দেশের ভবিষ্যৎ বিনির্মাণে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সত্যিকার অর্থেই দেশের মালিকানা জনগণের হাতে নেই, বেদখল হয়ে গেছে। জনগণের কোনো মূল্য নেই, মর্যাদা নেই। সব রাজনৈতিক দলই মনে করে তারা নানা কলাকৌশলে সব কব্জা করতে পারবে। নেতাদের ধারণা, জনগণ কিছু বোঝে না। তাদের যেদিকে চালাবে তারা সেদিকেই চলবে। প্রকৃত সত্য তা নয়। ভোটাররা যাতে ভোট দিতে পারে সরকারি প্রভাবমুক্ত একটি নির্বাচন যা ছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আজীবনের সাধনা, তেমন নির্বাচনই আমরা চাই। এক রাজনৈতিক দলের সঙ্গে গণতান্ত্রিক দেশে আরেক রাজনৈতিক দলের যে স্বাভাবিক সুসম্পর্ক থাকা দরকার তার লেশমাত্র নেই। একসময় মনে হচ্ছিল কেউ কারও মুখ দেখাদেখি করবে না। জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠিত হওয়া এবং ড. কামাল হোসেন জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের পক্ষ থেকে সরকারের কাছে আলোচনার আহ্বান করায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তাতে সম্মত হলে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট, যুক্তফ্রন্টসহ আরও আরও দলের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা হওয়ায় পরিবেশ অনেকটা বদলেছে। এত দিন রাজনীতিকদের যে উলঙ্গ গালাগাল শুনছিলাম তার ভাষা কিছুটা বদল হয়েছে। এখন তেমন কেউ কারও ছালবাকল ছোলে না, কাউকে কেউ বদু চাচা ডাকে না। কিছু অদলবদল তো হয়েছেই। জনাব বদরুদ্দোজা চৌধুরীর নেতৃত্বে যুক্তফ্রন্ট মাহী বি. চৌধুরীর মাধ্যমে বিএনপির কাছে ১৫০ সিটসহ মন্ত্রিসভার ভারসাম্য চেয়েছিল। তারা এখন সরকারি দল আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোটে। ৫০টায় ১টা হিসাবে যুক্তফ্রন্ট আওয়ামী লীগের কাছ থেকে ৩ সিট পেয়েছে- ১. মেজর মান্নান, ২. মাহী বি. চৌধুরী ৩. এম এম শাহীন। নির্বাচনের সময় এদিক-ওদিক হয়- সেটা তেমন দোষের কথা নয়। তবে প্রকৃত রাজনীতি বহাল থাকলে সবকিছুরই একটা মানে থাকে। কিন্তু রাজনীতি না থাকলে কিছুই থাকে না
একটা স্বচ্ছ সরকারি প্রভাবমুক্ত বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন খুবই প্রয়োজন। তা যদি শেষ পর্যন্ত হতে না পারে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি দেশের, দেশের জনগণের, তারপর সরকারের। যারা সরকারে আছেন তারা ভাবেন তারাই সব, সাধারণ মানুষ কিছুই না। কিন্তু আসল সত্য তা নয়। মানুষই দেশের সম্পদ, মানুষই দেশের শক্তি, মানুষই দেশের প্রাণ। মানুষের বাইরে কোনো দেশ ভাবা যায় না। সেটা সাহারা মরুভূমি হতে পারে, বালুময় রাজস্থান হতে পারে। কিন্তু সভ্য দেশ হতে পারে না। প্রাণহীন সভ্যতাহীন কোনো দেশের কথা চিন্তাই করা যায় না। আমাদের দেশের হাজার বছরের ঐতিহ্য আছে। সেজন্য আমাদের অতীত গৌরবকে কেউ পায়ে দলতে চাইলেও তা সম্ভব হবে না। তাই মানবসভ্যতার প্রতীক আমাদের এই ভূখণ্ডের বিশ্বময় যে সুনাম তা কারও স্বার্থেই নষ্ট করা উচিত নয়।
![](/assets/archive/images/Print-Edition/2018/December%20-%202018/11-12-2018/bd--1q-2018-12-011-4.jpg)
আমাদের আবেদনের সরাসরি কোনো উত্তর না দিয়ে বা কোনো ব্যবস্থা না করে শুধুই ঘোরপ্যাঁচ করেছেন; যাতে নির্বাচনে অংশ নিতে না পারি। মহান নেতা শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক মহাজনের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে একবার দেউলিয়া হয়েছিলেন। আমারও মনে হয় তেমন হবে। তিন বছর পর সেদিন আবার হঠাৎই অগ্রণী ব্যাংক আমাদের সুবিধার নামে যে অসুবিধা করেছিল তা বাতিল করে আরও ১০-১২ কোটি যোগ করে নিজেদের ইচ্ছামতো যা খুশি তাই করেছে। ১০ শতাংশ সুদে ১০ বছরের জন্য সুবিধা দিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদনের প্রয়োজন ছিল। যথাযথ অনুমোদনও নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু এক মুহূর্তে বাতিল করতে কারও কোনো অনুমতির প্রয়োজন পড়েনি। এমন খামখেয়ালি অগ্রণী ব্যাংকের ইতিহাসে আর কখনো হয়েছে কিনা জানি না। আমার এলাকায় খামখেয়ালি বাজার আছে, খামাক্ষা বাজার আছে, আছে ফুটানির বাজার। সে রকমই শুধু মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে গঠিত সোনার বাংলা প্রকৌশলিক সংস্থার বিরুদ্ধে একটি অর্থলগ্নি প্রতিষ্ঠান অগ্রণী ব্যাংক এমন নিদারুণ খামখেয়ালি করতে পারে ভাবতেও অবাক লাগে। যা হোক, আশা করেছিলাম নির্বাচন কমিশন ব্যাপারটা লক্ষ্য করবে। কারণ নির্বাচনের জন্যই সংস্থা ৩ কোটি ২৫ লাখ টাকা অগ্রণী ব্যাংকে জমা করেছে। আমার আপিলের আগে দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার তিনটি আসনের আপিল আলোচনা হচ্ছিল। এ জে মোহাম্মদ আলী চমৎকার সওয়াল-জবাব করছিলেন। ট্রাইব্যুনালে বেশ কয়েক ঘণ্টা ছিলাম। প্রায় সময় প্রধান নির্বাচন কমিশনার রায় দিচ্ছিলেন। রায় ছিল, মঞ্জুর-নামঞ্জুর। পরিবেশও ছিল ভালো। কাউকে কাউকে মঞ্জুর করে বলা হচ্ছিল, ‘যান যান, নির্বাচন করেন।’ নির্বাচন কমিশনের গ্রহণ-বর্জনের সিদ্ধান্ত আমার কাছে খুব একটা অযৌক্তিক মনে হচ্ছিল না। দু-এক জায়গায় ছোটখাটো খামখেয়ালি লক্ষ্য করা গেলেও তা সহনীয় ছিল। কিন্তু বেগম খালেদা জিয়ার তিনটি আবেদনই হঠাৎ করে নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার রায় দেন, ‘আমার দৃষ্টিতে আবেদনগুলো মঞ্জুর।’ সঙ্গে সঙ্গে বিএনপি সমর্থক আইনজীবীরা খুশিতে লাফিয়ে ওঠেন। পুরো নির্বাচন কমিশন অস্বস্তিতে পড়ে যায়। পরে সব কমিশনার এক এক করে তাদের মত দেন। মাহবুব তালুকদারের মঞ্জুর, বাকিরা নামঞ্জুর। এক মারাত্মক অস্বস্তিকর অবস্থা। এরপর আমার আবেদন ধরা হলো। নির্বাচন কমিশন বার বার বলছিলেন, বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীকে ৫টায় শুনব বলছিলাম, এখন ৬টা বাজে। উনাকে আগে শুনতে দিন। আমি বলেছিলাম, আমার আপিল মঞ্জুর হলেও ধন্যবাদ, না হলেও ধন্যবাদ। ব্যাংক আমার সঙ্গে কীভাবে কতটা জালিয়াতি করেছে আমি শুধু তাই বলতে এসেছি। বাংলাদেশ ব্যাংককে মহামান্য হাই কোর্ট বিষয়টি নিষ্পত্তি করতে নির্দেশ দিয়েছে। আমি জানতে চেয়েছি আর কত টাকা হলে ঋণ খেলাপের অভিযোগ থেকে এবং নিয়মিত হয়ে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারব। ব্যাংক কোনো সদুত্তর দেয়নি, কমিশনও শোনেনি। তারা নামঞ্জুর করেছেন শনিবার সন্ধ্যা ৬টায়। রবিবার রাত ১২টা পর্যন্ত রায়ের নকল দেয়নি। সোমবার মার্কা দেওয়ার দিন। যাতে কেউ হাই কোর্টে আপিল করতে না পারে এটা তার কৌশল কিনা কে বলবে।
আমি নির্বাচন করতে পারি বা না পারি দেশে একটি সুন্দর নির্বাচন হোক তা সর্বান্তঃকরণে চাই। ইতিমধ্যে মনোনয়নপত্র যাচাই-বাছাই শেষে নির্বাচনী প্রতীক দেওয়া হয়েছে। নির্বাচন সুষ্ঠু হোক সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হোক এটাই আমাদের কামনা। ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে এবার আমরা জাতীয় ঐক্যফ্রন্টে শরিক।
অনেকে অনেক কথা বলবেন, বলছেন। ধানের শীষ নিয়ে অনেক কথা তুলেছেন। কিন্তু আমার কাছে ধানের শীষ অন্তত এবারের মতো বিএনপির প্রতীক নয়, এবার ধানের শীষ জনগণের ভোটাধিকার আদায়ের প্রতীক, গণতন্ত্র অব্যাহত রাখার প্রতীক। আগে ছিল হুজুর মওলানা ভাসানীর, এবার প্রবীণ নেতা ড. কামাল হোসেনের। বঙ্গবন্ধুকে ছলেবলে কৌশলে যারা ব্যর্থ করতে চেয়েছে এবং সর্বোপরি তাকে হত্যার ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছে তাদের নিয়ে একদিকে জননেত্রী শেখ হাসিনা, অন্যদিকে আমাদের নিয়ে ড. কামাল হোসেন।
আমি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারিনি। আমার মেয়ে কুঁড়ি সিদ্দিকী আমার আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নেমেছে। মানুষ লুফে নিয়েছে। মনে হচ্ছে এ যেন তাদেরই সন্তান, নিজের সন্তানকে তারা নিজেরা ভোট দেবে। এ এক ঐতিহাসিক ব্যাপার। আমার মেয়ে কোনোমতেই দাঁড়াতে চায়নি, আমার প্রয়োজনে সে আমার পাশে দাঁড়িয়েছে। যেমনি করে অচেনা-অজানা সাধারণ মানুষ আমার পাশে দাঁড়িয়ে আমাকে সারা জীবন সহযোগিতা করেছে ঠিক তেমনি।
লেখক : রাজনীতিক
www.ksjleague.com