এ মুহূর্তে অর্থনৈতিকভাবে বাংলাদেশ যে অবস্থায় রয়েছে তাকে বলা যায় ‘ইগনিশন ফেইজ’ বা ‘ব্যাপক উত্থান পর্ব’। অর্থাৎ এখন সময় দেশের ভিতরের চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি আন্তর্জাতিক বাজারের চাহিদা মেটাতে রপ্তানি ও বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ানোর মাধ্যমে উচ্চতর প্রবৃদ্ধি অর্জনের। সাম্প্রতিক সময়ে, বিশেষত গত ১০ বছরে সরকারের সুবিবেচনাপ্রসূত এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ননীতির ফলে সামষ্টিক অর্থনৈতিক সূচক ও সামাজিক সূচকগুলোয় বাংলাদেশ ব্যাপক অগ্রগতি অর্জন করেছে। ফলস্বরূপ আমরা স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে যুক্ত হয়েছি এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উচ্চ আয়ের দেশে পরিণত হওয়ার আশা করতে পারছি।
বাংলাদেশ এসব অর্জনের কারণে এখন সারা বিশ্বে অন্তর্ভুক্তিমূলক ও টেকসই উন্নয়নের মডেল হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। কিন্তু আগামীতে সামষ্টিক অর্থনৈতিক লক্ষ্যগুলো অর্জনের পথে বেশকিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। এসব চ্যালেঞ্জের মধ্যে আছে ২০২৫ সাল পর্যন্ত প্রতি বছর ১৬ লাখ নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি, বিদেশি বিনিয়োগ কয়েক গুণ বাড়ানো, রপ্তানি বহুমুখীকরণ ও নতুন নতুন বাজারে রপ্তানি পণ্য প্রবেশের সুযোগ তৈরি ইত্যাদি। বর্তমান সরকার এ লক্ষ্যগুলো ও চ্যালেঞ্জ বিষয়ে সংবেদনশীল। তাই শিল্প খাতের বিকাশ এবং রপ্তানি বৃদ্ধির জন্য নীতিগত ও অবকাঠামোগত সংস্কার ও উন্নয়ন কার্যক্রমের বিষয়ে সরকার বিশেষ উদ্যোগী। এ ক্ষেত্রে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের জেলাগুলোর দিকে সরকারের বিশেষ মনোযোগ রয়েছে। তাই পদ্মা সেতু ও পায়রা বন্দরের মতো মেগা উন্নয়ন প্রকল্পগুলো হাতে নেওয়া হয়েছে এবং এগুলোর দ্রুত বাস্তবায়নকে অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে। আশা করা হচ্ছে যে এ দুটি মেগা প্রকল্প দেশের জিডিপি ১.২ শতাংশ বাড়াবে এবং দারিদ্র্য দূরীকরণে বিশাল ভূমিকা রাখবে।
বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের বাণিজ্যের যে ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে তার সামান্য অংশই এখন পর্যন্ত কাজে লাগানো গেছে বা যাচ্ছে। যেমন, বিশ্বব্যাংকের সাম্প্রতিক একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রতিবেশী ভারতে বাংলাদেশ বর্তমানে যতটুকু রপ্তানি করছে, রপ্তানির পরিমাণ তার চেয়ে তিন গুণ পর্যন্ত বাড়ানো সম্ভব। দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের অন্য দেশগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্যের অবস্থাও একই রকম। বাণিজ্য (রপ্তানি ও আমদানি) বাড়ানোর ক্ষেত্রে প্রধানতম প্রতিবন্ধকগুলোর একটি হলো অবকাঠামোর অভাব। আর এখানেই পায়রা বন্দর বৈপ্লøবিক পরিবর্তন নিয়ে আসতে পারে। দেশের পায়রা বন্দর অন্য দুটি সমুদ্রবন্দরের (চট্টগ্রাম ও মোংলা) তুলনায় এগিয়ে থাকবে কারণ এখানে জোয়ার-ভাটার জন্য অপেক্ষা না করে যে কোনো সময়ে দেশের ভিতরে জলপথে পণ্য ঢোকানো যাবে এবং অন্য সমুদ্রবন্দরে যে বৃহদায়তন নৌযান প্রবেশ করতে পারে না, সেগুলো এখানে পণ্য ওঠানো-নামানোর জন্য প্রবেশ করানো যাবে।পায়রা বন্দরের মাধ্যমে একদিকে বাংলাদেশের শিল্পপণ্য পরিবহনে সময় বাঁচানো যাবে এবং ব্যয় বহুলাংশে কমানো যাবে; অন্যদিকে প্রতিবেশী দেশগুলোও এ বন্দর ব্যবহারের মাধ্যমে নিজেদের বাণিজ্য সহজীকরণ করতে পারবে (বিনিময়ে আমরা পাব রাজস্ব)। বাংলাদেশ-ভুটান-ভারত-নেপালের মধ্যে সড়কপথে যোগাযোগ সহজীকরণের উদ্যোগ বিবিআইএন-এমভিএ বাস্তবায়নকাজ এখন চলছে। পায়রা বন্দরকেও দেশের বাকি অংশের সঙ্গে সড়ক ও রেলপথের মাধ্যমে যুক্ত করার কাজ চলমান আছে। ফলে বলা যায় যে, বিবিআইএন-এমভিএ ও পায়রা বন্দর প্রকল্পের পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন হলে তা এ অঞ্চলের অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যের পুরো চিত্রটাই বদলে দেবে। মনে রাখতে হবে, দক্ষিণ এশিয়ার বাজার হলো ১.৭ বিলিয়ন ভোক্তার বাজার। ফলে এ অঞ্চলের দেশগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ যত সহজ হবে বাণিজ্যের সম্ভাবনা ততই বাড়বে, আর আমাদের নতুন নতুন বাজারে প্রবেশ ও রপ্তানি বহুমুখীকরণের সুযোগ তৈরি হবে।
পায়রা বন্দর হবে প্রকৃত অর্থেই একটি আন্তর্জাতিক মানের সমুদ্রবন্দর (ইতিমধ্যে কার্যক্রম শুরু হলেও, এটি ২০২৩ সালের মধ্যে একটি পূর্ণাঙ্গ গভীর সমুদ্রবন্দরে পরিণত হবে)। এই অত্যাধুনিক অবকাঠামো সুবিধা কাজে লাগাতে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশে বিনিয়োগ করতে আগ্রহী হবেন, ফলে এফডিআই লক্ষ্যমাত্রা অর্জন সহজ হবে (সরকার সারা দেশে যে ১০০ এসইজেড তৈরি করতে যাচ্ছে তাও এ ক্ষেত্রে সহায়ক হবে)। পাশাপাশি বিদেশি উদ্যোগগুলোর ব্যাকওয়ার্ড ও ফরওয়ার্ড লিঙ্কেজ ইন্ডাস্ট্রি হিসেবে বাংলাদেশেও নতুন নতুন শিল্প উদ্যোগের সম্ভাবনা তৈরি হবে। মোট কথা, আগামী কয়েক বছরের মধ্যে পায়রা বন্দর বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম প্রধান শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হতে যাচ্ছে।
শিল্প-বাণিজ্য-বিদেশি বিনিয়োগের পাশাপাশি পর্যটনেও বাংলাদেশের ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে। আর আগামী দিনের সামষ্টিক অর্থনৈতিক লক্ষ্যগুলো অর্জনে এ সম্ভাবনাকেও কাজে লাগাতে হবে। আর এ ক্ষেত্রে দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের পর্যটন কেন্দ্র কুয়াকাটা বিশেষভাবে প্রাসঙ্গিক। ভৌগোলিক-প্রাকৃতিক কারণে পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে কুয়াকাটার যে সম্ভাবনা রয়েছে আমরা তা পুরোপুরি কাজে লাগাতে পারছি এমন বলা যাবে না। সত্যি হলো, দেশি-বিদেশি পর্যটকরা এখানে এলেও যত বেশি সংখ্যায় আসার কথা সেভাবে আসছেন না এবং যারা আসছেন তারাও মানসম্পন্ন সেবা পাচ্ছেন না। এর প্রধান কারণগুলো হলো, যোগাযোগব্যবস্থার দুর্বলতা, অনেক ক্ষেত্রে সেবার ব্যয় বেশি হওয়া, পর্যটকদের থাকা-খাওয়া-নিরাপত্তা ইত্যাদির জন্য পর্যাপ্ত ব্যবস্থা না থাকা।
পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে কুয়াকাটাকে আরও আকর্ষণীয় করে তোলার পাশাপাশি একে প্রকৃত অর্থেই একটি আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলতে এসব প্রতিবন্ধক দূর করা খুবই জরুরি। অবকাঠামোসহ অন্যান্য সুবিধা বাড়ানোর কাজে সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি বেসরকারি খাতকেও তাই এগিয়ে আসতে হবে। মনে রাখতে হবে, পদ্মা সেতু ও পায়রা বন্দরের মতো মেগা প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন হলে দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলে দেশি-বিদেশি নাগরিকদের যাতায়াত কয়েক গুণ বাড়বে, আর এর ফলে পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে কুয়াকাটার সম্ভাবনাও বাড়বে। এ সম্ভাবনা কাজে লাগানো এখন সময়ের দাবি।
এ কথা ভুলে গেলে চলবে না যে, যে কোনো উন্নয়ন তা গভীর সমুদ্রবন্দর হোক বা পর্যটন কেন্দ্রই হোক; এর সুফল যদি দরিদ্র ও প্রান্তিক মানুষের কাছে না পৌঁছায় তাহলে উন্নয়নের মূল লক্ষ্য অর্জন করা সম্ভব নয়। কাজেই পায়রা বন্দর গড়ে তোলা বা কুয়াকাটা পর্যটন কেন্দ্রের মানোন্নয়নের সুফল যেন দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের দরিদ্র ও প্রান্তিক জনগণ পায় সেদিকে বিশেষ মনোযোগ দিতে হবে। প্রথমত, এসব উন্নয়ন প্রকল্পের ফলে এ অঞ্চলে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। কিন্তু প্রয়োজনীয় দক্ষতা না থাকলে এ অঞ্চলের মানুষ সে কর্মসংস্থানের সুযোগ কাজে লাগাতে পারবে না। তাই বাজার-উপযোগী শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে (যেমন, টেকনিক্যাল ও ভোকেশনাল এডুকেশন, টিভিইটি)। দ্বিতীয়ত, বৃহৎ প্রকল্পগুলোর কারণে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প ও সেবা খাতে (অর্থাৎ সাপোর্ট সার্ভিসেস) নতুন উদ্যোগের চাহিদা তৈরি হবে। কিন্তু এ অঞ্চলের উদ্যোক্তাদের জন্য অর্থায়নের ব্যবস্থা করা না গেলে তারা উদ্যোক্তা হয়ে এ সুযোগ কাজে লাগাতে পারবেন না। তাই এ অঞ্চলের উদ্যোক্তাদের জন্য ঋণের সুবিধা দিতে হবে। তৃতীয়ত, স্থানীয় ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পকেও উৎসাহিত করতে হবে। গভীর সমুদ্রবন্দর ও পর্যটন কেন্দ্রের কারণে এখানে দেশি-বিদেশি মানুষের যাতায়াত বাড়বে। ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের বিকাশ একদিকে পর্যটকদের আকৃষ্ট করবে, অন্যদিকে স্থানীয় প্রান্তিক মানুষের আয়ের সুযোগ বাড়াবে।
এসব উদ্যোগকে অবশ্যই পরিবশবান্ধব হতে হবে। কারণ উন্নয়ন কর্মকা-ের ফলে পরিবেশের অপূরণীয় ক্ষতি হলে সেটিকে টেকসই উন্নয়ন বা সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট বলা যায় না। আবার এও মনে রাখতে হবে যে, চারপাশের পরিবেশের ন্যূনতম পরিবর্তন না ঘটিয়ে উন্নয়ন প্রকল্প সম্ভব নয়। তবে যতটুকু ক্ষতি হচ্ছে তা পূরণ করার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা প্রকল্পে থাকছে কিনা তা-ই দেখার বিষয়। এটা নিঃসন্দেহে বলা যায়, সরকারের পক্ষ থেকে সব দিক বিবেচনা করে (যথাযথ এনভায়রনমেন্টাল ও সোশ্যাল ইমপ্যাক্ট অ্যাসেসমেন্টের পরে) প্রকল্প এলাকা নির্বাচন ও বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। কিন্তু সরকারি উদ্যোগে নেওয়া প্রকল্পের ফলস্বরূপ বেসরকারি খাতও অনেক উদ্যোগ নেয়। সেগুলো পরিবেশগত মান বজায় রেখে বাস্তবায়ন হচ্ছে কিনা সেদিকে নজর রাখতে হবে (যেমন, পায়রা বন্দরের আশপাশে অনেক নতুন শিল্পকারখানা গড়ে উঠতে পারে)। তবে এই নজরদারির কাজ প্রধানত সরকারের হলেও সুশীলসমাজ, বিশেষত গণমাধ্যমকে সজাগ থাকতে হবে এবং সরকারকে সহযোগিতা করতে হবে।
বাংলাদেশের এখন সামনে এগিয়ে যাওয়ার সময়। এ ঐতিহাসিক অগ্রযাত্রায় যেন সর্বস্তরের মানুষকে যুক্ত করা যায়, যেন প্রান্তিক মানুষও উন্নয়নের ন্যায্য হিস্্সা পায় তা আমাদের নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি নিশ্চিত করতে হবে, যেন উন্নয়ন হয় টেকসই, যেন পরিবেশ-প্রতিবেশের কোনো অপূরণীয় ক্ষতি না হয়। তাহলেই আগামী প্রজন্মগুলোর জন্য আমরা রেখে যেতে পারব অপার সম্ভাবনাময় বাংলাদেশ।
লেখক : সাবেক গভর্নর, বাংলাদেশ ব্যাংক