বুধবার, ১৭ অক্টোবর, ২০১৮ ০০:০০ টা

দুর্দিনের দুঃসাহসী নেতা আবদুল মালেক উকিল

মো. মহিউদ্দিন টুকন

দুর্দিনের দুঃসাহসী নেতা আবদুল মালেক উকিল

বঙ্গবন্ধুর বিশ্বস্ত সহচর, মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক, জাতীয় সংসদের সাবেক স্পিকার ও স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রিপরিষদ সদস্য এবং বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতি আবদুল মালেক উকিলের আজ ৩১তম মৃত্যুবার্ষিকী। আবদুল মালেক উকিলের মতো নেতারা সংগঠনের দুর্দিনে বঙ্গবন্ধুর সংস্পর্শে এসে দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে জেল-জুলুমের ভয়কে উপেক্ষা করে আওয়ামী লীগের জন্য কাজ করেছেন। বহুবার বহু হামলা ও মামলার মুখোমুখি হয়ে কারান্তরালে দিন কাটিয়েছেন, কিন্তু বঙ্গবন্ধু ও তাঁর সংগঠনের সঙ্গে বেইমানি করেননি। ওই সময়ে আবদুল মালেক উকিল গ্রামগঞ্জে সংগঠনের কাজ করে, কাজের ধারাবাহিকতায় নোয়াখালী সদর মহকুমা ও জেলা পর্যায় থেকে আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য ও সর্বশেষ বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতি হওয়ার মতো গৌরব লাভ করেছেন। তার মৃত্যুর ৩১টি বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পর তার সহকর্মীদের মধ্যে অনেকেই মৃত্যুবরণ করেছেন। আজ তার মতো এমন নেতার বড়ই অভাব। দলের অনেক নব্য নেতার স্মৃতি থেকে ‘মালেক উকিল’ হারিয়ে গেলেও সংগঠনের তৃণমূল পর্যায়ের নেতা-কর্মীরা মালেক উকিলদের মতো নেতাদের আজও ভুলে যাননি। আবদুল মালেক উকিল দুবার (স্বাস্থ্য ও স্বরাষ্ট্র) মন্ত্রিপরিষদ সদস্য ও জাতীয় সংসদের স্পিকারের দায়িত্ব পালনে সততা ও দক্ষতার পরিচয় দিয়ে দেশ ও জাতির সেবা করতে গিয়ে কখনো নিজের ব্যক্তিগত ও পরিবারের ভবিষ্যৎ ভোগবিলাস ও অর্থসম্পদ অর্জনের চিন্তা করেননি। অন্যদিকে দলের অনেক নেতা-কর্মীর সন্তানকে ডেকে নিয়ে সংশ্লি­ষ্ট মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন বিভাগে চাকরি দিয়ে তাদের ভবিষ্যৎ জীবনে আলোর সন্ধান জুগিয়েছিলেন।

বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর সেনাশাসনের দুঃসময়ে আওয়ামী লীগকে ভাঙনের চক্রান্ত প্রতিহত করে ১৯৭৮ সালের ৫ মার্চ অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ১৪তম জাতীয় সম্মেলনে দলের ঐক্যের প্রতীক হিসেবে তিনি আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। পরে তার কাছ থেকেই ’৮১ সালে দলের ১৫তম জাতীয় সম্মেলনে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন।

১৯৬৮ সালের ৩ জানুয়ারি ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে গভীর রাতে কিছু সেনা কর্মকর্তা যখন শেখ মুজিবকে সেনানিবাসের নির্জন কক্ষে নিয়ে দীর্ঘদিন আটক রেখেছিল, ঠিক সেই সময় পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের বিরোধীদলীয় নেতা হিসেবে প্রদত্ত বক্তব্যে গভর্নর মোনায়েম সরকারের কাছে তিনি জানতে চেয়েছেন, ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে রাতের গভীরে বাঙালির প্রিয় নেতা শেখ মুজিবকে কোথায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে বাংলার মানুষ জানতে চায়? যে সময় শেখ মুজিবের নাম নেওয়ার মতো কারও সাহস ছিল না, সে সময় মালেক উকিলের ওই বক্তব্য বিবিসিতে প্রচার হওয়ার পরদিন পাকিস্তান সরকার প্রেস নোটের মাধ্যমে শেখ মুজিবের অবস্থান সম্পর্কে দেশবাসীকে অবহিত করতে বাধ্য হয়েছিল।

আজ অনেকে বঙ্গবন্ধুর কথা বলে মায়াকান্নায় ভেঙে পড়ে। অথচ দুঃসময়ে মালেক উকিলের মতো নেতারাই ছিল শেখ মুজিবের সাহসী সহচর। আবদুল মালেক উকিল ১৯৬১ সালে নোয়াখালী সদর মহকুমা (তৎকালীন) আওয়ামী লীগের সভাপতি ও ’৬৩ থেকে ’৭২ সাল পর্যন্ত বৃহত্তর নোয়াখালী জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। একই সময় বঙ্গবন্ধু তাকে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী কমিটি ও সংগঠনের পার্লামেন্টারি বোর্ডের সদস্য মনোনীত করেন। ’৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে আবদুল মালেক উকিল স্বাধীনতার পক্ষে আন্তর্জাতিক জনমত গঠনের লক্ষ্যে মুজিবনগর সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে নেপাল, থাইল্যান্ড, জাপান ও মালয়েশিয়া সফর করেন।

স্বাধীনতার পরও আবদুল মালেক উকিল বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধি দলের নেতা হিসেবে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ সফর করেন। এ ছাড়া ব্যক্তিগতভাবে ও আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে তিনি বহু আন্তর্জাতিক সংস্থার সম্মেলন এবং সেমিনারে যোগদান করেন। বিদেশের বহু গণমাধ্যমে তার সাক্ষাৎকার ও বক্তব্যের ধারাবিবরণী প্রচারিত হয়। পেশাগত জীবনে একজন আইনজীবী হিসেবে আবদুল মালেক উকিল কুখ্যাত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলাসহ অসংখ্য রাজনৈতিক মামলা পরিচালনায় দক্ষতার পরিচয় দিয়েছিলেন। ১৯৮৭ সালের ১৭ অক্টোবর আবদুল মালেক উকিল চিকিৎসাধীন অবস্থায় ৬৩ বছর বয়সে ঢাকায় ইন্তেকাল করেন।

লেখক : সাবেক সাধারণ সম্পাদক, নোয়াখালী প্রেস ক্লাব।

সর্বশেষ খবর