে দেওয়া আল্লাহর নীতিবিরোধী। ‘যার যার ধর্ম তার তার কাছে’—এই নিয়ে বিতর্কে জড়িয়ে পড়ে মানুষে মানুষে যেন দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করা না হয় সে ব্যাপারে আল্লাহ সতর্ক করে দিয়েছেন কোরআনে। 

যারা পবিত্র ধর্মকে নোংরা রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় যেতে চায় তারা আর যাই হোক, ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল নয়। রাজনীতি এক কথায় ক্ষমতার লড়াই—তা রাজতন্ত্র, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র সব অবস্থাতেই। রাজনীতিতে ভ্লামি, ছল-চাতুরী, কূটকৌশল, চক্রান্ত-ষড়যন্ত্র, অর্থবল, পেশিবল, প্রচারবল—অধর্মীয় এসব নানা পন্থা প্রয়োগ করা হয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার জন্য। তাই ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হলে, ধর্মকে কখনো রাজনীতির ডামাডোলে টেনে আনা উচিত নয়।

ভারতে শত শত বছরের পাঠান-মোগল শাসনামলে কিংবা বৃহত্তর বঙ্গভূমিতে সুলতানি শাসনামল কিংবা স্পেনে শত শত বছরের মুসলিম শাসনামলে কিংবা মদিনায় হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর তত্ত্বাবধানে রচিত ‘মদিনা-সনদ’ অনুযায়ী প্রতিষ্ঠিত নগর শাসনে ইসলামকে রাষ্ট্রীয় আইন দিয়ে মানতে বাধ্য করা হয়নি। মদিনায় যখন আমাদের নবী তাঁর সভাপতিত্বে নগর শাসন কায়েম করেন, তখন মদিনা শহরে পৌত্তলিক, ইহুদি ও ইসলামে ধর্মান্তরিত মুসলমান—বিভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায়ের বসবাস ছিল। হজরত মুহম্মদের (সা.)-এর নেতৃত্বাধীন মদিনায়, ধর্মীয় ভিন্নতার জন্য কোনো ভেদাভেদ সৃষ্টি হয়নি। কারও নাগরিক অধিকার খর্বিত হয়নি। রাজনৈতিক অভিলাষ ছিল না বলে হজরত মুহাম্মদ (সা.) কোনো রাজত্ব স্থাপন করেননি। 

ধরা পৃষ্ঠের খাঁটি (প্রকৃষ্ট) নাগরিক হতে হলে পবিত্র কোরআনে যেসব নীতিমালা মেনে চলার কথা বলা হয়েছে তা সবার জন্য সব কালে সমভাবে প্রযোজ্য। পৃথিবীর বুকে দায়িত্বশীল বিশ্ব নাগরিক হয়ে বেঁচে থাকতে হলে একজনকে হতে হবে ন্যায়পরায়ণ ও দানশীল এবং আল্লাহ ও আল্লাহর বিচারের ব্যাপারে সচেতন।

পরনিন্দা, পরশ্রীকাতরতা, ঈর্ষা, হিংসা, ছল-চাতুরী, ভ্লামী, লোভ-লালসা অহমিকা পরিহার করে স্বচ্ছ, সুন্দর, সহনশীল মানব সমাজ গড়ে তুলতে বলা হয়েছে পবিত্র কোরআনে এবং তা প্রতিফলিত হয়েছে হজরত মুহাম্মদ (সা.) জীবন ধারায়। আমাদের মনে রাখা উচিত হজরত মুহাম্মদ (সা.) ৪০ বছর বয়সে নবুয়ত পাওয়ার আগে একজন সৎ ও সুন্দর মানুষ হিসেবে সমাজে সুখ্যাতি অর্জন করেন। আমরা আগে ভালো মানুষ হই, তাহলেই সাচ্চা মুসলমান হতে পারব। আমাদের মনে রাখা উচিত, হজরত মুহাম্মদ (সা.) দীর্ঘ ৪০ বছর বয়স পর্যন্ত সমাজে আদর্শিক ভালো মানুষ হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরই তাকে আল্লাহ নবুয়ত দান করেন। মুসলমান না হয়েও একজন ভালো মানুষ হতে পারে। আবার মুসলমান হয়েও একজন ভালো মানুষ নাও হতে পারে। তবে ভালো মুসলমান হতে হলে ভালো মানুষ হতেই হবে। ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা পালনের চেয়ে ভালো মানুষ হওয়া অনেক কঠিন। এজন্যই বোধ হয় আমরা আল্লাহকে সন্তুষ্ট রাখতে চাই আনুষ্ঠানিকতা দিয়ে—মন দিয়ে, সত্তা দিয়ে, কর্ম দিয়ে, আত্মা দিয়ে নয়।

আমরা এখন প্রযুক্তি ও বণিকশাসিত সমাজে বাস করি। নিত্য-নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবন করছি, বাজারজাত করছি, মুনাফা করছি। নিত্য-নতুন ভোগ-বিলাসিতার উপকরণ তৈরি করছি। জীবনের চাহিদা দিনে দিনে বাড়াচ্ছি। নিত্য-নতুন পণ্যে বাজারমাত না করতে পারলে Capitalism-এর চাকা ঘুরবে না| Capitalist system-এ অপ্রয়োজনীয় বিলাসী পণ্যের জন্য অর্থের অভাব হয় না, অর্থের অভাব হয় নিত্যপ্রয়োজনীয় বেঁচে থাকার সামগ্রীর জন্য। Need based economics-এর পথে না গিয়ে আমরা ধাবিত হচ্ছি মুনাফার পেছনে। আর লাভ-ক্ষতির হিসাব-নিকাশ হচ্ছে অস্থিতিশীল ও অনিশ্চিত Money Market-এর মাধ্যমে। তেলা মাথায় তেল দেওয়ার এই নীতির কারণে দিনে দিনে মানব সমাজে বৈষম্য ও বঞ্চনা বাড়ছে। জীবনের মৌলিক চাহিদা—অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান ও শিক্ষার অভাবে যখন বিশ্বের কোটি কোটি লোক অবহেলিত ও বঞ্চিত থাকছে, যখন আমাদের অর্থনৈতিক কর্মকা্লের কারণে জলবায়ু দূষিত ও বিপর্যস্ত হয়ে মানব অস্তিত্বকে বিপন্ন করে তুলছে তখনো অর্থনৈতিক নীতি বা জীবন দর্শনে কোনো পরিবর্তনের আভাস পাওয়া যাচ্ছে না। যে Economic system ও Life style-এর কারণে আজকের এতসব সমস্যা তা অটুট রেখেই সমাধান খুঁজছেন রাজনীতিবিদ ও পরিবেশবাদীরা। তাহলে কি করে আশা করতে পারি, ভারসাম্যতা আসবে, স্থিতিশীলতা আসবে, শান্তি আসবে মানব সমাজে। ফলে আমরা সবাই অনিশ্চয়তা ও অশান্তিতে ভুগছি। রাজনীতির সঙ্গে ধর্মকে জড়ালে পরিণতি কি হয় তার জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত ইসলামের নামে জঙ্গিবাদের উত্থান। ইসলামের নামে নিরস্ত্র ও নিরপরাধ মানুষ হত্যা।

এই জঙ্গিবাদের উত্থান ঘটায় আমেরিকা আফগানিসত্মানে ১৯৭০ দশকের শেষ ও ৮০ দশকের শুরুতে। শীতল যুদ্ধ সময়কালে  আফগানিসত্মানকে সোভিয়েত রাশিয়ার প্রভাব ও দখলমুক্ত করার জন্য বিন লাদেনের সহায়তায় আফগানিসত্মান ও পাকিসত্মানের বিভিন্ন মাদ্রাসার ছাত্রদের প্রশিক্ষণ দিয়ে ‘নাস্তিক’ কমিউনিষ্টদের বিরুদ্ধে যে যুদ্ধের সূচনা করা হয়—তা আগ্রাসনের বিরুদ্ধে জনযুদ্ধ না হয়ে, হয়ে দাঁড়ায় ধর্মীয় যুদ্ধ। দখলদারী ‘নাস্তিক’ সামরিক বাহিনীকে দেশের মাটি থেকে বিতাড়িত করার জন্য সৃষ্টি হয় জেহাদি তালেবানের সংগঠন। শেষ অবধি সোভিয়েত রাশিয়ার সামরিক বাহিনী পরাজয় বরণ করে আফগানিসত্মান ত্যাগ করতে বাধ্য হয়, যেমনটি আমেরিকা করেছিল ভিয়েতনামের বেলায়। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করে তালেবানরা। তারই জের ধরে এখন বিভিন্ন নামে সৃষ্টি হচ্ছে ‘জেহাদি’ তত্পরতার—যা ইসলামবিরোধী, যা মানবতাবিরোধী, যা মানব সভ্যতাবিরোধী। অথচ কোরআন শরিফে আল্লাহ বলেছেন, ‘বিনা দোষে কাউকে হত্যা করা গোটা মানব জাতিকে হত্যা করার শামিল’—হত্যা এতই জঘন্য অপরাধ। একজন প্রখ্যাত ইংরেজ কবি John Donne এর ভাষায় ‘any man’s death diminishes me, because ও am involved in mankind’. মুসলমান সম্প্রদায়কে বিশ্বের কাছে হেয় প্রতিপন্ন করার জন্য মৌলবাদী জঙ্গি ভাবধারা ও তত্পরতার আড়াল থেকে ইন্ধন জোগাচ্ছে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে মুসলিম বিদ্বেষী একটি চক্র তাদের ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থ সিদ্ধির জন্য। আইএসের উত্থানও এই সূত্র ধরে। হতাশাগ্রস্ত ও বিড়্গুব্ধ মনের মুসলিম তরুণদের motivate করা হচ্ছে ‘জেহাদি’ হয়ে জীবনের সব কিছুর মায়া ত্যাগ করে সহজ পথে জান্নাতবাসী হওয়ার জন্য। যারাই সমাজ জীবনের ওপর ভীতশ্রদ্ধ হয়ে এ ধরনের বিধ্বংসী পথে পা বাড়াতে চায় তাদের বলব আমরা সবাই যেন বেহেশতে যাওয়ার আশায় জেহাদি হই—মনের সব অকল্যাণকর প্রবৃত্তিকে দমন করার জন্য যুদ্ধ করে, নিরীহ মানুষ ও নিজেকে হত্যা করে নয়। মুসলিমবিদ্বেষী যে আন্তর্জাতিক চক্র পেছন থেকে উসকানি দিচ্ছে সে সম্পর্কে আমাদের সজাগ ও সচেতন থেকে প্রয়োজনীয় কর্মকৌশল নেওয়া প্রয়োজন। আমাদের দেশের স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসার শিক্ষক সম্প্রদায়ের দায়িত্ব হওয়া উচিত এ ধরনের ভ্রান্ত ও বিকৃত motivation সম্পর্কে ছাত্র-ছাত্রীদের সতর্ক ও সচেতন করে তোলা। সর্বোপরি শুধু পুঁথিগত বিদ্যা, টাকা উপার্জনের জন্য বিদ্যা নয়, প্রয়োজন নৈতিকতা শিক্ষা ও বিবেকের বিকাশ, যা আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় নাই। তাই তো এত সহিংসতা, এত দুর্নীতি সমাজ জীবনে। অর্থনৈতিক উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে মন-মানসিকতার উন্নয়ন, দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন ও বিবেকের বিকাশ ঘটাতে হবে সত্যিকার অর্থে সুখী ও সমৃদ্ধশালী হতে হলে। আমরা মানবকুল ইতিহাসে মানবসভ্যতার এমন একযুগ-সন্ধিক্ষণে উপনীত হয়েছি যখন থেকে আমাদের আর সব পরিচয়ের আগে নিজেদের মানবসন্তান রূপে গণ্য করতে শিখতে হবে। মানুষে মানুষে শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার সেতু গড়ে তুলতে হবে। তবেই আমরা প্রমাণ করতে পারব মানুষ ধরা পৃষ্ঠের ‘শ্রেষ্ঠ জীব’। ধর্ম ও জাতি বৈচিত্র্য যাই থাক না কেন, আমাদের সমাজে মানব ভাগ্য যে এখন একসূত্রে গাঁথা হয়ে গেছে প্রযুক্তি ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের অভূতপূর্ব অগ্রগতিতে—এই সচেতনতা জাগাতে হবে প্রতিটি মানুষের মনে। মন থেকে সব রকমের সঙ্কীর্ণতা ও হীনতা দূর করতে হবে মানব ভবিষ্যৎ কণ্টক ও শঙ্কামুক্ত করতে হলে। সেই সুদিন যদি আমার জীবদ্দশায় নাও আসে সুন্দর স্বপ্ন দেখতে দোষ কী?

লেখক : সরকারের সাবেক উপদেষ্টা।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর