হিজরি ৬১ সনের ১০ মহররম তথা আশুরার দিনে ফোরাত নদের তীরে কারবালার প্রান্তরে রাজতান্ত্রিক উমাইয়া খিলাফতের দ্বিতীয় খলিফা ইয়াজিদ বিন মুয়াবিয়া প্রেরিত সেনাবাহিনীর হাতে হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর দৌহিত্র হজরত হুসাইন (রা.)-এর শাহাদাতবরণ করায় তখন থেকে ওই দিনটি তাঁর শাহাদাতবার্ষিকী হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। ধর্মীয় বিশ্বাসমতে, এই আশুরার দিনেই মহান আল্লাহ নিজেকে প্রকাশ করার জন্য সৃষ্টির সূচনা করেন। তিনি এই দিনেই প্রথম মানব হজরত আদম (আ.)-এর মধ্যে রুহ (আত্মা) প্রবেশ করান। এ ছাড়া এই আশুরার দিন যে উল্লেখযোগ্য ইতিহাসের স্মৃতি বহন করছে তার মধ্যে অন্যতম হলো, এই দিনে হজরত আদম ও হাওয়া (আ.)-কে পৃথিবীতে প্রেরণ করা হয় এবং ৩৫০ বছর কান্নাকাটি করার পর এই দিনেই হজরত মুহাম্মদের (সা.) অসিলায় মহান আল্লাহ তাঁদের ক্ষমা করেন। হজরত ইবরাহিম (আ.)-কে নমরুদের অগ্নিকু- থেকে রক্ষা এবং হজরত ইউনুস (আ.)-কে মাছের পেট থেকে উদ্ধারের ঘটনাও এই আশুরার দিনে ঘটে। হজরত সুলায়মান (আ.)-এর হারানো রাজত্ব ফেরত পান এবং হজরত আইয়ুব (আ.) দীর্ঘকাল রোগভোগের পর সুস্থ হন এই আশুরার দিনেই। এ ছাড়া হজরত ইউসুফ (আ.) ৪০ বছর পর পিতা হজরত ইয়াকুব (আ.)-এর সঙ্গে সাক্ষাৎ পান এবং ফেরাউনের হাত থেকে হজরত মুসা (আ.) ও তাঁর জাতিকে আল্লাহ রক্ষা করেন এই আশুরার দিনে। এই দিনেই ফেরাউন লোহিত সাগরে ডুবে মারা যায় এবং হজরত নুহ (আ.) মহাপ্লাবন শেষে আল্লাহর নির্দেশে বিরাট জাহাজ থেকে জুদি পাহাড়ে অবতরণ করেন। ইসলামী চিন্তাবিদদের মতে, কিয়ামত হবে কোনো এক আশুরার দিনে। তাই সব দিক বিবেচনায় এ দিনটি ইসলাম ও ইসলামের ইতিহাসের জন্য অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ হিসেবে বিবেচিত। বর্তমানে মুসলিমদের কাছে এই দিনটি হজরত হুসাইন (রা.)-এর শাহাদাতবার্ষিকী হিসেবে স্মরণীয়। ঐতিহাসিক বিবরণী থেকে জানা যায়, খোলাফায়ে রাশেদীনের তৃতীয় খলিফা হজরত ওসমান বিন আফফান (রা.)-এর নির্মম হত্যাকা-কে কেন্দ্র করে চতুর্থ খলিফা হজরত আলী (রা.) ও সিরিয়ার প্রাদেশিক শাসনকর্তা হজরত মুয়াবিয়া (রা.)-এর মধ্যে যে সিফফিনের যুদ্ধ হয়; সেই পরিপ্রেক্ষিতে খারেজিদের প্রেরিত গুপ্তঘাতক আবদুর রহমান বিন মুলজিমের হাতে হজরত আলী (রা.)-এর শাহাদাতবরণের পর হজরত মুয়াবিয়া (রা.) খলিফা পদে আসীন হন। হজরত মুয়াবিয়া (রা.) খলিফা হওয়ার কিছু দিন পর হজরত আলী (রা.)-এর বড় ছেলে হজরত হাসান (রা.)-এর সঙ্গে সম্পাদিত চুক্তি ভঙ্গ করে হজরত হুসাইন (রা.)-এর পরিবর্তে নিজ পুত্র ইয়াজিদকে পরবর্তী খলিফা হিসেবে ঘোষণা করেন। ৬৮০ খ্রিস্টাব্দে ইয়াজিদ খলিফা পদে আসীন হলে হজরত হুসাইন (রা.) তাকে খলিফা হিসেবে মেনে নিতে অস্বীকার করেন। তিনি খলিফা নির্বাচনের প্রচলিত রীতি ভঙ্গ করে হজরত মুয়াবিয়া (রা.)-এর রাজতান্ত্রিক উত্তরাধিকার মনোনয়নকে প্রত্যাখ্যান করেন।
ইতিমধ্যে ইরাকের কুফার অধিবাসীরাও ইয়াজিদকে খলিফা হিসেবে মেনে নিতে অস্বীকার করে ইয়াজিদের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণের জন্য হজরত হুসাইন (রা.)-এর কাছে প্রায় ৫০০টি চিঠি প্রেরণ করেন। হজরত হুসাইন (রা.) কুফাবাসীর কথায় আস্থা রেখে ইয়াজিদের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণে সম্মত হন। তিনি এ লক্ষ্যে কুফার প্রকৃত অবস্থা অবগত হওয়ার জন্য তাঁর চাচাতো ভাই মুসলিম বিন আকিলকে কুফায় পাঠান। মুসলিম কুফায় পৌঁছানের আগেই কুফাবাসী ও হজরত হুসাইন (রা.)-এর অস্ত্রধারণের বিষয়টি ইয়াজিদ অবগত হন। ফলে তিনি কুফার শাসনকর্তাকে বহিষ্কার করে আবদুল্লাহ বিন জিয়াদকে শাসক নিযুক্ত করেন। জিয়াদ দায়িত্ব গ্রহণ করেই কুফাবাসীকে অর্থের বিনিময়ে অথবা ভয় দেখিয়ে ইয়াজিদের প্রতি আনুগত্য প্রকাশে বাধ্য করেন। এ ছাড়া কুফাবাসীর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যও এর জন্য কম দায়ী ছিল না।
ফলে হজরত হুসাইন (রা.) যখন কুফাবাসীদের সাহায্য করার জন্য ইরাক সীমান্তে উপনীত হলেন; তখন তিনি ইয়াজিদ প্রেরিত সৈন্য ছাড়া কোনো কুফাবাসীর অস্তিত্ব খুঁজে পেলেন না। এ অবস্থায় তিনি প্রতিশ্রুত সাহায্যপ্রাপ্তির আশায় ফোরাত নদের তীরে কারবালায় শিবির স্থাপন করে অপেক্ষা করতে লাগলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কুফাবাসীদের ছায়াও খুঁজে না পেয়ে তিনি ইয়াজিদের বাহিনীর কাছে তিনটি প্রস্তাব করেন : ক. হয় তাঁকে মদিনায় ফেরত যেতে দেওয়া হোক, খ. তুর্কি সীমান্তের দুর্গে প্রেরণ করা হোক যাতে তিনি জিহাদে অংশগ্রহণ করতে পারেন অথবা গ. তাঁকে নিরাপদে ইয়াজিদের সাক্ষাৎলাভের সুযোগ করে দেওয়া হোক। কিন্তু ইয়াজিদ বাহিনী তাঁর কোনো অনুরোধই রাখল না। ফলে কারবালার প্রান্তরে মাত্র ৩০ জন অশ্বারোহী, ৪০ জন পদাতিক এবং ১৭ জন নারী-শিশু নিয়ে তিনি ইয়াজিদ বাহিনীর মোকাবিলায় অস্ত্র হাতে তুলে নিলেন। যুদ্ধে বীরত্বের সঙ্গে লড়ে ৭২ জন সহযোদ্ধাসহ তিনি শাহাদাতবরণ করেন। ইয়াজিদ বাহিনী শুধু শিশুদের ফোরাত নদের পানি পান না করতে দেওয়ার মতো নিষ্ঠুরতা দেখায়নি; তারা হজরত হুসাইন (রা.)-এর দেহ থেকে মস্তক ছিন্ন করে কুফায় দুর্গে নিয়ে যায় এবং উবায়দুল্লাহ ওই ছিন্ন মস্তকে বেত্রাঘাত করে উল্লাস প্রকাশ করেন।লেখক : সহকারী অধ্যাপক ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়