শনিবার, ২২ ডিসেম্বর, ২০১৮ ০০:০০ টা
বায়তুল মোকারমের খুতবা

ইসলাম প্রচারে আউলিয়ায়ে কিরামের অবদান

মুফতি এহসানুল হক জিলানী : পেশ ইমাম

ইসলাম আল্লাহ রব্বুল আলামিনের মনোনীত দীন বা ধর্ম। আল্লাহ রব্বুল আলামিন গোটা বিশ্বজগতের শান্তি ও সমৃদ্ধি এ ধর্মের মধ্যেই নিহিত রেখেছেন। মানবজাতির ইহকালীন শান্তি ও পরকালীন মুক্তির একমাত্র উপায় হচ্ছে ইসলামের অনুসরণ। তাই আল্লাহ রব্বুল আলামিন ইসলামের প্রচার, প্রসার ও শিক্ষা-প্রশিক্ষণের জন্য প্রেরণ করেছেন বিশ্বনবী রহমাতুল্লিল আলামিন মুহাম্মাদুর রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে। আল্লাহ ইরশাদ করেন,

‘তিনিই নিরক্ষরদের মধ্য থেকে একজন রসুল পাঠিয়েছেন, যিনি তাদের কাছে পাঠ করেন তার আয়াতসমূহ, তাদের পবিত্র করেন এবং শিক্ষা দেন কিতাব ও হিকমত।’ সূরা জুমা, আয়াত ২।

অন্য আয়াতে আল্লাহ রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ইসলাম প্রচারের আদেশপূর্বক বলেন, ‘হে রসুল! পৌঁছে দিন আপনার প্রতিপালকের পক্ষ থেকে আপনার প্রতি যা অবতীর্ণ হয়েছে। আর যদি আপনি এরূপ না করেন, তবে আপনি তাঁর পয়গাম কিছুই পৌঁছালেন না।’ সূরা মায়েদা, আয়াত ৬৭।

রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর ইসলাম প্রচারের এ মহান দায়িত্ব পালন করত সাহাবায়ে কিরামের উদ্দেশে ইরশাদ করেন, ‘জেনে রাখো! তোমাদের উপস্থিত ব্যক্তিরা যেন ইসলামের এ মর্মবাণী অনুপস্থিত ব্যক্তিদের কাছে পৌঁছে দেয়।’ বুখারি।

অন্য হাদিসে তিনি ইরশাদ করেন, ‘আমার পক্ষ থেকে একটি বাণী হলেও পৌঁছে দাও।’ বুখারি।

রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নির্দেশ অনুযায়ী সাহাবায়ে কিরাম ইসলাম প্রচারের এ মহান দায়িত্ব আনজাম দেওয়ার কাজে সর্বাত্মকভাবে নেমে পড়েন। আর তাদের পর যুগে যুগে এ মহান দায়িত্ব আনজাম দেন আউলিয়ায়ে কিরাম তথা আল্লাহর ওলিরা। সাহাবায়ে কিরামের পরবর্তী যুগে ওলিকুল শিরোমণি ছিলেন প্রসিদ্ধ তাবেয়ি হজরত হাসান বসরি (রহ.)। তাঁর ব্যাপারে প্রসিদ্ধ বর্ণনা রয়েছে, তিনি তৎকালীন শাসক শ্রেণির দরবারে রাষ্ট্রে ন্যায়, ইনসাফ প্রতিষ্ঠা ও প্রজাসাধারণের প্রতি দয়ার আচরণের ব্যাপারে বর্ণিত ইসলামের সুমহান বাণীগুলো নিয়ে বার বার যেতেন এবং তাদের উত্তম পন্থায় এসব বিষয়ে উদ্বুদ্ধ করতেন। আউলিয়ায়ে কিরাম কর্তৃক ইসলাম প্রচারের এ মেহনতের ধারাবাহিকতা সব যুগেই অব্যাহত ছিল। ভারতীয় উপমহাদেশে বিখ্যাত সম্রাট আকবর যখন ‘দীনে ইলাহি’ প্রতিষ্ঠার নামে ইসলাম ধ্বংসের জঘন্য খেলায় মেতে উঠেছিলেন তখন তার এ জঘন্য কর্মকান্ডের বিরুদ্ধে যিনি বজ্রকঠিন অবস্থান নিয়েছিলেন তিনি ছিলেন তৎকালীন যুগের মহান বুজুর্গ আল্লাহর ওলি আহমদ সরহিন্দ মুজাদ্দিদে আলফে সানি (রহ.)। তিনি একের পর এক পত্রমারফত সম্রাট আকবরকে বার বার সতর্ক করেছিলেন এবং তৎকালীন মুসলিম সমাজে ইসলামের সঠিক শিক্ষার হেফাজত ও এর প্রচারে বিরাট অবদান রেখেছিলেন।

ইসলাম প্রচারের এ মহান দায়িত্ব আনজাম দিতে গিয়ে যুগে যুগে আউলিয়ায়ে কিরামকে শাসক শ্রেণি ও জুলুমবাজদের চক্ষুশূল হতে হয়েছিল। তাদের ওপর নেমে এসেছিল নির্মম নির্যাতনের খড়্গ। কিন্তু তারা তাঁদের কাজ থেকে এক চুলও সরে আসেননি। বরং তাঁরা নির্ভয় ও নিঃশঙ্ক চিত্তে নিজেদের কাজ আনজাম দিয়ে আল্লাহর এ মহান বাণীর এক একজন জীবন্ত প্রতীক হয়ে উঠেছিলেন। আল্লাহ ইরশাদ করেন, ‘মনে রেখো যারা আল্লাহর ওলি, তাদের না কোনো ভয়-ভীতি আছে, না তারা চিন্তান্বিত হবে।’ সূরা ইউনুস, আয়াত ৬২। আউলিয়ায়ে কিরামের জীবনীতে যুগে যুগে আমরা এ হাদিসের প্রতিফলন দেখতে পাই। যখনই ইসলাম প্রচারের কাজে কোনো আল্লাহর দুশমন তাদের পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছে, তখনই আল্লাহ তাঁদের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। হজরত বড় পীর আবদুল কাদের জিলানি (রহ.), হজরত মুঈনুদ্দিন চিশতি (রহ.), এমনিভাবে হজরত শাহজালাল ইয়ামেনি (রহ.)-এর জীবনীতে আমরা এর প্রচুর দৃষ্টান্ত দেখতে পাই।

আমাদের এ প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশে ইসলামের আগমন ঘটেছিল আউলিয়ায়ে কিরামের হাত ধরেই। ইসলামের মহান বাণী নিয়ে এ দেশে অসংখ্য আল্লাহর ওলি আগমন করেছিলেন; যার মধ্যে হজরত শাহজালাল ইয়ামেনি (রহ.), হজরত শাহপরান, খানজাহান আলী (রহ.)সহ আরও বিশ্ববিখ্যাত অনেক ওলি রয়েছেন। তাঁরা নিজেদের অনুপম চরিত্রমাধুরী দিয়ে মমতার হাত বুলিয়ে আমাদের এ অঞ্চলে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন শান্তির ধর্ম ইসলামের সুমহান বাণী। মানুষকে মুক্ত করেছিলেন শিরক-বিদাতের অন্ধকার থেকে এবং তাদের দেখিয়েছিলেন মুক্তিপথের দিশা। তাঁদেরই অবদানে আজ আমরা মুসলমান। ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে আশ্রয় নিয়ে অশান্তিভরা দুনিয়ায় থেকেও আত্মিক শান্তি অনুভব করি এবং আখেরাতে আল্লাহর করুণায় মুক্তিলাভ ও জান্নাতে প্রবেশের প্রত্যাশা করি।

মোট কথা, ইসলাম প্রচারে আউলিয়ায়ে কিরামের অবদান অনস্বীকার্য। তাঁদের অবদানের কথা স্মরণ করা আমাদের জন্য অবশ্য-কর্তব্য। তাই আসুন, ইসলাম প্রচারে তাঁদের এসব অবিস্মরণীয় অবদানের কথা আমরা বেশি বেশি স্মরণ করি এবং আল্লাহর দরবারে তাঁদের মর্যাদা বুলন্দির জন্য দোয়া করি। আর তাঁদের দেখানো সিরাতে মুস্তাকিমের পথ অনুসরণ করে তাঁদের কাতারে শামিল হওয়ার চেষ্টা করি। আল্লাহ আমাদের তাওফিক দান করুন।

সর্বশেষ খবর