সোমবার, ১৭ ডিসেম্বর, ২০১৮ ০০:০০ টা

শহরের সুবিধা গ্রামে

ড. শেখ আবদুস সালাম

শহরের সুবিধা গ্রামে

আমাদের প্রধানমন্ত্রী স্বপ্ন দেখানো ও স্বপ্ন বাস্তবায়নকারী এক ভিশনারি নেতা। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিশ্ব মানচিত্রে বাংলাদেশ নামক একটি দেশের জম্ম  ও স্থান করে দিয়ে দেশটিকে বিশ্বময় করে দিয়ে গিয়েছিলেন। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী তা সমুদ্রে ছড়িয়ে দিয়েছেন, আকাশে উড়িয়ে দিয়েছেন। বলা হয়, বঙ্গবন্ধুর বিশ্বময় বাংলাদেশ আজ সমুদ্রময়, আকাশময়।  বাংলাদেশের সীমানা আজ তাই স্থলে-অন্তরিক্ষে, সমুদ্র থেকে আকাশে বিস্তৃত। গত কয়েক বছর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত ধরেই বাংলাদেশের এগিয়ে যাওয়া। এর মধ্য দিয়ে এ দেশের ১৬ কোটি মানুষকে তিনি আজ তাদের এক স্বপ্নের ঠিকানা খুঁজে পাওয়ার ক্ষেত্রে আশাবাদী করে তুলেছেন। মাত্র কয়েক বছর আগে প্রায় অর্ধেক সময় ধরে লোডশেডিংয়ের কারণে অন্ধকারে থাকা দেশটিতে ইতিমধ্যে বিদ্যুতের উৎপাদন ক্ষমতা ২০ হাজার ৪৩০ মেগাওয়াটে উন্নীতকরণ, জাতীয় প্রবৃদ্ধির হার ৭.৮৬ শতাংশে নিয়ে যাওয়া, বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে নিজস্ব তহবিল থেকে ৯০ শতাংশ অর্থ জোগান, ভারত-মিয়ানমারের সঙ্গে স্থল ও সমুদ্রসীমা নিষ্পত্তি করা, প্রতিটি ইউনিয়নে ডিজিটাল সেন্টার স্থাপন, প্রতি বছর মাধ্যমিক পর্যায়ের সব শিক্ষার্থীকে বিনামূল্যে ৩ কোটির বেশি বই বিতরণ, কৃষকের জন্য কৃষি কার্ড ও ১ কোটির বেশি কৃষকের ১০ টাকার ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলা, সারা দেশে প্রায় ১৮ হাজার কমিউনিটি ক্লিনিক ও ইউনিয়ন স্থাস্থ্য কেন্দ্র স্থাপন, মাথাপিছু আয় ১৭৫০ ডলারে উন্নীতকরণ, গার্মেন্ট খাতের বিকাশ, বাংলাদেশকে অর্থনীতির ‘হটস্পটে’ পরিণত করার উদ্যোগ, মেট্রোরেল-ফ্লাইওভার প্রকল্প গ্রহণ, পদ্মা সেতু দৃশ্যমান হওয়া, মহাকাশে নিজস্ব স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ প্রভৃতি কর্মকাণ্ড কেবল প্রধানমন্ত্রীর দৃঢ় নেতৃত্ব আর তার নিঃসন্দেহ দেশপ্রেমের কারণেই সম্ভব হয়েছে। দল-মত নির্বিশেষে দেশের সব মানুষ আজ এ কথা স্বীকার করে। মাত্র কয়েক বছর আগে বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থান কোথায় ছিল এবং বর্তমান সময়ে বাংলাদেশ কোথায় অবস্থান করছে তা আন্দাজ করার জন্য ২০১৮ সালের ১ ডিসেম্বর ‘বাংলাদেশ প্রতিদিন’-এ ড. আতিউর রহমানের ‘বাংলাদেশের ঘুরে দাঁড়াবার জয়যাত্রা’ লেখাটি পড়ে দেখার জন্য পাঠকদের অনুরোধ জানাচ্ছি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমাদের আবার আরেক নতুন স্বপ্ন দেখানোর ঘোষণা দিয়েছেন। অন্ধকার থেকে আলো কুড়িয়ে আনার প্রত্যয়ী এই নেত্রী এখন বলতে শুরু করেছেন, তিনি অচিরেই বাংলাদেশের গ্রামগুলোয় সব রকম শহুরে সুবিধা পৌঁছে দেবেন। তার এ উচ্চারণ ও ধারণাকে কেউ কেউ উচ্চাভিলাষী বলছেন। তবে আমি ব্যক্তিগতভাবে বিশ্বাস করি সুযোগ পেলে তার এ ধারণাকেও তিনি বাস্তব করে তুলবেন। এ প্রসঙ্গে পাঠকের সঙ্গে আমি আমার নিজের খানিকটা অভিজ্ঞতা শেয়ার করতে চাই।

আমি ১৯৭৮ সালে ঢাকায় আসি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতিতে এম এ পড়ার সময় নেদারল্যান্ডসের একটি মানবিক ও ত্রাণ সংস্থা টেরে ডেস হোমস (নেদারল্যান্ডস) অ্যান ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন ফর হিউম্যানিটারিয়ান রিলিফ অর্গানাইজেশনে সোশ্যাল ওয়ার্কার হিসেবে কাজ করার সুযোগ পাই। সকালে ক্লাস করি, আমার অফিস সময় বিকালে। বিকাল ৪টার দিকে ৩২ নম্বরের বঙ্গবন্ধু ভবনের সামনে দিয়ে কখনো রিকশায়, কখনো হেঁটে আমি অফিসে যেতাম। ফিরতে হতো সন্ধ্যার পর। সে সময় সন্ধ্যার পর ৩২ নম্বর সড়ক দিয়ে মানুষ তেমন যাতায়াত করত না। সুনসান অবস্থায় সন্ধ্যার পর তখন বঙ্গবন্ধু ভবনের সামনে দু-একজন পুলিশ ছাড়া সাধারণ মানুষ বা পথচারীর কোনো আনা-গোনা চোখে পড়ত না। নীরব-নিথর এক অদ্ভুত পরিবেশের কারণে সন্ধ্যার পর আমি ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের ব্রিজ পার হয়ে বর্তমান সুলতানা কামাল মহিলা ক্রীড়া কমপ্লেক্সের সামনের রাস্তা দিয়ে ৮ নম্বরের ব্রিজ হয়ে মিরপুর রোড দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ফিরতাম।

সপ্তাহে দুই দিন আমাকে কেরানীগঞ্জ আমবাগিচায় যেতে হতো। সেখানে টি ডি এইচ (নেদারল্যান্ডস) পরিচালিত একটি স্কুল, মেডিকেল চেকআপ সেন্টার ও একটি ফিডিং সেন্টার ছিল। এদের কার্যক্রম তদারকি করে বিকালে ধানমন্ডির হেড অফিসে বসে রিপোর্ট লেখা ছিল আমার কাজ। প্রতি মাসে তৈরি এ রিপোর্টগুলো প্রতি তিন মাস অন্তর নেদারল্যান্ডসের দত্তক পিতা-মাতার কাছে পাঠানো হতো। টি ডি এইচ স্কুলে যে বাচ্চারা পড়ত এর অধিকাংশ ছিল চরম গরিব ঘরের সন্তান। সে সময় কেরানীগঞ্জের আমবাগিচা, চুনকুটিয়া বা আশপাশ এলাকায় কোনো উঁচু জমি আমার চোখে পড়েনি। আমরা ওয়াইজঘাট থেকে নৌকায় করে আমবাগিচায় টি ডি এইচ স্কুল প্রাঙ্গণে নামতাম। যাওয়ার সময় দু-চারটি টিলা ও টিলার ওপর ছোট ছোট ছাপড়া এবং কুঁড়েঘর চোখে পড়ত। সেখানে মূলত মাঝিমাল্লা, দিনমজুর ও অতিদরিদ্র শ্রেণির মানুষ বাস করত। তাদের ছেলেমেয়েরাই ছিল আমাদের স্কুলের শিক্ষার্থী। তারা অধিকাংশ নৌকায় করেই স্কুলে আসত। এসব ছেলেমেয়ের শিক্ষা, স্বাস্থ্য-পুষ্টি ও খাবারের জন্য নেদারল্যান্ডসের নাগরিকরা (টিডিএইচের মাধ্যমে) অর্থ প্রদান করতেন। একজন নাগরিক একসঙ্গে বেশ কয়েকজন ওইসব বাংলাদেশি ছেলেমেয়ের লেখাপড়া ও স্বাস্থ্য-পুষ্টির দায়িত্বও নিতেন। তারা ছিলেন এসব ছেলেমেয়ের দত্তক পিতা-মাতা। মাঝে-মধ্যে এসব পিতা-মাতার অনেকেই ঢাকায় আসতেন এবং এসব ছেলেমেয়ে ও তাদের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করতেন, তাদের ভালোমন্দের খোঁজখবর নিতেন। এসব ছেলেমেয়ের পিতা-মাতার সম্মতিক্রমে তারা কখনো কখনো এই বাচ্চাদের দত্তক হিসেবে গ্রহণ করে তাদের নিজ দেশে নিয়ে যেতেন। এসব বিদেশি অনেকের সঙ্গে আমার তখন অনেক মিথস্ক্রিয়া ও আলাপ-আলোচনা হওয়ার সুযোগ ঘটেছিল। আমি ওই সময় উৎসুক ছিলাম, নেদারল্যান্ডস দেশটি কেমন; তাদের দেশের গ্রামগুলোর হালহকিকত কেমন ইত্যাদি জানতে। তখনই তাদের কাছ থেকে আমি একটা ধারণা পেয়েছিলাম যে, নেদারল্যান্ডস কিংবা দেশটির আশপাশের স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশগুলোয় গ্রামীণ অবকাঠামোও খানিকটা শহরের মতো। এসব দেশের গ্রাম আমাদের দেশের গ্রামের মতো নয়।

এসব দেশের লোকসংখ্যা কম থাকায় গ্রামগুলো বা লোকবসতির অবস্থান গুচ্ছ অথচ ছড়ানো-ছিটানো প্রকৃতির এবং তার এক একটির অবস্থান অনেক দূরে দূরে। এসব দেশে ছড়ানো-ছিটানো গ্রাম বা লোকবসতিকে কেন্দ্র করে একটি নির্দিষ্ট জায়গায় দোকানপাট/শপিং মল, স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক ও কমিউনিটি সুবিধা প্রভৃতি সুযোগ গড়ে উঠেছে। নির্দিষ্ট এ জায়গার সঙ্গে আশপাশের সমগ্র এলাকার সড়ক ও রেল যোগাযোগ ব্যবস্থা এবং বিদ্যুৎ-সুবিধা রয়েছে প্রতুল। সে কারণে ছড়িয়ে থাকা বিভিন্ন জনবসতির মানুষ যে কোনো প্রয়োজনে যে কোনো সময় এই নির্দিষ্ট জায়গায় এসে শহরের প্রায় সব সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ ও ভোগ করতে পারেন। ২০০৮ সালে নরওয়েতে এমন একটি এলাকা দেখার সৌভাগ্যও আমার হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর বাকশাল কর্মসূচির কো-অপারেটিভ ও অর্থনৈতিক প্রোগ্রামের ধ্যান-ধারণায় এমন একটি মডেলের আঁচ ছিল বলে আমার ধারণা। ওইসব দেশের বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে থাকা ‘কেন্দ্রীভূত সুযোগ-সুবিধা’ প্রত্যক্ষ করার অভিজ্ঞতা থেকে আমার মনে হয়েছে বাংলাদেশের গ্রামে ‘শহরের সুবিধা’ ছড়িয়ে দেওয়ার প্রধানমন্ত্রীর যে স্বপ্ন তা বাস্তবায়ন করা মোটেও অসম্ভব নয়। বাংলাদেশে বর্তমানে ৪৯২টি উপজেলা রয়েছে। প্রতিটি উপজেলা (খুবই অল্পসংখ্যক বাদে) আজ জেলা শহর এমনকি রাজধানী ঢাকার সঙ্গে পাকা রাস্তা দ্বারা সংযুক্ত ও বিদ্যুৎ-সুবিধা সম্পন্ন। এসব উপজেলা ছাড়াও বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে প্রায় দুই থেকে আড়াই হাজার ‘গ্রোথ সেন্টার’ রয়েছে। কোনো কোনো উপজেলায় পাঁচ-সাতটি বা তারও বেশি গ্রোথ সেন্টার আছে। এসব গ্রোথ সেন্টারকে কেন্দ্র করে সেখানে বিদ্যমান সুবিধার সম্প্রসারণ ও নতুন নতুন সুযোগ-সুবিধা গড়ে তুলে শহরের সুবিধা গ্রামাঞ্চলে ছড়িয়ে দেওয়া সম্ভব। অগত্যা তা করা না গেলেও বাংলাদেশে ৫০০-এর ওপরে আরবান সেন্টার রয়েছে। এসব সেন্টারের মধ্য থেকে ২০০ থেকে ৩০০ বাছাই করে পাইলট পদ্ধতিতে কর্মসূচি গ্রহণ করে (এবং তা পরিচালনার জন্য একটি বডি বা অথরিটি গড়ে তুলে) সেসব জায়গায় শহুরের সব সুবিধা ছড়িয়ে দেওয়া যায়। এসব সেন্টার ঘিরে সংলগ্ন এলাকার রোড কানেকটিভিটি, ওয়াটার সাপ্লাই, স্যানিটেশন, পয়ঃপ্রণালি, ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্ট, ল্যান্ড ইউজ, নদী-খাল-বন ব্যবস্থাপনা, আইসিটি সুবিধা বৃদ্ধি, রুরাল ইকোনমি প্রমোশন প্রভৃতি সুযোগ তৈরি করা সম্ভব। এসব সুযোগ-সুবিধা ও ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করার জন্য এলাকায় এলাকায় সিটিজেন কমিটি গঠন করা যেতে পারে।  এটা করার জন্য শুধু প্রয়োজন রাষ্ট্রীয়ভাবে সাপোর্টিভ নীতি গ্রহণ এবং তা বাস্তবায়নে সাহসী ও বলিষ্ঠ নেতৃত্ব প্রদান। আমি বিশ্বাস করি এসব গুণ ও দৃঢ়তা আমাদের আঁধারের বোঁটা থেকে আলো ছিঁড়ে আনা প্রত্যয়ী প্রধানমন্ত্রীর রয়েছে। চলমান উন্নয়ন অভিযাত্রার সঙ্গে সুশাসনের বিষয়টির প্রতিও এখন গুরুত্ব দিতে হবে এবং তা আরও বেশি করে নিশ্চিত করতে হবে।  তা করা গেলে বাংলাদেশ যেমন এগিয়ে যাবে, একই সঙ্গে গ্রামেও শহরের সুবিধা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।

লেখক : অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

ইমেইল : [email protected]

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর