বৃহস্পতিবার, ২৯ নভেম্বর, ২০১৮ ০০:০০ টা

স্থানীয় বনাম জাতীয় দ্বন্দ্ব

মোশাররফ হোসেন মুসা

স্থানীয় বনাম জাতীয় দ্বন্দ্ব

সম্প্রতি গণভবনে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন উপলক্ষে মনোনয়নপ্রত্যাশীদের এক সাক্ষাৎকার অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘যারা জেলা পরিষদ, উপজেলা পরিষদ বা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান কিংবা পৌরসভার মেয়র পদে নির্বাচিত হয়েছেন, তারা তো একটি পদে আছেনই। যদি তারা এখন কেউ এমপি হতে চান, তাহলে ওই পদ খালি করে এমপি হতে হবে। এটা একটি ঝুঁকি।’ (বাংলাদেশ প্রতিদিন, ১৫ নভেম্বর ’১৮)। অনুষ্ঠান শেষে মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘তৃণমূলের প্রতিনিধিদের সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী না হওয়ার জন্য বলা হয়েছে। এর পরও কেউ মনোনয়ন ফরম কিনে থাকতে পারেন, তবে তাঁদের মনোনয়ন দেওয়া হবে না।’ (প্রথম আলো, ১৫ নভেম্বর ’১৮)। তাদের এ সিদ্ধান্তটি কৌশলগত না নীতিগত, এ নিয়ে বিতর্ক থাকলেও স্থানীয় প্রতিনিধিদের কাজকে অবহেলা করার কোনো সুযোগ নেই। জাতীয় সংসদ সদস্য পদটির প্রথমে ‘জাতীয়’ শব্দটি থাকার অর্থ হলো তাঁরা জাতীয় কাজ, তথা জাতীয় চিন্তায় নিজেদের ব্যাপৃত রাখবেন; একইভাবে স্থানীয় সরকারের প্রথমে ‘স্থানীয়’ শব্দটি থাকার অর্থ হলো স্থানীয় সরকারের প্রতিনিধিরা স্থানীয় কাজে নিজেদের নিয়োজিত রাখবেন। কিন্তু সংবিধানে জাতীয় প্রতিনিধিদের কাজ ও স্থানীয় প্রতিনিধিদের কাজ পৃথক ও সুনির্দিষ্ট না থাকায় জাতীয় সংসদ সদস্যরা স্থানীয় কাজে হস্তক্ষেপ করেন বেশি। অর্থাৎ তাদের হাতে সীমাহীন ক্ষমতা ন্যস্ত থাকায় জাতীয় সংসদ সদস্য পদটি এখন লোভনীয় পদ। সেজন্য সবাই এমপি হতে চান। কয়েকজন অবসরপ্রাপ্ত সরকারি চাকুরে এবার এমপি পদে প্রার্থী হওয়ার জন্য দলীয় মনোনয়নপত্র কিনেছেন। তাদের বক্তব্য, বাকি জীবন তাঁরা স্থানীয়দের সেবায় নিয়োজিত রাখতে চান। স্থানীয়দের সেবার জন্য স্থানীয় সরকার রয়েছে এটা তাদের জানা। কিন্তু এমপিদের সীমাহীন ক্ষমতা দেখেই তাদের এই পদে অধিষ্ঠিত হওয়ার আগ্রহ তাতে কোনো সন্দেহ নেই। অন্যদিকে এমপিরা স্থানীয় প্রতিনিধিদের অভিভাবক হিসেবে থাকার কথা; কিন্তু কক্ষপথ ভিন্ন ভিন্ন না থাকায় সমগ্র দেশে এমপি বনাম স্থানীয় প্রতিনিধির দ্বন্দ্ব পরিলক্ষিত হয়। এখানে পাবনার ঈশ্বরদী পৌরসভার মেয়রের কর্মকা- উদাহরণ হতে পারে। ঈশ্বরদী-আটঘরিয়া মিলে একটি আসন। বর্তমান ভূমিমন্ত্রী এ আসনের প্রতিনিধি। ঈশ্বরদী পৌরসভাটি বিভিন্ন কারণে গুরুত্বপূর্ণ। পৌর মেয়র আবুল কালাম আজাদ প্রায় সাড়ে তিন বছর আগে নির্বাচিত হয়েছেন। কিন্তু জাতীয় রাজনীতি নিয়ে ব্যস্ত থাকায় পৌরসভার কাজে তেমন মনোযোগী হতে পারেননি। একপর্যায়ে ভূমিমন্ত্রীর সঙ্গে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েন। দুই গ্রুপের সংঘর্ষে দুই যুবক নিহত ও কয়েকজন গুরুতর জখম হন। এবার তিনিও দলীয় মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেছিলেন। অথচ পৌর মেয়র যদি বিগত সময় পৌরসভার কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন তাহলে পৌরবাসী বিভিন্নভাবে উপকৃত হতেন। পাশাপাশি তিনিও দলে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিতে রূপান্তরিত হতেন। এ রকম দ্বন্দ্ব-সংঘাত শুধু এ সরকারের আমলেই ঘটেছে তা নয়, বিগত বিএনপি সরকারের আমলেও ঘটতে দেখা গেছে। আমাদের সংবিধানে ৫৯ ও ৬০ অনুচ্ছেদে স্থানীয় শাসনের কথা বলা হয়েছে। অথচ ইংরেজি ভার্সনে ‘লোকাল গভর্নমেন্ট’ শব্দটি লিপিবদ্ধ আছে। সেজন্য কেউ কেউ মনে করেন ‘স্থানীয় সরকার’ শব্দটিই অসাংবিধানিক। এ দেশে স্থানীয় সরকারের কাজ পরিচালনার জন্য স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় রয়েছে। কিন্তু পাশের দেশ ভারতে ১৯৯৩ সালে ৭৩ ও ৭৪ সংশোধনীর মাধ্যমে শাসন ও উন্নয়নের বিষয়গুলো কেন্দ্র, রাজ্য ও স্থানীয় সরকারের মধ্যে স্পষ্টভাবে বিভাজন করে দেওয়া হয়েছে। কেন্দ্রীয় সরকার অঙ্গরাজ্যগুলোকে ডিঙিয়ে স্থানীয় সরকারের কাজে হস্তক্ষেপ করতে পারে না। তার পরও এ দেশের স্থানীয় সরকারগুলোয় বেশকিছু আবশ্যিক ও ঐচ্ছিক দায়িত্ব দেওয়া আছে, যেগুলো একনিষ্ঠভাবে পালন করলে বহু স্থানীয় সমস্যা সমাধান হয়ে যাবে। যেমন সাভারের তেঁতুলঝোড়া ইউনিয়নের প্রায় ৪ কিলোমিটার দীর্ঘ জয়নাবাড়ি খালটি দখল করে শতাধিক ভবন ও আধাপাকা স্থাপনা তৈরি করা হয়েছিল। প্রায় ৩০ বছর যাবৎ এ দখল প্রক্রিয়া চালু ছিল। ইউপি চেয়ারম্যান ফখরুল আলম নির্বাচনের সময় প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তিনি যদি নির্বাচিত হন তাহলে খালটি উদ্ধার করবেন। তিনি নির্বাচিত হয়ে এলাকাবাসীর সহযোগিতায় খালটি উদ্ধার করে অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন (প্রথম আলো, ২ আগস্ট ’১৮)। ভারতীয় উপমহাদেশে স্থানীয় শাসন এসেছে জাতীয় সরকারের প্রয়োজনে। ভারতে কিছুটা সংস্কার করা সম্ভব হলেও এ দেশে বড় দল দুটির আন্তরিকতার অভাবে স্থানীয় সরকারের পক্ষে কোনো গুণগত পরিবর্তন হচ্ছে না। আবার লেখক-বুদ্ধিজীবী সমাজ সর্বক্ষণ জাতীয় সমস্যা নিয়ে মশগুল থাকায় রাজনীতিতে স্থানীয় সরকারের জন্য কোনো বাস্তবতা তৈরি হচ্ছে না। রাজনৈতিক দলসমূহে স্থানীয় কমিটি ও জাতীয় কমিটি একাকার অবস্থায় থাকায় ছোট নেতা বড় নেতা সবাই জাতীয় চিন্তায় আক্রান্ত। আমরা ভুলে যাই যে, সমষ্টিগত স্থানীয় উন্নয়ন মানেই জাতীয় উন্নয়ন। জনগণ স্থানীয় কাজে অংশগ্রহণের মাধ্যমেই নাগরিক শ্রেণিতে রূপান্তরিত হয়। বলা যায়, কার্যকর স্থানীয় সরকার ছাড়া সুশাসন পাওয়া সম্ভব নয়। সেজন্য দুই প্রকারের সরকার-ব্যবস্থা, তথা কেন্দ্রীয় সরকারব্যবস্থা ও স্থানীয় সরকারব্যবস্থা বাস্তবায়ন করতে হবে। সেইসঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোতেও স্থানীয় কমিটি ও জাতীয় কমিটি গঠনের নিয়ম চালু করতে হবে। স্থানীয় কমিটি স্থানীয় বিষয় নিয়ে চিন্তা করবে এবং স্থানীয় প্রতিনিধিদের মনোনয়ন দেবে। জাতীয় কমিটি জাতীয় প্রতিনিধিদের মনোনয়নের বিষয়ে অর্পিত দায়িত্ব পালন করবে। যেসব স্থানীয় প্রতিনিধি স্থানীয় কাজে পারঙ্গমতা দেখাতে সক্ষম হবেন, তাদের জাতীয় প্রতিনিধি হওয়ার ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার দেওয়ার নিয়ম চালু করতে হবে। প্রয়োজনে স্থানীয় সরকারের জেলা স্তরের প্রতিনিধিদের নিয়ে সংসদের ‘উচ্চকক্ষ’ সৃষ্টি করা যেতে পারে।

 

লেখক : গণতন্ত্রায়ন ও গণতান্ত্রিক স্থানীয় সরকারবিষয়ক গবেষক

ইমেইল :  [email protected]

সর্বশেষ খবর