বুধবার, ১৯ ডিসেম্বর, ২০১৮ ০০:০০ টা

মারণাস্ত্র উৎপাদন থামাতে হবে

আফতাব চৌধুরী

সম্প্রতি বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে সংঘটিত অধিকাংশ গোষ্ঠীগত বা সাম্প্রদায়িক সংঘাতের ইতিহাস অবৈধ মারণাস্ত্রের শক্তিতে বলীয়ান হওয়া একদল দুষ্কৃতিকারী ও বিপথগামী পাশবিক দম্ভ-অহংকারীর অস্ত্রাঘাত ও রক্তে রঞ্জিত হয়ে উঠেছে। কোনো একটা জাতির অস্তিত্ব রক্ষার নামে শুরু হওয়া এসব সংগ্রামে কেউ রেহাই পাচ্ছে না।

অবৈধ মারণাস্ত্র আজ শান্তিপ্রিয় সমাজের জন্য অন্যতম চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আধুনিক মারণাস্ত্রের মজুদকরণের খবর অঞ্চলবিশেষকে করে তুলেছে স্পর্শকাতর। কেননা আধুনিক মারণাস্ত্রের রমরমা সংঘাতপূর্ণ একটি জনবসতি প্রধান অঞ্চলে বা একটা বহুধাবিভক্ত জাতি-জনগোষ্ঠীর এলাকায় অভিশাপ ডেকে আনতে পারে। শান্তি-সম্প্রীতিতে সমৃদ্ধ একটি সমাজকে মুহূর্তে বিধ্বস্ত করে দিতে পারে। সুতরাং অবৈধ মারণাস্ত্রকে আধুনিক বিশ্বের অন্যতম অশুভ শক্তির বাহক হিসেবে গণ্য করা হচ্ছে।

আধুনিক মারণাস্ত্রের যুগে এখন পর্যন্ত যত ভ্রাতৃঘাতী রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের সূত্রপাত হয়েছে এর মূলে কিন্তু অবৈধ অস্ত্রশক্তি। উল্লেখ্য, বিশ্বের সর্ববৃহৎ সংঘর্ষগুলো সংঘটিত হচ্ছে অনুন্নত বা উন্নয়নশীল দেশগুলোয়। বিশ্বের অস্ত্র রপ্তানিকারী ও ধনী রাষ্ট্রগুলো গরিব দেশগুলোয় তাদের অস্ত্রের বাজার তৈরি করছে। বৈধ-অবৈধ, দুই প্রকারের অস্ত্র বিক্রির জন্য এই রাষ্ট্রগুলোকে লক্ষ্য করে ফেলা হচ্ছে। অবৈধ অস্ত্রের সহজলভ্যতায় রাজনৈতিক অস্থিরতা, অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা ও সামাজিক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির জন্য এভাবে দ্বিতীয় পক্ষের শক্তি সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করছে। মৌলবাদী শক্তি হোক বা জিহাদিরাই হোক, বিচ্ছিন্নতাবাদী শক্তিই হোক বা সন্ত্রাসবাদী, এদের মূল চালিকাশক্তি অবৈধ মারণাস্ত্র।

মারণাস্ত্রের অপপ্রয়োগের ফলাফলের কথা বিবেচনা করে বিভিন্ন সময়ে সরকার অসামরিক লোকের হাতে থাকা অবৈধ অস্ত্র সংগ্রহের পাশাপাশি অবৈধ অস্ত্র বাজেয়াপ্ত করেছে। সরকারের এহেন অভিযান শক্তিশালী হলে নিঃসন্দেহে শান্তিকামী জনসাধারণের জন্য আশীর্বাদস্বরূপ হবে। অবশ্য এতে তৃণমূল পর্যায়ে প্রত্যেক নাগরিকের পূর্ণ সহযোগিতা থাকতে হবে। এ মহৎ কাজে গ্রামের শান্তিপ্রিয় মানুষদের নির্ণায়ক ভূমিকা পালন করতে হবে।

প্রসঙ্গত, মারণাস্ত্রের সুপ্রয়োগ হওয়ার কোনো নজির নেই। মারণাস্ত্রের অপপ্রয়োগের ফলে কীভাবে ব্যাপক গোষ্ঠীগত বা সাম্প্রদায়িক সংঘাতের সূত্রপাত ও সামাজিক শান্তি বিঘ্নিত হতে পারে তার বর্ণনা হয়তো নিষ্প্রয়োজন। কিন্তু এর ফলে হতে পারা ক্ষতি যে অপূরণীয় তা উল্লেখ না করাটা অনুচিত হবে। সংঘর্ষপীড়িত এলাকায় প্রায়ই আমরা মানবতার করুণচিত্র প্রত্যক্ষ করছি। নিরীহ লোক কীভাবে আশ্রয়শিবিরে শরণার্থীর জীবনযাপন করে তা আমরা দেখেছি। এর প্রধান ও সাক্ষাৎ উদাহরণ ইসরায়েলের নির্যাতনে কীভাবে ফিলিস্তিনিরা যুগ যুগ ধরে উদ্বাস্তুর মতো দিন কাটিয়েছে। রোহিঙ্গারা কীভাবে মানবেতর জীবনযাপন করছে বাংলাদেশের কক্সবাজার অঞ্চলে। নরকসদৃশ সেই জীবন। অথচ এসব নারকীয় হত্যা বা নির্যাতন রোধে জাতিসংঘ বা বিশ্বের মানবাধিকার সংস্থার ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ। এসব দেশে যে অত্যাচার-নির্যাতন, ঘরবাড়ি, ধর্মীয় স্থান জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ছারখার করা হচ্ছে তাতে কি বিশ্ববিবেক নাড়া দেবে? এ প্রশ্ন বিশ্বের শান্তিপ্রিয় সব মানুষের।

ইউনিসেফের এক সমীক্ষায় প্রকাশ, বিশ্বের ধনী ও মারণাস্ত্র রপ্তানিকারী দেশগুলোর তুলনায় গরিব ও অস্ত্র আমদানিকারী দেশগুলোয় অস্ত্র সংঘাতের ফলে মৃত্যু হওয়া লোকের সংখ্যা বহুগুণে বেশি। মানুষের দ্বারা সংঘটিত দুর্যোগে মা ও শিশু মৃত্যুর সংখ্যাই সর্বাধিক।

সম্প্রতি অস্ত্র রপ্তানিকারী দেশসমূহ ক্ষুদ্র আকার ও হালকা মারণাস্ত্র উৎপাদনে গুরুত্ব আরোপ করেছে। এর কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, ক্ষুদ্র আকৃতির অস্ত্রের বাজারটি সহজে বিভিন্ন প্রান্তে সম্প্রসারিত করা যায়। নির্মাণ ব্যয়ও তুলনামূলকভাবে কম। সন্ত্রাসবাদীদেরও এর ফলে সুবিধা হয়েছে।

বিশ্বের গরিব দেশগুলোকে মারণাস্ত্র রপ্তানিকারী দেশগুলো তাদের অস্ত্র বাণিজ্যের লক্ষ্য হিসেবে বেছে নেওয়া রাষ্ট্রগুলো সংঘাতপ্রবণতা বৃদ্ধিতে ইন্ধন দিচ্ছে এ অভিযোগ দীর্ঘদিনের। এরা বাণিজ্যিক বা অর্থনৈতিক তথা কূটনৈতিক কারণেও প্রয়োজনসাপেক্ষে মারণাস্ত্রকে ‘অনুদান’ হিসেবে তুলে দেয়। এমন উদাহরণ আছে। ১৯৭৫-২০১৫ সময়ে পৃথিবীর ভিতরে সবচেয়ে বেশি মারণাস্ত্র আমদানিকারীর তালিকার শীর্ষে থাকা দেশ দুটি হলো পাকিস্তান ও ভারত। কিন্তু বিশ্ববাসীর দৃষ্টিতে অবৈধ মারণাস্ত্রের লেনদেনের বিষয়টি ‘মুক্ত গোপনীয়’রূপে ধরা হতো। এই সময়ে আমেরিকা সন্ত্রাস-কবলিত পাকিস্তানে হাজার হাজার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র আকারের মারণাস্ত্র মুক্ত হস্তে দান করেছিল। এভাবেই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ধনী দেশগুলো মারণাস্ত্র বিস্তারের সঙ্গে জড়িত।

অবৈধ অস্ত্র সরবরাহ বন্ধ করতে হলে সংশ্লিষ্ট পুলিশবাহিনীর সহযোগে আন্তর্জাতিক পুলিশের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক অপরাধমূলক কাজে জড়িত অপরাধী চক্রকে উৎখাত করতে হবে। অবৈধ অস্ত্র ব্যবসায়ীদের আটকের পাশাপাশি তাদের কারখানাগুলো বাজেয়াপ্ত করতে হবে। অবৈধ তথা চোরাই ব্যবসাকে সমর্থন জোগানে আর্থিক প্রতিষ্ঠান, ব্যক্তি তথা কোম্পানিগুলোকে এ অভিযানের লক্ষ্য হিসেবে নিতে হবে।

            লেখক : সাংবাদিক কলামিস্ট

সর্বশেষ খবর