রবিবার, ১৪ অক্টোবর, ২০১৮ ০০:০০ টা

মোদি সরকার জনগণের নয় অনিল আম্বানির জন্য

সুখরঞ্জন দাশগুপ্ত

মোদি সরকার জনগণের নয় অনিল আম্বানির জন্য

২০১৯ সালে ভারতের সিংহাসন কে দখল করবে তার সেমিফাইনালের ফলাফল ইঙ্গিত দেবে। এটাই দেশের বিশিষ্ট রাজনীতিবিদদের মত। নভেম্বরের শেষ সপ্তাহ থেকে দেশের পাঁচটি রাজ্যের বিধানসভার ফলাফলই সুস্পষ্ট ইঙ্গিত দেবে। মোদি না রাহুল গান্ধী। এই পাঁচটি রাজ্য হলো হিন্দিবলয়ের মধ্যপ্রদেশ, ছত্তিশগড়, রাজস্থান, দক্ষিণের তেলেঙ্গানা এবং উত্তর-পূর্বের মিজোরাম, হিন্দিবলয়ের তিনটি রাজ্যের নির্বাচনের ফলাফল কী দাঁড়াতে পারে তার সমীক্ষা বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে ইতিমধ্যে এসে গেছে। তাতে দেখা যাচ্ছে মধ্যপ্রদেশ, ছত্রিশগড়, রাজস্থানে কংগ্রেস বিপুলভাবে এগিয়ে আছে। এ তিনটি রাজ্যে বিজেপি ক্ষমতায়। এর মধ্যে মধ্যপ্রদেশ, ছত্রিশগড়ে ১৫ বছর, রাজস্থানে ৫ বছর, অন্ধ্র ভেঙে দক্ষিণের তেলেঙ্গানায় প্রথম নির্বাচন হবে আর দেশের উত্তর-পূর্বে মিজোরাম বর্তমানে মিলিঝুলি সরকার। হিন্দিবলয়ের তিনটি রাজ্যে বিজেপি গেরুয়াবাহিনী দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকার ফলে সমীক্ষায় বলছে তাদের আর ফিরে আসার কোনো সম্ভাবনাই নেই। আর তেলেঙ্গানায় রাষ্ট্রীয় সমিতি সরকার বর্তমানে ক্ষমতায়। মুখ্যমন্ত্রী কেশিয়ার রাওয়ের বিরুদ্ধে তেলেগু দেশম পার্টি বাম সিপিএম-সিপিআই এবং কংগ্রেস জোটবদ্ধ হয়েছে। মিজোরামের ব্যাপারে আরএসএস-এর পর্যবেক্ষক রামমাধব প্রকাশ্যে ঘোষণা করেছেন, তারা যদি ৪০ আসন বিশিষ্ট মিজোরামের বিধানসভায় একটি আসনও পায় তবে তারা বাকি বিধায়কদের কিনে নেবেন। যে পদ্ধতিতে উত্তর-পূর্ব সীমান্তে মেঘালয়ে একটি আসন পেয়ে কংগ্রেসের ৩০টি আসন কিনে নিয়ে সরকার গঠন করেছে রামমাধব। তার সেই অস্ত্রই এখানে ব্যবহার করবেন। মমতা যেভাবে পশ্চিমবঙ্গে বিরোধীদের কেনাবেচা করেন বিজেপিও সে পথ ধরে এগোবেন বলে আগাম বলে রেখেছেন। রাজনৈতিক পন্ডিতদের আরও বিশ্বাস হিন্দিবলয়ে যদি তিনটি রাজ্য কংগ্রেস পুনর্দখল করতে পারে তাহলে ১৯ এপ্রিলে তারা দিল্লি­ দখল করতে পারবে।

এদিকে মোদির রাজনৈতিক কৌশল ফাঁস করে দিয়েছেন তার মন্ত্রিসভার দুজন প্রবীণ নেতা। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিং এবং সড়ক পরিবহন মন্ত্রী নিতিন গড়করি। এ দুজনই পৃথক পৃথকভাবে বিবৃতি দিয়ে বলেছেন, ২০১৪ সালের নির্বাচনে আমরা দেশবাসীর সামনে যে ভূরি ভূরি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম তা আমরা পালন করতে পারিনি। তারা স্বীকার করে নেন যে, তারা বুঝতে পারেননি যে তারা ক্ষমতায় আসবেন। সেই ভূরি ভূরি প্রতিশ্রুতি দেওয়া তাদের ঠিক হয়নি। একবার দেখা যাক তাদের প্রতিশ্রুতি কী ছিল। বছরে যেখানে তিন কোটি বেকার যুবক-যুবতীকে চাকরি দেওয়ার কথা সেখানে পৌনে পাঁচ বছরে মাত্র নয় লাখ লোকের চাকরি হয়েছে। প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল বিদেশি ব্যাংক থেকে ভারতীয়দের গচ্চিত কালো টাকা এনে প্রত্যেক ভারতবাসীকে ১৫ লাখ টাকা করে দেওয়া হবে। উল্টো দেখা গেল ভারত থেকে নরেন্দ্র মোদির আত্মীয়স্বজন কোটি কোটি টাকা বিদেশি ব্যাংকে নিয়ে গেছে। তাদের একজন নীরব মোদি। গড়করি আরও বলেছেন, ২০১৬ সালের নভেম্বর মাসে নোট বাতিল করার ফলে দেশে অনেক ছোট ও মাঝারি মাপের কল-কারখানা বন্ধ হয়ে গিয়ে বেকারের সংখ্যা আরও বেড়ে গেছে। পেট্রল-ডিজেলের দাম স্বাধীনতা-পরবর্তী সব থেকে উচ্চপর্যায়ে এসে পৌঁছেছে। যার ফলে অর্থনীতি আরও সংকটের মুখে এসে দাঁড়িয়েছে। সার্কের গোষ্ঠীভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে ভারতে পেট্রল-ডিজেলের দাম সবচেয়ে বেশি। বিদেশি মুদ্রা প্রচ-ভাবে ধাক্কা খাচ্ছে। এক মার্কিন ডলারের দাম এখন ৭৫ টাকা ছুঁইছুঁই। ২০১৪ সালে মনমোহন সিং যখন নির্বাচনের পর ক্ষমতা হস্তান্তর করেন মোদির কাছে তখন পেট্রল ছিল প্রতি লিটার ৫১ টাকা, আর ডিজেল ছিল ৪৭ টাকা। ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধির ফলে সারা দেশে চাষিরা মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়েছেন। চাষবাস আপাতত গভীর সংকটের মুখে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। এ তো গেল আর্থিক পরিস্থিতি।

এখন ভারতের রাজনৈতিক, প্রশাসনিক মহলে একটাই আলোচ্য বিষয়। তা হলো ফরাসি দেশ থেকে ৩৬টি যুদ্ধবিমান রাফেল কেনা নিয়ে। রাফেল ইসুকে সামনে এনেছেন কংগ্রেস সভাপতি রাহুল গান্ধী। তিনি ফ্রান্সের সাবেক রাষ্ট্রপতি ফ্রাঁসোয়া ওলাঁদের সঙ্গে কথা বলে জানতে পেরেছেন, মোদির ব্যক্তিগত উদ্যোগে তার বন্ধু অনিল আম্বানিকে যুদ্ধবিমান তৈরির বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। রাহুলের             মন্তব্যের পর এখন পর্যন্ত মোদি মুখ খোলেননি। মোদির গোয়েবলসরা টিভির পর্দায় প্রতিনিয়ত মোদি ও আম্বানির পক্ষে নানা যুক্তি-তর্ক দেখাচ্ছে। বিশেষ করে আম্বানি গোষ্ঠীর বিভিন্ন কোম্পানির যারা অভ্যন্তরীণ অডিট করেন তাদের কেউ কেউ মোদির মন্ত্রিসভায় আছেন। তারা হলেন- পীযূষ গোয়েল, প্রতিরক্ষামন্ত্রী শ্রীমতি নির্মলা সীতারামন। এদের দুজনেরই নিজস্ব চার্টার্ড ফার্ম আছে। এরা অনিল আম্বানির অডিট করেন। পীযূষ গোয়েলের চার্টার্ড ফার্ম আছে বোম্বেতে। নির্মলা সীতারামন ও তার স্বামীর বোম্বে, দিল্লি­ আর মহারাষ্ট্রে নিজেদের চার্টার্ড ফার্ম আছে। বাংলাদেশের পাঠকদের অনেকেই হয়তো আম্বানিদের নাম শুনেছেন। কিন্তু কে এই আম্বানি। তার একটু পরিচয় দেওয়া যাক। গুজরাটের পেট্রলপাম্পের ব্যবসায়ী ধিরুভাই আম্বানির দুই ছেলে। বিগত শতকের ৮-এর দশকে এক কংগ্রেসী অর্থমন্ত্রীর দক্ষিণ্যে ফুলে-ফেঁপে ওঠে। পিতার অকালমৃত্যুর পর সম্পত্তি দুই ভাইয়ের মধ্যে ভাগ হয়ে যায়। বড়ভাই মুকেশ আম্বানি ও ছোটভাই অনিল আম্বানি। দুই ভাইয়ের মধ্যে কোনো ভাইয়েরই যুদ্ধবিমান তৈরি করার অভিজ্ঞতা ছিল না।

ভারতে স্বাধীনতার পর থেকে যুদ্ধবিমান তৈরি করত ‘হল’ অর্থাৎ হিন্দুস্তান অ্যারোমেটিক লিমিটেড, এটি একটি সরকারি সংস্থা। তাদের বরাদ্দ না দিয়ে ব্যাংকের কাছে ঋণ আছে অনিল আম্বানির ৫৫ হাজার কোটি টাকা, তবুও তাকে কেন বরাদ্দ দেওয়া হলো, এই প্রশ্ন রাহুল গান্ধীর। রাহুল গান্ধীর সঙ্গে সুর মিলিয়ে বিভিন্ন রাজ্যের আঞ্চলিক দলগুলোর নেতারা দাবি তুলেছেন, মোদির পদত্যাগের। রাহুল আরও বলেছেন, মোদি প্রধানমন্ত্রী হয়ে ঘোষণা করেছিলেন তিনি চৌকিদার। তিনি দেশকে রাত জেগে পাহারা দেবেন। এখন তিনি অনিল আম্বানির চৌকিদার। তারও একটি দুর্নীতি সামনে এসেছে। সম্প্রতি নিম্ন আয়ের লোকদের জন্য পাঁচ লাখ টাকার জীবনবীমা করার প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। এই জীবনবীমার দায়িত্ব সরকারি বীমা কোম্পানিকে না দিয়ে অনিল আম্বানিকে দেওয়া হয়েছে কেন? এর কোনো উত্তর নেই। শুধু আঞ্চলিক দলগুলোর নেতারা এ নিয়ে সারা দেশের রাস্তায় নেমে পড়লেও পশ্চিমবঙ্গের ‘বঙ্গেশ্বরী’ প্রকাশ্যে ঘোষণা করেছেন, তিনি মোদির দুর্নীতির বিরুদ্ধে টুঁ-শব্দ করবেন না। কারণ কী? নেপথ্যে কারণ হলো বিজেপির সঙ্গে ১৯৯৮ সাল থেকে তার গোপন আঁতাত চলছে। পশ্চিমবঙ্গে তার যে দুর্নীতি সামনে এসেছে যেমন সারদা, নারদা, রোজভ্যালিসহ শত শত চিটফান্ড। যার অলিখিত মালিক মমতা এবং তার ভাইয়ের ছেলে অভিষেক। এসব দুর্নীতির বিরুদ্ধে মোদি যদি মমতা ও তার পরিবারের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেন সে জন্য তিনি মোদির পক্ষেই সওয়াল করছেন। মোদি সরকার ইতিমধ্যে বিভিন্ন অবিজেপি রাজ্যের মন্ত্রীদের হেনস্তা করার জন্য আয়করসহ বিভিন্ন সংস্থাকে কাজে লাগিয়েছে।

প্যারিসের সংবাদপত্রগুলো এই রাফেল চুক্তি নিয়ে যেসব তথ্য ফাঁস করে দিয়েছে তাতে শুধু ভারতবর্ষ নয়, বিভিন্ন দেশের সংবাদমাধ্যম মোদিকে দুর্নীতিবাজ আখ্যা দিতে শুরু করে দিয়েছে। হঠাৎ করে ফরাসি মিডিয়াকে ম্যানেজ করার জন্য প্রতিরক্ষামন্ত্রী নির্মলা সিতারাম প্যারিসে ছুটে গেছেন। এ দিকে রাফাল চুক্তি সম্পর্কে মুখ খুলেছে ফ্রান্সের সংবাদমাধ্যম মিডিয়াপার্ট। রাফাল প্রস্তুতকারী সংস্থার অন্যতম কর্তা ডাসটল্ট জানিয়েছেন, রাফাল চুক্তির শর্তেই ছিল যে, যৌথ উৎপাদনকারী সংস্থা হিসেবে অনিল আম্বানির সংস্থাকেই ভারত থেকে নিতে হবে। ওই শর্ত না মানলে রাফাল কন্ট্রাক্ট তারা হাতেই পেত না। এই পরিস্থিতিতে বিতর্কে ইন্ধন জুগিয়েছে সিতারামনের ফ্রান্স সফর। দুই দেশের স্ট্যাটেজিক সম্পর্ক ঠিক রেখে একটা কিছু সমঝোতা চূড়ান্ত করবেন তিনি। ৩৬টি যুদ্ধবিমান কবে থেকে সরবরাহ করা হবে সে নিয়েও বৈঠক করবেন। এদিকে প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞ অজয় শুক্লা এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী মোদি এ চুক্তি সম্পাদনের সময় অনিল আম্বানিকে নিজের বিমানে করে ফ্রান্স নিয়ে গিয়েছিলেন। পাশে বসিয়ে মোদি বলেছিলেন রাফাল যুদ্ধ বিমানের দাম বাড়িয়ে দিচ্ছি। এই চুক্তি করব, অনিল আম্বানিকে দিন। এ থেকে কী প্রমাণ হয় না, মোদি ব্যক্তিগত উদ্যোগে অনিল আম্বানিকে যে টাকা পাইয়ে দিয়েছে তার একটা বড় অংশ মোদির পকেটে এসেছে।

এখন ভারতবর্ষের রাজনীতি ও আসন্ন নির্বাচনের একমাত্র ইস্যু হলো রাফাল। রাফাল যুদ্ধ বিমানের জন্য ঘুষ নিয়েছে। এখন দেখা যাচ্ছে, চৌকিদারই আসল চোর। তাই ভারতবর্ষে একটি নতুন স্লোগান উঠেছে ‘অলিগলি মে শোর হ্যায়, মোদি চোর হ্যায়’। রাজনৈতিক কর্মীরা আপাতত উৎসবমুখর। নেতারা চুপ করে বসে নেই। তারা বলছেন, ভারতের সংবিধানের মুখবন্ধে আছে, ‘গভর্নমেন্ট ফর দ্য পিপল, বাই দ্য পিপল অ্যান্ড অব দ্য পিপল’। এখন দেখা যাচ্ছে মোদি জমানায় সংবিধানের টুঁটি টিপে একটি নতুন স্লোগান তিনি বসাতে চাইছেন ‘দেশের জনগণের জন্য সরকার নয়, সরকার শুধু অনিল আম্বানির জন্য’। রাজনৈতিক পন্ডিতের কোনো কোনো মহল মনে করে, ১৯৭৭ সালে জরুরি অবস্থার পর কংগ্রেসের যে হাল হয়েছিল মোদিরও সেই একই হাল হবে। তিনি বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রের ১০০ কোটি মানুষকে মিথ্যা প্রতিশ্র“তি দিয়ে ক্ষমতায় এসেছেন। ১০০ কোটি মানুষকে বাদ দিয়ে তার কাছে আছে শুধু অনিল আম্বানি। ভারতের সবচেয়ে ধনী ব্যবসায়ী তার দাদা মুকেশ আম্বানি ছোট ভাইয়ের এই অপকর্মের দায়ভার নিতে অস্বীকার করেছেন। ভারতের ব্যবসায়ী মহলের প্রতিক্রিয়া হলো ছেলেবেলা থেকে শুনে এসেছি ভারতের ব্যবসায়ী বলতে এক সময় বোঝাত টাটা, বিড়লা, গোয়েঙ্কা। গোটা ভারতবর্ষ এখন পরিচালনা করে অনিল আম্বানি, গৌতম আদানিসহ গুজরাটের ডজনখানেক ব্যবসায়ী। সাধারণ মানুষের এখন নাভিশ্বাস। আগেই উল্লে­খ করেছি, পেট্রল-ডিজেলের দাম বাড়ার ফলে পরিবহন ব্যবস্থা সংকটের মুখে। কোথায় সংকট নেই, যেদিকেই তাকানো যায় সংকট আর সংকট। ভারত যেন আগ্নেয়গিরির আসনে বসে আছে। যে কোনো সময় বিস্ফোরণের আশঙ্কা প্রবল। এই বিস্ফোরণ ঠেকানোর জন্য এখন দরকার ভারতবাসীর একজোট হয়ে মোদির বিরোধিতা করা এবং ভারতের মসনদ থেকে মোদিকে হটানো। এই বিরোধিতার কাজটি কংগ্রেস সভাপতি রাহুল গান্ধী শুরু করে দিয়েছেন।

            লেখক : ভারতীয় প্রবীণ সাংবাদিক।

সর্বশেষ খবর