সোমবার, ২৬ নভেম্বর, ২০১৮ ০০:০০ টা

কিছুতেই শৃঙ্খলা ফিরছে না সড়কে

তপন কুমার ঘোষ

কিছুতেই শৃঙ্খলা ফিরছে না সড়কে

যদি প্রশ্ন করা হয়, রাজধানী ঢাকাবাসীর প্রধান সমস্যা কী? এ প্রশ্নের বোধ করি একটাই জবাব ভয়াবহ যানজট। একটা সময় ছিল যখন বিদ্যুৎ, নিরাপদ পানি ও গ্যাসের অভাব ছিল রাজধানীবাসীর প্রধান সমস্যা। বিদ্যুৎ ও পানির সমস্যা এখন অতীতের বিষয়। বিগত এক দশকে বিদ্যুৎ খাতে বিস্ময়কর সাফল্য অর্জন করেছে বাংলাদেশ। পত্রিকায় পড়লাম, এক দশকে বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা বেড়েছে চারগুণ। বিশুদ্ধ পানির জন্য হাহাকার এখন আর নেই। রাজধানীর কোনো কোনো এলাকায় গ্যাসের কিছুটা ঘাটতি আছে, এটা ঠিক। কিন্তু অধুনা যে সমস্যাটা ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে, তা হচ্ছে যানজট। যানজটে নাকাল ঢাকাবাসী।

ঢাকার যানজট নিয়ে সংবাদ মাধ্যমে আলোচনা ও লেখালেখি কম হয়নি। এটা অনেকটা রুটিন ওয়ার্কে পরিণত হয়েছে। অনেকে আক্ষেপ করে হতাশার সুরে বলেন, লেখালেখি করে কী লাভ? যানজটের কারণগুলো আজ আর কারও অজানা নয়। প্রধান কারণ হচ্ছে ট্রাফিক আইন না মানার প্রবণতা। অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী সম্প্রতি নিরাপদ সড়কবিষয়ক এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, ‘পৃথিবীতে আইন অমান্যকারী দেশের মধ্যে বাংলাদেশ শীর্ষে। সেটি যে কোনো ক্ষেত্রেই হোক। অথচ আমাদের দেশের মানুষ বিদেশে গেলে ঠিকই আইন মেনে চলছেন। এ জন্য চাই সচেতনতা এবং আইন মানার প্রবণতা বাড়ানো।’ আমাদের দেশের সাধারণ মানুষের কথা না হয় বাদই দিলাম। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে যারা আইন প্রণয়ন করেন বা আইন প্রয়োগ করেন তাদের সবাই না হলেও কারও কারও মাঝে ট্রাফিক আইন অমান্য করার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়।

নিরাপদ সড়কের দাবিতে এ বছরের মাঝামাঝি সময়ে ঢাকার শিক্ষার্থীরা হঠাৎ করে আন্দোলন শুরু করে। ঘটনাচক্রের সূচনা হয়েছিল ২৯ জুলাই রাজধানীর বিমানবন্দর সড়কে গাড়িচাপায় দুই কলেজ শিক্ষার্থী নিহত হওয়ার জের ধরে। শিক্ষার্থীদের এ আন্দোলন তখন আলো ছড়িয়েছিল। চেতনার আলো। পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ সবারই জানা। সড়কে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে নানামুখী উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। ব্যাপক প্রচার-প্রচারণা চালানো হয়। বিশেষ ট্রাফিক সপ্তাহ এবং সচেতনতা মাস পালন করা হয়। এতসব উদ্যোগের ফলে দিন কয়েক ট্রাফিক ব্যবস্থার কিছুটা উন্নতি হলেও কিছুদিনের মধ্যেই নিভে যায় সেই আলো। ‘যথা পূর্বং তথা পরং’। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ প্রতিদিনের এক সম্পাদকীয়তে যথার্থই মন্তব্য করা হয়, চেতনার সেই আলোকে এখন ‘আলেয়া’ বলেই মনে হচ্ছে।

সড়কে বাসের রেষারেষি চলছেই। দুই বাসের মাঝে চাপাপড়ে প্রাণ হারাচ্ছেন পথচারী। নির্দিষ্ট স্টপেজে থামছে না গণপরিবহনগুলো। যাত্রী দেখলেই যত্রতত্র থেমে যাচ্ছে বাস। যাত্রীরাও রাস্তার মাঝে ঝুঁকি নিয়ে ওঠানামা করতে বাধ্য হচ্ছেন। মাত্র একজন চালক ও একজন সহকারীর কাছে বাসভর্তি যাত্রীরা জিম্মি। এরা দুজন রাজা-উজির বনে যান। যাত্রীরা সব প্রজা। মোবাইল ফোনে কথা বলতে বলতে গাড়ি চালাচ্ছেন চালক। যাত্রীরা নিষেধ করলেও সেদিকে কর্ণপাত করেন না। কাছেই পদচারী সেতু। কিন্তু সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই পথচারীদের। ঝুঁকি নিয়ে সড়ক বিভাজকের কাঁটাতারের বেড়া টপকে সড়ক পার হচ্ছেন। ধেয়ে আসছে বাস। চলন্ত বাসের সামনে হাত উঁচিয়ে বিপজ্জনকভাবে দৌড়ে রাস্তা পার হচ্ছেন পথচারীরা। মোটেও তর সয় না মোটরসাইকেল চালকদের। ফাঁকফোকর গলিয়ে সামনে এগোনোর দুরন্ত চেষ্টা। রাজধানীর সড়কে এসব দৃশ্য নিত্যদিনের। এতকিছুর পরও আমাদের যে চৈতন্যোদয় হয়নি, এসব ঘটনা তারই প্রমাণ।

আমরা নিজেদের সভ্য বলে দাবি করি। শিক্ষিত মানুষ নাকি সচেতন হয়। কিন্তু আমাদের আচার-আচরণে তার প্রমাণ মেলে কি? আমাদের অনেকেরই সামান্য সিভিক সেন্স পর্যন্ত নেই। কীভাবে পথ চলতে হয় তা-ও শেখা হয়নি। ফুটপাথ-সড়ক হকারদের দখলে। সকালে উচ্ছেদ করলে বিকালে আবার দখল হয়ে যাচ্ছে। ফুটপাথ দখল করে আমরা দোকানপাট বসাব। ফুটপাথে গাড়ি রেখে দেব। সুযোগ পেলেই ফুটপাথে মোটরসাইকেল তুলে দেব। জেব্রা ক্রসিংয়ের ওপর গাড়ি দাঁড় করিয়ে রাখব। উল্টোপথে গাড়ি হাঁকাব। যত্রতত্র গাড়ি পার্কিং করব। ঘন ঘন গাড়ির লেন পরিবর্তন করব। ফুটপাথে-সড়কে আবর্জনার স্তূপ জমিয়ে রাখব। আর সব কিছুর জন্য সরকারকে দুষব। নিজেরা বদলাব না। এ এক অদ্ভুত মানসিকতা! কথায় বলে, বুদ্ধিমান লোক দেখে শেখে, আর বোকারা শেখে ঠেকে। আমরা দেখেও শিখি না, ঠেকেও না।

আইন অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের দায়িত্ব আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর। পত্রিকায় পড়েছি, সম্প্রতি বিশেষ অভিযানে ট্রাফিক আইন ভঙ্গকারীদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে চার লাখের বেশি। প্রায় সাড়ে ৩১ কোটি টাকা জরিমানা আদায় করা হয়েছে। কিন্তু পরিস্থিতির দৃশ্যমান উন্নতি হয়নি। সবাই জানেন, সোজা আঙ্গুলে ঘি ওঠে না। কিন্তু আঙ্গুল বাঁকিয়েও তো কোনো ফায়দা হচ্ছে না। এ থেকে এটাই প্রমাণিত হলো, জরিমানার ভয় দেখিয়ে আর যাই হোক মানুষের স্বভাব বদলানো যায় না। কথায় আছে না, কয়লা যায় না ধুলে, স্বভাব যায় না মলে। ‘আপন বুঝ পাগলেও বোঝে’ বলে একটা প্রবাদ আছে। প্রবাদটা বুঝি আমাদের একাংশের জন্য খাটে না। জীবন-মৃত্যুর প্রশ্ন জড়িত যে বিষয়কে ঘিরে, সেটা নিয়ে হেলাফেলা কেন তা এক বিস্ময় বটে!

মানুষ অভ্যাসের দাস। আমাদের এই বদভ্যাসগুলো সহসা বদলাবে, এটা হলফ করে বলা যায় না। কেবল আইন দিয়ে কাজ হবে না। আইনের চেয়ে বড় অস্ত্র হচ্ছে সামাজিক সচেতনতা। ইচ্ছা থাকলে উপায় হয়। জনসচেতনতা সৃষ্টির কাজটি চালিয়ে যেতে হবে বছরভর। দায়িত্ব আমাদের সবার। মাঝে-মধ্যে ট্রাফিক সপ্তাহ অথবা ট্রাফিক সচেতনতা মাস হবে চলমান প্রক্রিয়ার অংশ।

লেখক : সাবেক উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক, জনতা ব্যাংক লিমিটেড।

ই-মেইল :[email protected]

সর্বশেষ খবর