সোমবার, ২৬ নভেম্বর, ২০১৮ ০০:০০ টা

আসন্ন নির্বাচন ও সম্প্রীতির বাংলাদেশ

মেজর জেনারেল এ কে মোহাম্মাদ আলী শিকদার পিএসসি (অব.)

আসন্ন নির্বাচন ও সম্প্রীতির বাংলাদেশ

আসন্ন জাতীয় নির্বাচন বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পূর্বের যে কোনো নির্বাচনের চাইতে এই নির্বাচনটি অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ এ কারণে যে, ১৯৭৫ সালে জাতির জনকের হত্যার সুবিধাভোগী হিসেবে নতুনভাবে আবির্ভূত রাজনৈতিক পক্ষের হাত ধরে রাজনীতি ও রাষ্ট্র ব্যবস্থার মধ্যে যে চরম সাম্প্রদায়িকতার সৃষ্টি হয় এবং পরবর্তীতে সেটি যে রকম দানবীয় রূপ নেয় তার থেকে রাজনীতি ও রাষ্ট্রকে বের করার একটা বড় সুযোগ এখন বাংলাদেশের মানুষের সামনে উপস্থিত। রাজনীতি হচ্ছে সব নীতির ঊর্ধ্বে, অর্থাৎ চূড়ায় বসে আছে, যেখান থেকে উৎপত্তি হয় সংবিধান, যাকে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইন বলা হয় এবং সেখান থেকেই তৈরি হয় রাষ্ট্র পরিচালনার আইন, নীতিমালা এবং এগুলো সব কিছু মিলে সামগ্রিকভাবে তৈরি করে জাতীয় দৃষ্টিভঙ্গি,  অর্থাৎ গণমানুষের মানসকাঠামো। সুতরাং রাজনীতিতে যদি সাম্প্রদায়িকতা থাকে, ধর্মাশ্রয়ী রাজনীতি থাকে তাহলে কিছুতেই আমরা অসাম্প্রদায়িক এবং সম্প্রীতির রাষ্ট্র ও সমাজ গড়তে পারব না। মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি, মানসতন্ত্র যদি সহায়ক না হয় তাহলে আইন দিয়ে, পুলিশ দিয়ে কখনোই লক্ষ্য অর্জন করা যাবে না। এ ভূখ-ে, বর্তমান বাংলাদেশে হাজার বছর ধরে মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ,  খ্রিস্টান, চাকমা, সাঁওতালসহ সব ধর্ম-বর্ণ এবং জাতি-উপজাতি একসঙ্গে সম্প্রীতি বজায় রেখে বসবাস করে আসছে বলেই সব স্রোত এক জায়গায় এসে মিলিত হয়ে বাঙালি সংস্কৃতিকে করেছে সমৃদ্ধ ও শক্তিশালী। আমাদের মুক্তিসংগ্রাম,  মুক্তিযুদ্ধ এবং একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর অভূতপূর্ব বিজয় অর্জনে এককভাবে যে উপাদানটি সবচাইতে বড় ভূমিকা রেখেছে তা হলো বাঙালি সংস্কৃতির শক্তি। আর বাঙালি সংস্কৃতির মূলকথা হলো অসাম্প্রদায়িকতা এবং সম্প্রীতি। এটা না থাকলে বাংলাদেশ থাকে না। বাংলাদেশের নামের খোলসে হয়তো সেটি অন্য কিছু হয়ে যায়। আমাদের মহান নেতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালি জাতির হৃদয় স্পর্শ করে বুঝতে পেরেছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশের অস্তিত্ব, উন্নতি, মর্যাদা এবং শক্তির অন্যতম অবলম্বন হবে বাঙালি সংস্কৃতিপ্রসূত অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র নীতি। তাই তিনি স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানের অন্যতম মৌলিক আদর্শ হিসেবে সন্নিবেশিত করলেন বাঙালি জাতীয়তাবাদ এবং ধর্মনিরপেক্ষতা। সংবিধানে সুনির্দিষ্ট ধারা যোগ করে রক্ষাকবচ তৈরি করলেন যাতে ধর্মাশ্রয়ী রাজনীতি কেউ আর বাংলাদেশে করতে না পারে। কিন্তু তারপর ১৯৭৫ সালে কী ঘটে গেল তা আমরা সবাই জানি। পঁচাত্তরের পর দীর্ঘ সময় ধরে একটা নিকষ কালো অন্ধকার যুগের চিত্র আমরা দেখেছি। পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ সংবিধান, আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ফসলকে সামরিক  আদেশ দ্বারা ভেঙেচুরে তছতছ এবং ধ্বংস করে ফেলা হলো। ফিরে এলে চরম ধর্মাশ্রয়ী রাজনীতি।

সেই রাজনীতি থেকে সৃষ্টি হলো রাষ্ট্রযন্ত্রের মধ্যে ধর্ম-বর্ণের বৈষম্য। মানুষ কেমন যেন সব বদলে গেল। ব্যক্তি স্বার্থে, সহায় সম্পত্তির লোভে প্রতিদিনের প্রতিবেশী, বিপদ আপদে এতদিনের আপনজন পর হয়ে গেল শুধুমাত্র ধর্মের বিবেচনায়। এগুলো আবার রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতাও পেল। এসব বাংলাদেশের জন্য কত বড় ট্র্যাজেডি, বেদনাদায়ক এবং বিপজ্জনক একবার ভেবে দেখুন। ২০০১ সালের নির্বাচনোত্তর সময়ে নির্বাচনে জয়ী হওয়া সদ্য ক্ষমতায় আরোহনকারী  দলের ক্যাডার বাহিনী            কর্তৃক সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর পরিচালিত সেই তা-ব কিছুতেই বাঙালি ও বাংলাদেশের সংস্কৃতির সঙ্গে যায় না। ২০০১ সালের ১৩ নভেম্বর বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান ইংরেজি দৈনিকে খবর ছাপা হয়, ২০০১ সালের নির্বাচনের পরপর ভোলার চরফ্যাশনে এক রাতে ২০০ হিন্দু মহিলাকে নির্বাচনে বিজয়ী দলের ক্যাডার বাহিনী ধর্ষণ করে। ২০০৩ সালের ২৩ নভেম্বর বিশ্বের খ্যাতনামা পত্রিকা ‘দ্যা ইকোনমিস্ট হেডলাইন করে,  In Bangladesh religious minorities are safe only in the departure Lounge. ১৯৭৫ সালে জাতির জনকের হত্যার পর প্রথম সামরিক শাসক, বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জেনারেল জিয়াউর রহমান হাত ধরে নিষিদ্ধ হওয়া সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী রাজনীতিতে পুনঃপ্রবেশের সুযোগ পায় এবং সেই পথ ধরেই রাজনীতি হয়ে ওঠে বিষময়। সেই বিষময় রাজনীতির কুফল, বলা যায় ভয়ঙ্কয় কুফল বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বের মানুষ দেখছে জামায়াত-বিএনপি শাসনের ২০০১-২০০৬ মেয়াদে। তারপর ২০১৪ সালে ৫ জানুয়ারিতে নির্বাচন প্রতিহত করার নামে ওই ধর্মাশ্রয়ী রাজনৈতিক পক্ষ জামায়াত-বিএনপি সংঘবদ্ধভাবে সংখ্যালঘুদের টার্গেট করে কী দানবীয় কর্মকা- করেছে তা কারও ভুলে যাওয়ার কথা নয়। প্রসঙ্গক্রমে ছোট একটি ঘটনার কথা উল্লে­খ করি। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচন প্রতিহত করার নামে তারা সংঘবদ্ধ হয়ে আক্রমণ চালায় দেশের বিভিন্ন স্থানে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর, যার মধ্যে যশোরের অভয়নগর উপজেলার চাঁপাতলা গ্রামের মালোপাড়ার ঘটনায় সারা বিশ্বের মানুষের হৃদযন্ত্রে ভূমিকম্পের সৃষ্টি হয়। ২০১৪ সালের ৬ জানুয়ারি বাংলাদেশের পত্রিকাগুলোর প্রথম পৃষ্ঠার সেই হৃদকম্প সৃষ্টিকারী শত শত ছবির মধ্যে শুধুমাত্র একটি ছবির দিকে একবার তাকান, সব পরিষ্কার হয়ে যাবে। মধ্যবয়সী সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের এক নারী, আড়াই-তিন বছরের ক্ষুধার্ত একটি ছেলে শিশুকে কোলে নিয়ে অঝোরে কাঁদছে। কাঁদছে শিশুটিও। পাশের ছবিতে দেখা যাচ্ছে তাদের অগ্নিদগ্ধ বিধ্বস্ত ঘরের ছবি। ঘরের সামান্য খাবারও পুড়ে ছাই। মা নিজে অভুক্ত। কোলে ক্ষুধার যন্ত্রণায় কাঁদছে সন্তান। ক্ষুধার্ত সন্তানের মুখে মা এক লুকমা খাবার দিতে পারছে না। একবার ভেবে দেখুন এই নারী ও শিশুটি যথাক্রমে হতে পারত আপনার, আমার মা, বোন, স্ত্রী। ওই ছেলেটি হতে পারত আমাদের কারও ছোট ভাই, সন্তান বা নাতি। তাহলে এ দৃশ্য কি আপনি সহ্য করতে পারতেন। সুতরাং নিশ্চয়ই এ দৃশ্যের আর পুনরাবৃত্তি আপনি চাইবেন না। এমন মর্মদন্ত দৃশ্য দেখার পর আমরা সবাই কি নির্লিপ্ত থাকব, নাকি যে ধর্মাশ্রয়ী রাজনীতির পরিণতিতে এসব ঘটছে তার থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার জন্য           অন্তত আমাদের ভোটাধিকারটি সঠিকভাবে প্রয়োগ করব। একাত্তরে ৩০ লাখ মানুষের জীবন বিসর্জনের লক্ষ্য অর্জনে নতুন প্রজম্মে র সবারই দায়িত্ব রয়েছে। একাত্তরের শহীদেরা তখন তাদের বর্তমান বিসর্জন দিয়ে গেছে শুধুমাত্র তোমাদের, অর্থাৎ নতুন প্রজম্মে র ভবিষ্যৎকে উজ্জ্বল করার জন্য। মালোপাড়ার  ওই মায়ের কান্না তো আমরা একাত্তরে দেখেছি। ওই দানবের হাত থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্যেই তো এত ত্যাগ, এত রক্ত ঝরানো। তাই ২০১৮ সালের নির্বাচনকে সামনে রেখে সবাইকে একবার ভাবতে হবে, সেই পরাজিত দানব আবার কী করে, কী প্রক্রিয়ায়, কোন রাজনৈতিক পক্ষের আনুষ্ঠানিক পৃষ্ঠপোষকতায় শক্তি সঞ্চয় করেছে এবং স্বাধীনতার ৪৭ বছর পরে এসেও পুনরায় বাংলা মায়ের চোখের পানি ঝরাচ্ছে। আমাদের জাতীয় সংগীতের হৃদয়স্পর্শী সেই দুটি লাইন কী করে আমরা ভুলে যাব-‘মা তোর বদনখানি মলিন হলে/আমি নয়ন জলে ভাসি’। আসুন, আপনার একটা ভোটেই হতে পারে মহা মূল্যবান, ডিসাইডিং ফ্যাক্টর। এই দানবীর শক্তি ও তার প্রশ্রয়কারীদের একটা শক্ত না বলে দিন। এটাই হবে আজ সবার পবিত্রতম দায়িত্ব। মায়ের প্রতি প্রকৃত ভালোবাসা ও ভক্তির প্রকাশ। এই চোখের পানি আর কোনো দিন আমরা দেখতে চাই না।  আলোচ্য ধর্মাশ্রয়ী রাজনীতির হাত ধরে ও পৃষ্ঠপোষকতায় উগ্র, ধর্মান্ধ জঙ্গিগোষ্ঠীর ভয়ঙ্কর উত্থান হয় ২০০১-২০০৬ মেয়াদে, জামায়াত-বিএনপির শাসনামলে। তখন রাজশাহীতে বাংলা ভাই নামের এক জঙ্গি নেতা রাষ্ট্রযন্ত্রকে চ্যালেঞ্জ দিয়ে নিজ শাসন চালু করে দিল। তার বিরুদ্ধবাদী মানুষকে হত্যা করে লাশ উল্টো করে গাছের সঙ্গে ঝুলিয়ে রাখল। তৎকালীন জামায়াত-বিএনপি সরকারের ক্রিয়া দেখে সবার মনে হয়েছে এটা বোধহয় কোনো বিষয়ই না। বরং তৎকালীন রাজশাহীর পুলিশ সুপার ওই জঙ্গি নেতা বাংলা ভাইকে প্রকাশ্য দিবালোকে সংবর্ধনা দেন। যার ফলে তখন ওই ধর্মাশ্রয়ী উগ্রবাদী গোষ্ঠীর আরও অনেক বাড়-বাড়ান্ত দেখা যায়। রাষ্ট্রের আদালতের ওপর গ্রেনেড-বোমা মেরে রক্তাক্ত করতে থাকে। কর্তব্যরত পুলিশকে তখন অসহায়ের মতো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সেগুলোকে শুধু দেখতেই হয়েছে। এই হলো অতি সংক্ষেপে ধর্মাশ্রয়ী রাজনীতির স্বল্পকিছু বিভৎসতার উদহারণ। কিন্তু বাংলাদেশ আবার ঘুরে দাঁড়িয়েছে। গত প্রায় ১০ বছর বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে অসাম্প্রদায়িক ও মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের ওপর দেশ পরিচালিত হচ্ছে বিধায় রাজনীতি ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে অভূর্তপূর্ব অগ্রগতির সঙ্গে বহুল আকাক্সিক্ষত সম্প্রীতির বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পথেও অনেক দূর আমরা এগিয়েছি। তবে এর মধ্যেও  দুয়েকটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু সরকার অত্যন্ত ত্বরিত গতিতে তার পরিপূর্ণ প্রতিকার করতে সক্ষম হয়েছে। রাজনৈতিক অঙ্গনে ধর্মাশ্রয়ী রাজনীতি ও উগ্রবাদী ধর্মান্ধ গোষ্ঠী পিছু হটতে বাধ্য হয়েছে, কোণঠাসা হয়ে এলোমেলো অবস্থায় আছে। উগ্র ধর্মান্ধ গোষ্ঠীর একটি বড় অংশ নিজেদের ভুল বুঝতে পেরে উগ্রবাদ ত্যাগ করে চিরন্তন শান্তির পথে ফিরে আসতে শুরু করেছে। এই অবস্থায়  আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় নির্বাচন এখন দোরগোড়ায়। জাতি, ধর্ম, বর্ণ, দলমত নির্বিশেষে বাংলাদেশের মানুষের জন্য পবিত্রতম দায়িত্ব পালনের সময় উপস্থিত। আসুন, ধর্মাশ্রয়ী রাজনীতির কবল থেকে বাংলাদেশকে স্থায়ীভাবে মুক্ত করার জন্য আমরা সবাই আমাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করি। বাঙালি সংস্কৃতি ও মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ বিরোধী এবং সাম্প্রদায়িক পক্ষ ও ব্যক্তিকে আমরা কেউ ভোট দিব না, এই প্রতিজ্ঞায় সবাই অবদ্ধ হই। আপনার একটি ভোটই হতে পারে অতি মূল্যবান। বাংলাদেশকে ফিরিয়ে আনতে পারে তার আপন জায়গায়।

লেখক : রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লে­ষক।

[email protected]

সর্বশেষ খবর