মানুষমাত্রই শোবার ঘরের পাশাপাশি বসার ঘরটি চমৎকার করে সাজিয়ে তোলে মানুষ। শোবার ঘরে সবার প্রবেশাধিকার নেই। তবে বসার ঘরে বসতে পারে যে কেউই। বসার ঘর থেকেই অনুমান করা যায়, ব্যক্তি কতটা রুচিশীল। কতটা প্রভাবশালী। তাই আমরা চাই, আমাদের বসার ঘরে যেন ব্যক্তিত্ব ফুটে ওঠে। আমি আপনি যদি একজন সাধারণ মানুষ হয়ে বসার ঘর দেখতে কেমন- এ বিষয়ে এতটা যত্নশীল হই, তাহলে চিন্তা করুণ আমাদের প্রভু তার বাইরের সৃষ্টিসৌন্দর্য প্রকাশ করতে কত বেশি যত্নশীল? সুবহানাল্লাহ! আমরা আল্লাহকে দেখতে পারব না বা পারছি না। তবে আল্লাহ তায়ালার এ বাইরের সৃষ্টিরূপ দেখে ঠিকই অনুমান করতে পারি তার সৌন্দর্য, তার মাহাত্ম্য কত বেশি। কবি বড় চমৎকার বলেছেন- দুনিয়া সুন্দর!/মানুষ সুন্দর!/আসমান সুন্দর!/জমিন সুন্দর/সুন্দরে সুন্দরের পাল্লা!/জানি না কত সুন্দর তুমি আল্লাহ।
আল্লাহকে চেনার জন্য, আল্লাহকে জানার জন্য, আল্লাহর সৌন্দর্য অনুভব করার জন্য পৃথিবীতে সুন্দরের মেলা বসিয়েছেন আল্লাহ তায়ালা। পৃথিবী ছাড়া মহাশূন্যে যত গ্রহ-নক্ষত্র, গ্যালাক্সি-মিল্কিওয়ে আছে, আর কোথাও হয়তো এত অপরূপ সুন্দরের ডালি ছড়িয়ে দেওয়া হয়নি। সেখানে হয়তো খোদার সৌন্দর্য দেখে তার রূপে মুগ্ধ হওয়ার মতো কেউ নেই। পৃথিবীতে খোদার ছড়িয়ে দেওয়া সৌন্দর্যের মধ্যে অন্যতম সৌন্দর্য হলো ঋতু বৈচিত্র্যের সৌন্দর্য। একেক ঋতুতে একেক সৌন্দর্য। প্রতিটি ঋতুই প্রকাশ করছে আল্লাহ তায়ালার মহিমার প্রকাশ।
বাংলার প্রকৃতিতে এখন চলছে শরৎ ঋতু। শরৎ মানেই কাশফুলের সমারোহ। বিলের ধারে, খালের পারে মাথা উঁচু করে সারি সারি দাঁড়িয়ে আছে কাশফুল। কাশফুল দেখে থমকে দাঁড়ায় না এমন মানুষ খুব কমই আছে। ঠিক কবে কখন কাশফুল ফুটে তার খোঁজ হয়তো রাখে না অনেকেই। হঠাৎ একদিন চলতি পথে থমকে দাঁড়ায় সাদা ফুলের হাতছানি দেখে। তখন কবির মন যেমন দোলা দেয়, তেমনি সাধারণ মানুষের মনও উদাস হয়ে যায়। মনের এই উদাসীনতাই আসলে খুঁজে ফেরে কাশফুলের অপরূপ সৌন্দর্যের মহান সৃষ্টা আল্লাহ তায়ালাকে। তাইতো কবি কাশফুল দেখে স্বীকার করেছেন, হে কাশফুল! আমি তোমার দাস। মানে তোমাকে যিনি সৃষ্টি করেছেন সেই অসীম সুন্দর স্রষ্টার দাস। কবির ভাষায়- ইচ্ছে করে ডেকে বলি, ওগো কাশের মেয়ে- ‘আজকে আমার চোখ জুড়ালো তোমার দেখা পেয়েতোমার হাতে বন্দী আমার ভালোবাসার কাশ
তাইতো আমি এই শরতে তোমার কৃতদাস’।
শরতের আকাশ অন্যসব ঋতুর চেয়ে আলাদা। মন খারাপ করা দিনে শুধু শরতের আকাশই পারে আমাদের মন ভালো করে দিতে। স্বচ্ছ নীল আকাশ। পুঞ্জ পুঞ্জ সাদা মেঘের ভেলা ভেসে বেড়ায়। দেখতে কী যে ভালো লাগে বলে বোঝাতে পারব না। তাছাড়া ভালো তো লাগারই কথা। কারণ, নির্দেশটা যে আল্লাহ তায়ালাই দিয়েছেন। আল্লাহ নিজেই পবিত্র কোরআনে বলেছেন, ‘হে আমার বান্দা! তুমি চোখ মেলে দেখো, আমি আকাশে মেঘের ভেলা ছড়িয়ে দিয়েছি। তারপর সেগুলো পুঞ্জ পুঞ্জ মেঘে সাজিয়ে দিই। বান্দা! তারপর ওই মেঘ থেকে আমিই বৃষ্টি বর্ষণ করি। যদি তুমি দেখতে তবে তোমার মন ভরে যেত। (সূরা নূর : ৪৩) শরতের আকাশ দেখে মন ভরে গিয়েছিল বাংলার এক কবির। তিনি লিখেছেন-
‘এখানে আকাশ নীল নীলাভ আকাশ জুড়ে সজিনার ফুল
ফুটে থাকে হিম শাদা রং তার আশ্বিনের আলোর মতন;
আকন্দুফুলের কালো ভীমরুল এইখানে করে গুঞ্জরণ
রৌদ্রের দুপুর ভরে, বারবার রোদ তার সুচিকন চুল
কাঁঠাল জামের বুকে নিংড়ায়ে দহে বিলে চঞ্চল আঙুল।’
শরতের কাশফুল আর আকাশের মতই এই ঋতুতে ফুটে নানান রঙের ফুল। সবকিছু মিলিয়েই আল্লাহ যেন শরৎকে সাজিয়ে দিয়েছেন ভিন্ন এক সৌন্দর্য দিয়ে। বান্দা শরতের আকাশ, কাশফুল দেখে মুগ্ধ হবে। মন খুলে বলবে আলহামদুলিল্লাহ। গেয়ে ওঠবে, ‘তোমার সৃষ্টি যদি হয় এত সুন্দর, না জানি প্রভু তুমি কত সুন্দর। আফসোস! আমরা আজ রোবট মানুষে পরিণত হয়েছি। প্রকৃতির সৌন্দর্য দেখার ফুরসত আমাদের নেই। তাইতো আমাদের ভিতর থেকেও সৌন্দর্য হারিয়ে যাচ্ছে। দিন দিন আমরা হয়ে পড়ছি হিংস্র থেকে আরও হিংস্র। হে মানুষ! প্রকৃতি তোমার সামনে সুন্দরের ডালি মেলে ধরেছে, চোখ মেলে তাকাও। সুন্দর হও। অন্যকে সুন্দর কর। সুন্দরের স্রষ্টা আল্লাহর প্রেমে নিজেকে বিলীন করার সবক এই প্রকৃতি থেকেই নেওয়ার তৌফিক হে আল্লাহ আমাদের দিন।
লেখক : বিশিষ্ট মুফাসসিরে কোরআন ও গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব।
চেয়ারম্যান : বাংলাদেশ মুফাসসির সোসাইটি।
www.selimazadi.com