আমরা কোথায় যাচ্ছি? মা তার দুই সন্তানকে ফেলে চলে গেলেন। বাবা হলেন মাদকাসক্ত। এক সন্তানকে হত্যা করলেন, আরেক শিশু সন্তানকে করলেন জিম্মি। পুলিশ-র্যাব মিলিয়ে ছয় ঘণ্টার নাটকীয়তা। তারপর বাবার আত্মসমর্পণ। এসব খবর শুনলে মনটা এলোমেলো হয়ে যায়। মাঝে মাঝে দেখি মা সন্তানকে হত্যা করে নিজেও বেছে নিলেন আত্মহননের পথ। পিতা-মাতার কোলে সন্তান এখন আর নিরাপদ নয়। আবার সন্তানের কাছে বাবা-মাও জিম্মি। ঐশীর মতো মেয়ে খুন করে বাবা-মাকে। সর্বনাশা মাদকে আমাদের সামাজিক, নৈতিক অবক্ষয় ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। মূল্যবোধ শব্দটুকু হারিয়ে যাচ্ছে অভিধান থেকে। ছোটবেলায় ঘুম থেকে জেগে উঠতাম মায়ের কোরআন তেলাওয়াতের শব্দ শুনে। নামাজ পড়তে মা ডেকে তুলতেন। তারপর যেতাম ধর্মীয় শিক্ষায়। একটা ভিন্ন পরিবেশ ছিল। স্কুল থেকে ফেরার পথে চুলগুলো একটু বড় দেখলে পাড়া-পড়শি মুরব্বিরাও শাসন করতেন। এখন মানুষ নিজের সন্তানকেই শাসন করতে পারে না। অপরের সন্তান নিয়ে কথা বলা অনেক পরের কথা। সার্বিকভাবে আমাদের অর্থনীতি বদল হচ্ছে। পাশাপাশি ঝরে পড়ছে সামাজিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধ এবং অনুশাসনগুলো। মানুষ সামাজিক পরিবর্তনের ভালোমন্দ দিকগুলোর সঙ্গে নিজেকে খাপ খাওয়াতে পারছে না। তাই পশ্চিমারা এ কারণে মানসিক চিকিৎসার প্রতি গুরুত্ব দেন বেশি। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মনোবিশেষজ্ঞ বাধ্যতামূলক। ভিকারুননেসা স্কুলের সাম্প্রতিক ঘটনাবলি আমার মনে রেখাপাত করেছে। এ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা ভুলে গেছেন একজন হামিদা আলীর কথা। আজকের ভিকারুননেসাকে বিখ্যাত করেছিলেন হামিদা আলী। অন্যদিকে মতিঝিল আইডিয়াল স্কুলের বিকাশ তখনকার প্রধান শিক্ষক ফয়জুর রহমানের হাতে। ফয়জুর রহমানের বাড়ি ছিল লাকসামের ফেনুয়া গ্রামে। তিনি আমার মামির চাচা। আবার আমার আরেক চাচিরও চাচা। নৈতিকতার সঙ্গে ধর্মীয় মূল্যবোধকে ফয়জুর রহমান সামনে আনতেন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। ফয়জুর রহমান ও হামিদা আলীকে অনেকটা অপমান সয়ে তাদের হাতে গড়ে ওঠা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে বিদায় নিতে হয়েছিল। সেসব দুঃখজনক ঘটনার খেসারত এখনো দিতে হচ্ছে। আমার একজন শিক্ষক ছিলেন তোফায়েল আহমেদ চৌধুরী। কঠোর শৃঙ্খলায় টিনের ঘরের একটি কলেজকে তিনি বিকশিত করেছিলেন। তাকে সরানো হয়েছিল পরে খারাপ দৃষ্টান্ত স্থাপন করে। মরহুম তোফায়েল আহমেদ চৌধুরীর সঙ্গে ছাত্র হিসেবে আমার গভীর সখ্য ছিল। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি তা বজায় রেখেছিলেন। নীতি-নৈতিকতা শিখতে হয় পরিবার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও সমাজ থেকে। আগে গ্রামে একজনের বিপদে ১০ জন ছুটে আসত। এখন আর তা নেই। মানুষের মাঝে শুধুই কৃত্রিমতা। ভদ্রতা, সৌজন্যতা উঠে গেছে। লোভ-লালসায় তৈরি হচ্ছে হিংসা-বিবাদ। আত্মহননের পথ বেছে নিচ্ছে মানব সমাজ। শহরের এই জীবনে পাশের ফ্ল্যাটের মৃত ব্যক্তির জানাজায় আমরা অংশ নিই না। খোঁজ নিয়ে জানাতে কেউ যান না সমবেদনাটুকু। চাকচিক্যতে শালীনতা আর আধুনিকতার ব্যবধানটুকু বোঝে না শহুরে মানুষ। বিদেশি সংস্কৃতির নিষ্ঠুর আগ্রাসন সমাজ জীবনকে তছনছ করে দিচ্ছে। কথায় কথায় ডিভোর্স যেন আধুনিকতারই অংশ। এখন শহরে বিয়েশাদির অনুষ্ঠান হয় গোটা দশেক। বিয়ের আগে পার্টির শেষ নেই। কিন্তু কয়দিন পর শুনি ডিভোর্স। দ্বিতীয় বিয়ের দাওয়াত এলে আমি আর যাই না। মনে হয়, কয়দিন পর আরেকটা খবর শুনব। তার চেয়ে অংশ না নেওয়াই ভালো। বিয়ের কার্ডেরও রং বদল হয়েছে। এখন বিয়ের কার্ডের সঙ্গে অনেক ধরনের উপহার পাই। শুধু চকোলেট নয়, থাকে আরও কত কিছু। আজব! মানুষের অর্থবিত্ত বাড়ছে, মন-মানসিকতা কেমন যেন হয়ে যাচ্ছে।
কিছু দিন আগে বাবা-মায়ের সঙ্গে জম্ম দিন করতে এলো মেয়েটি। শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণের পর দাঁড়াল ইমিগ্রেশনে। কর্মকর্তা জানতে চাইলেন, কোথা থেকে আসা হলো? মেয়েটি বলল, বোস্টন। এবার কর্মকর্তার প্রশ্ন বোস্টনে কার সঙ্গে থাকেন? মেয়েটি বলল, একা থাকি। কর্মকর্তা পাশের আরেক অফিসারকে ডাকলেন, বললেন একটি মেয়ে বোস্টনে একা কী করে থাকে? এ সময় মেয়েকে রিসিভ করতে আসা বাবা দূর থেকে হাত নাড়লেন। মেয়ে বাবাকে দেখে পাল্টা হাত নাড়তেই, কর্মকর্তা বুঝলেন কেউ একজন নিতে এসেছে তাকে। আর কথা বাড়ালেন না। পাসপোর্টে সিল মারলেন। মেয়ে বেরিয়ে এসে বাবাকে বলল, একজন ইমিগ্রেশন কর্মকর্তা এভাবে বলতে পারেন? বাবা বললেন, তুমি বলতে আমি ওখানে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করি। পড়াশোনা করতে গেলে একাই তো থাকতে হয়। আমার মা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় একাই হলে থাকতেন। আমি থাকি এখন পরদেশে। মেয়ে আবার বলল, আমাকে তো জানতে চাননি আমি কী করি? শুধু বললেন, কার সঙ্গে ওখানে থাকেন। আমি বলেছি একা থাকি। আমাদের সমস্যা অনেক। এই তো কিছু দিন আগে জরুরি কাজে কলকাতা যাচ্ছিলাম। কাউন্টারে দাঁড়াতেই কর্মকর্তা বললেন, অপেক্ষা করুন, সার্ভার ডিস্টার্ব দিচ্ছে। কাউন্টারে বসে থাকা হাঁটতে থাকা ওসি ইমিগ্রেশনালকে ডাকলেন। দুজন মিলে ঘাঁটাঘাঁটি। এ সময় অন্য কাউন্টারের আরও দুজন কর্মকর্তা এলেন। তাদের একজন আমাকে সালাম দিলেন। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাকে অনুরোধ করলেন, ম্যানুয়ালে কাজটা শেষ করতে। আমার সামনে বসে থাকা কর্মকর্তা কারও কথা শুনলেন না। বরং ভাবে মনে হলো আমাকে একজন কর্মকর্তার সালাম দেওয়াটা তার পছন্দ হয়নি। ১০-১২ মিনিট পর সার্ভার ঠিক হলো। তিনি কাজ শুরু করলেন। একই সঙ্গে আমাকে জেরা শুরু করলেন। বললেন, কী করেন? জবাব দিলাম সাংবাদিকতা। পরের প্রশ্ন কই কাজ করেন? বললাম, বাংলাদেশ প্রতিদিন নামের একটি কাগজে। এবার তিনি আবার বললেন, ওখানে আপনি কী? জবাব দিলাম, সম্পাদক। আমার দিকে তাকালেন। এর মাঝে তার সিল মারা শেষ। তিনি আমার হাতে পাসপোর্ট ফেরত না দিয়ে বললেন, ভারত কেন যাচ্ছেন? অনেক কষ্টে মেজাজ স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করেই বললাম, ইমিগ্রেশন ফরমে লিখেছি কেন যাচ্ছি। তিনি আবার বললেন, বলতে কোনো সমস্যা? বললাম, কোনো সমস্যা নেই। আমি আড্ডা দিতে যাচ্ছি বন্ধুদের সঙ্গে। এ কথা ফরমে লেখা যায় না। তাই ট্যুরিজম লিখেছি। কথাবার্তার এ পর্যায়ে এগিয়ে এলেন ইমিগ্রেশনের ওসি। তিনি আমার দিকে তাকালেন। আমি তাকে সব বলতেই তিনি বললেন, সরি স্যার। কিছু মনে করবেন না। আপনাকে চিনতে পারেনি। আমি বললাম, না চিনলে সমস্যা নেই। আমি তো আমার পরিচয় দিলাম। আর চিনলে হয়রানি না, না চিনলে মানুষের সঙ্গে যা খুশি তা ব্যবহার এটা তো ঠিক না। শাহজালালে ইমিগ্রেশনের মাঝে যথেষ্ট উন্নতি হয়েছিল। নারী-পুরুষ অনেক অফিসারকে দেখেছি দক্ষতার সঙ্গে কাজ করতে। এখন আবার কী সমস্যা বুঝতে পারছি না। আসলে আমাদের ইমিগ্রেশনের সিস্টেমগুলো আরও উন্নত করা দরকার। পাশাপাশি প্রশিক্ষণ দরকার কর্মকর্তাদের। আমি মনে করি ইমিগ্রেশন সম্পূর্ণ আলাদা করে ফেললেই ভালো। একজন কর্মকর্তা দক্ষ হয়ে উঠলে বদলে যান। আবার আরেকজন আসেন। পুলিশের এত ইউনিট হলো, অথচ দরকারিটা নিয়ে কেউ সিদ্ধান্ত নেয় না। আমাদের রাষ্ট্রীয় সেবা ইউনিটগুলো সম্পর্কে নতুন ভাবনা তৈরি করতে হবে। বিদেশে আসা-যাওয়া করা যাত্রীদের বড় অংশই মধ্যপ্রাচ্যের শ্রমিক। তারা যেন হয়রানিতে না পড়েন সেদিকে দৃষ্টি রাখতে হবে। আবার বিজনেস ক্লাস যাত্রীদের জন্য আলাদা কাউন্টার দুনিয়ার বেশিরভাগ ইমিগ্রেশনে এখন দেখা যায়। শাহজালালেও করা যায়। আমাদের অনেক সমস্যা আছে, কিন্তু সমাধান করতে হবে। আগামীতে সরকার গঠনের পর সব কিছুতে নজর দিতে হবে বিজয়ী দলকে। বঙ্গবন্ধু আমাদের একটি দেশ দিয়েছেন, তার মেয়ে নতুন উচ্চতায় নিয়েছেন বাংলাদেশকে। আগামীতে সরকার গঠনের পর অনেক নতুন চ্যালেঞ্জ নিয়ে অগ্রসর হলে বাংলাদেশের সার্বিক চিত্র বদলে যাবে।
এই এগিয়ে চলায় আগামীদিনের সরকারের চ্যালেঞ্জ হবে আর্থিক খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা। দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স থাকা। এই জিরো টলারেন্সে মিডিয়া বসে থাকবে না। দুর্নীতি-অনিয়মের সঙ্গে জড়ালে সেই মন্ত্রী-এমপিদের বিরুদ্ধে অবশ্যই খবর প্রকাশ করব। মিডিয়া তার অবস্থান থেকে একচুলও সরবে না। আগামী দিনের বাংলাদেশ হবে নতুন মাত্রার গণতান্ত্রিক চিন্তায় এগিয়ে চলার।
লেখক : সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন।