বুধবার, ১৯ ডিসেম্বর, ২০১৮ ০০:০০ টা

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে রোগীর তথ্য অধিকার

ড. ফরিদ আহমেদ/সোচনা শোভা

রোগীর তথ্য অধিকার অন্য যে কোনো অধিকারের মতো উন্নত বিশ্বে সর্বজনীন রূপ লাভ করেছে। রোগীর তথ্য অধিকার নিশ্চিত করার জন্য নৈতিক সুশাসন কাঠামোর অংশ হিসেবে উন্নত দেশগুলোয় প্রয়োজনীয় আইনও করা হয়েছে। আদালতও রোগীর এ অধিকার সংরক্ষণে এগিয়ে এসেছে। যেমন, ১৯৯৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রের অঙ্গরাজ্য ম্যাসাসিউট একটি আইন প্রণয়ন করে। সে আইন চিকিৎসককে নির্দেশ প্রদান করে সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকের শিক্ষাগত যোগ্যতা কী, কী কী সম্মান ও পুরস্কার তিনি এ পর্যন্ত অর্জন করেছেন, তিনি কোন ধরনের বীমা পলিসি নিয়েছেন ইত্যাদি বিষয় রোগীদের কাছে প্রকাশ করতে হবে, যাতে চিকিৎসক নির্বাচনে রোগী বা তার প্রতিনিধি সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারেন।

রোগীকে রোগ সম্পর্কে সচেতন করে তোলা, তাকেই তার জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম করে তোলা, রোগীর আত্মসম্মানবোধকে স্বীকার করা বিষয়গুলোর নৈতিক ও প্রয়োগিক মূল্য আছে। রোগীর স্বাধীনতা ও তার প্রকৃত ইচ্ছাকে মর্যাদা দিতে বা জানতে চিকিৎসক ও সমাজ রোগীর জানার অধিকারকে নিশ্চিত করতে চেয়েছে। এ দৃষ্টিকোণটি ইমানুয়েল কান্টের কর্তব্য পালন নীতি ও সদিচ্ছার নীতি এবং অ্যারিস্টটলের সদ্গুণ নীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। ভোক্তার স্বার্থ সংরক্ষণও একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হিসেবে বিবেচিত হয়েছে তথ্য অধিকার আইন প্রণয়নে।

রোগীর তথ্য অধিকার অস্ট্রেলিয়ায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে যখন জানা যায়, এক ভারতবংশীয় আমেরিকান ডাক্তার অপারেশন করে অনেক রোগী মেরে ফেলেছেন। ওই ডাক্তারের কর্মকাণ্ডকে নৈতিক অনুমোদন সমাজ দেয়নি। বাংলাদেশের সার্জনদের সম্পর্কে আমরা ভয়াবহ সংবাদ পত্রিকার পাতায় দেখতে পাই। সম্প্রতি জানা গেছে, নামি এক হাসপাতালের একজন সার্জন রোগীর দুটো কিডনি ফেলে দিয়েছেন। ওইসব সংবাদ রোগীদের বিদেশে যেতে অনুপ্রাণিত করে। এসব বাস্তব সমস্যা থেকে উন্নত দেশগুলো নজর দেয় রোগীর তথ্য অধিকার পর্যালোচনায়। আর সেই দৃষ্টিকোণ থেকে রোগীর তথ্য অধিকার নিশ্চিত করতে শল্য চিকিৎসাবিদদের রিপোর্ট কার্ড প্রবর্তনের বিষয়টি নৈতিক বিবেচনায় গুরুত্ব পায়। গবেষকরা মনে করেন, সার্জনদের রিপোর্ট কার্ড রোগীর তথ্য অধিকার সংরক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এ পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের বিবেচ্য বিষয় বাংলাদেশের সার্জনদের জন্য এমন একটি পদ্ধতি প্রবর্তন করা যায় কিনা।

রোগীর তথ্য অধিকারের বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নিয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ১৯৯৪ সালে  A Declaration on the Promotion of Patients’ Rights in Europe শিরোনামে একটি ডিকলারেশন প্রকাশ করে। এ ডিকলারেশনে মূলত রোগীর সামাজিক অধিকারের পাশাপাশি ব্যক্তিগত অধিকার প্রতিধ্বনিত হয়েছে। প্রথমত, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এ ঘোষণা ইউরোপে রোগীর তথ্য অধিকারের স্বীকৃতি সনদ। নীতিদার্শনিকদের কাছে প্রতীয়মান হয়, সমাজ যদি রোগীর তথ্য অধিকার স্বীকার না করে, তবে প্রকারান্তরে তার চিকিৎসার অধিকারকে অস্বীকার করা হয়, যা অনৈতিক।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, everyone has an equal opportunity to enjoy the highest attainable level of health. এবং তাদের এই স্বাস্থ্য অধিকার ভোগে যেমন আছে স্বাধীনতা তেমনি আছে তথ্য অধিকার ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের অধিকার। রোগীর স্বাস্থ্য অধিকার থেকেই রোগীর তথ্য অধিকার ও সিদ্ধান্ত গ্রহণে অংশ নেওয়ার অধিকার নিশ্চিত হয়। কারণ রোগীর স্বাধীনতা নিশ্চিত না করে তথ্য অধিকার, সিদ্ধান্ত গ্রহণের পর্বে অংশগ্রহণের অধিকার; সর্বোপরি স্বাস্থ্য অধিকার প্রতিষ্ঠা করা যায় না। রোগীর তথ্য অধিকার থাকলে রোগী চিকিৎসক ও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সিদ্ধান্ত গ্রহণে অংশ নিতে পারে।

উন্নত দেশে রোগীর স্বাস্থ্য অধিকারের বিষয়টি যেভাবে সবার নজরে এসেছে, যেভাবে তাদের সমাজ রোগীর তথ্য অধিকার বা জানার অধিকার অর্জনে মানুষকে সচেতন করেছে, বাংলাদেশে আজও সেভাবে বিষয়গুলো স্বীকৃতি লাভ করেনি। আমাদের মনে আশার সঞ্চার হয়েছিল যখন বাংলাদেশে নাগরিকের জন্য তথ্য অধিকার আইন-২০০৯ পাসের তোড়জোড় চলছিল। আমাদের আশা ছিল রোগীর তথ্য অধিকারও এ আইনে স্থান পাবে। কিন্তু বাস্তবে সেরূপ হয়নি।

রোগীর তথ্য অধিকার সম্পর্কে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ঘোষণায় বলা হয়েছে,

Patients have the right to be fully informed about their health status, including the medical facts about their condition; about the proposed medical procedures, together with the potential risks and benefits of each procedure; about alternatives to the proposed procedures, including the effect of non-treatment; and about the diagnosis, prognosis and progress of treatment.

এ রকম একটি স্বীকৃতি আজও কেন বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশ বিবেচনা করেনি তাও গবেষণার বিষয়। আমাদের অভিমত, যদি এ ধরনের স্বীকৃতি বাংলাদেশ গুরুত্ব দেয়, তাহলে ‘সবার জন্য স্বাস্থ্য’ নিশ্চিত করার লক্ষ্য অর্জন সহজতর হবে।

সমালোচকরা মনে করেন, অনেক ক্ষেত্রে ডাক্তার রোগীকে তথ্য দেওয়ার নামে রোগীকে পুঁঁজি করে বাণিজ্য করেন। আর তাই তিনি তথ্য প্রদান করতে গিয়ে এমন সব কথা বলেন যা রোগীর রোগ না থাকলেও সাধারণ মানুষ রোগাক্রান্ত হয়ে পড়ে। এমনি এক কঠিন পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য বাংলাদেশের রোগী ও তাদের পরিবার পরিত্রাণের উপায় অনুসন্ধান করছে। রোগীদের এই করুণ অবস্থা নিঃসন্দেহে আমাদের সবাইকে ভাবিয়ে তোলে।

রোগীর যেমন তথ্য পাওয়ার অধিকার আছে তেমনি চিকিৎসক বা হাসপাতাল রোগীকে তথ্য প্রদানে বিরত থাকতে পারে যদি তারা মনে করে তথ্য প্রদান করলে রোগীর ক্ষতি হতে পারে। যুক্তি দেওয়া হয়, মানুষের স্বাধীনতা, মর্যাদা নিশ্চিত করতে ও রোগীরা যাতে তাদের ক্ষোভ প্রকাশ করতে পারে বা প্রয়োজনে বিচার চাইতে পারে সেজন্য রোগীর তথ্য অধিকার খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বলার অপেক্ষা রাখে না অনুন্নত দেশের  মতো বাংলাদেশে রোগীর তথ্য অধিকার দারুণভাবে উপেক্ষিত। চিকিৎসা ক্ষেত্রেও বিরাজমান রয়েছে এক নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি। তাতে বাংলাদেশের নাগরিকদের স্বাস্থ্য ও সম্পদ হুমকির মুখে। আজকাল আমরা দেখতে পাই চিকিৎসকরা নিজেরাই ভরসা রাখতে পারেন না তাদের সহকর্মী বা শিক্ষাগুরুর প্রতি। তাই সামর্থ্য থাকলেই চলে যান ব্যাংকক বা সিঙ্গাপুর। সেখানে গিয়েও যে সুখকর অভিজ্ঞতা অর্জন করেন তা বলা যাবে না। কারণ, আমাদের জানা মতে, এক চিকিৎসক বিদেশে চিকিৎসা করিয়ে দেখলেন তার অপারেশনে ত্রুটি রয়ে গেছে। তিনি দেশে ফিরে দেশের ডাক্তারদের দিয়ে সেই ত্রুটিটি নিরাময় করান।

ডাক্তারের প্রতি রোগীদের অনাস্থার কারণে একদিকে যেমন বাংলাদেশের বিপুল পরিমাণ সম্পদ বিদেশে চলে যাচ্ছে, অন্যদিকে দেশের নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি এড়াতে অনেক ভালো ডাক্তার বাংলাদেশ থেকে বিদেশে চলে যাচ্ছেন। তাতে মেধা ও সেবা থেকে বাংলাদেশ বঞ্চিত হচ্ছে। চিকিৎসার নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি এত ব্যাপক যে বাংলাদেশের সরকারের উচ্চপর্যায়ের মানুষগুলোও বিদেশে চলে যাচ্ছেন চিকিৎসা করাতে।

ভারতের তথ্য কমিশনার শ্রীধর আচার্যও বলেন, রোগীরা তাদের মেডিকেল রেকর্ড অবশ্যই পেতে পারেন। কারণ এটি তাদের একটি সংবিধানসম্মত অধিকার যা ভারতীয় সংবিধানে ১৯ ও ২১ আর্টিক্যালে বিধৃত আছে এবং এটি প্রদান করা হাসপাতালগুলোর একটি দায়িত্ব ও কর্তব্য। অন্যদিকে, ভারতের আইনমন্ত্রী তথ্য অধিকারের সমর্থনে বলেন, মেডিকেল রেকর্ড সহজলভ্য হলে রোগীকে কোর্ট-কাচারিতে যেতে হবে না বিচারের জন্য। তারা ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হবেন যদি রোগীর এ অধিকার সংরক্ষণ না করা হয় এবং দায়িত্বপ্রাপ্তরা তাদের দায়িত্ব পালন না করেন।

উপরোক্ত মন্তব্যগুলো থেকে প্রতীয়মান হয় যে, শুধু উন্নত দেশগুলোই নয়, প্রতিবেশী দেশ ভারতও রোগীর তথ্য অধিকার রক্ষায় অনেক দূর এগিয়ে। আমাদের মনে রাখা প্রয়োজন, রোগী শুধু একজন ভোক্তা নন, আর চিকিৎসকও একজন ব্যবসায়ী নন; বরং রোগী একজন মানুষ যার মর্যাদাবোধ আছে, আছে অনেক মৌলিক অধিকার। সুতরাং চিকিৎসক ও চিকিৎসাসংশ্লিষ্ট ব্যক্তি শুধু সংবিধান ও দেশের আইন মেনেই চলবেন না, আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত নৈতিক মানদণ্ডগুলোও তিনি পেশাদারিত্বের বেলায় প্রয়োগ করে সিদ্ধান্ত নেবেন। এভাবে একজন চিকিৎসক নিজের মর্যাদা ও রোগীর মর্যাদা সমুন্নত রাখতে পারেন। মানবমর্যাদা সমুন্নত রাখাটা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব।

 

লেখক : ড. ফরিদ আহমেদ, অধ্যাপক

সোচনা শোভা, সহকারী অধ্যাপক দর্শন বিভাগ

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

সর্বশেষ খবর