রবিবার, ২৩ ডিসেম্বর, ২০১৮ ০০:০০ টা

আসন্ন নির্বাচন : প্রবাসীদের প্রত্যাশা

কাজী এনায়েত উল্লাহ

জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে দেশের রাজনৈতিক দলগুলো ইশতেহার প্রণয়নের কাজ শুরু করেছে। নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার পর দেশ ও জাতির উন্নয়নের লক্ষ্যে নানা কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য ইশতেহার জাতির কাছে একটি বড় অঙ্গীকার। এ অঙ্গীকারের মধ্য দিয়ে সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক দল দেশ ও জাতির প্রতি কতটা নিবেদিত তা ধ্বনিত হয়। দেশে দেশে ১১ মিলিয়ন তথা ১ কোটি ১০ লাখ প্রবাসীর স্বার্থ রক্ষায় নির্বাচনী ইশতেহারে সন্নিবেশিত করার জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর বিবেচনার জন্য প্রবাসীদের দীর্ঘদিনের দাবি ও প্রত্যাশা তুলে ধরার এখনই সময়। অল ইউরোপিয়ান বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন এবং ওয়ার্ল্ড বাংলাদেশ অর্গানাইজেশন প্রবাসী স্বার্থ রক্ষায় প্রবাসে বৃহত্তম কমিউনিটি সংগঠন। সংগঠনদ্বয়ের নেতৃত্বের অভিজ্ঞতা থেকে কিছু দাবি-দাওয়া তুলে ধরতে চাই।

প্রথমত প্রবাসীদের কল্যাণের নামে দেশে প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয় নামে একটি মন্ত্রণালয় রয়েছে। মধ্যপ্রাচ্য ও দূরপ্রাচ্যে লোক পাঠানোর প্রক্রিয়ার সঙ্গে নীতিগতভাবে যুক্ত দেখা যায় মন্ত্রণালয়কে। অথচ বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে ১১ মিলিয়ন প্রবাসী। একেকজন প্রবাসীর সঙ্গে দেশে যুক্ত গড়পড়তা চারজন করে মানুষ। এ হিসাবে প্রায় সাড়ে ৪ কোটি মানুষ প্রবাসী মানসিকতা ও অর্থনীতির ওপর সরাসরি নির্ভরশীল। কিন্তু কোনো সরকারের পক্ষ থেকে কোনো সময়ই এই বৃহৎ জনগোষ্ঠী প্রত্যাশিত গুরুত্ব ও মনোযোগ পায়নি। সবসময় এরা হিসাব-নিকাশের বাইরেই থেকে গেছে। বিপুলসংখ্যক প্রবাসী এবং তাদের সঙ্গে যুক্ত, রেমিট্যান্সের ওপর নির্ভরশীল মানুষের বৃহত্তর স্বার্থে ন্যূনতম কোনো কর্মসূচি প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়কে নিতে দেখা যায় না। এর প্রধান কারণ হতে পারে প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের কোনো পর্যায়ে কোনো প্রবাসী না থাকা। প্রবাসীদের সমস্যা ও সম্ভাবনা বোঝার মতো কেউ না থাকায় তাদের স্বার্থ যুগের পর যুগ উপেক্ষিত হয়ে আসছে।

দৃষ্টি আকর্ষণ করার মতো দ্বিতীয় বিষয়টি হচ্ছে প্রবাসীদের ভোটাধিকার। আমরা জানি, প্রবাসীদের ভোটাধিকার ব্যাপারটি সুরাহা করতে ২০০৮ সালে এ টি এম শামসুল হুদা কমিশন ও ২০১৪ সালে রকিবউদ্দীন আহমদ কমিশন উদ্যোগ নিয়েছিল, কিন্তু সেসব উদ্যোগ আলোর মুখ দেখেনি। কে এম নূরুল হুদার নেতৃত্বাধীন বর্তমান নির্বাচন কমিশনও এ রকম একটি উদ্যোগ নিয়ে পোস্টাল ব্যালটের মাধ্যমে প্রবাসীদের ভোট দেওয়ার নির্দেশনা জারি করেছে। কিন্তু বিস্তারিত নির্দেশনার অভাব ও অতি অল্প সময়ের মধ্যে পোস্টাল ব্যালটের মাধ্যমে প্রবাসীদের ভোটাধিকার প্রয়োগের নির্দেশনাটি বাস্তবতাবর্জিত বলে মনে করা হচ্ছে। শেষ কথা হচ্ছে, নীতিগতভাবে নির্বাচন কমিশন সম্মত হওয়ার পরও আসন্ন নির্বাচনেও প্রবাসীরা ভোটাধিকার প্রয়োগের নাগরিক দায়িত্ব পালন থেকে বঞ্চিত হতে যাচ্ছেন।

প্রবাসীদের বিভিন্ন পর্যায় থেকে ‘রেমিট্যান্স-যোদ্ধা’ হিসেবে অভিহিত করা হয়। কিন্তু দেশে-বিদেশ ঐক্যবদ্ধ প্ল্যাটফরমের অভাবে নানাভাবে তারা হয়রানি-বঞ্চনার শিকার হয়। পারিবারিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক দিক থেকে নিগৃহীত হয়। দেশে প্রবাসীদের অর্থসম্পদ, পরিজন সবকিছুই নানাভাবে সংবেদনশীল ও অরক্ষিত অবস্থায় থাকে। এ নিয়ে তাদের মধ্যে সবসময় দেশে রেখে যাওয়া সম্পদ ও আপনজনকে নিয়ে উদ্বেগের সীমা থাকে না।

প্রবাসীদের বিপুল অর্থ বিদেশের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে অলস পড়ে আছে। অনায়াসে এ অর্থ বাংলাদেশের পর্যটন, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, যোগাযোগ, নদীখনন, তথ্যপ্রযুক্তি খাতে বিনিয়োগ করা যায়। প্রবাসীদের নামে ব্যাংক, বীমাসহ ব্যবসায়িক অনুমোদন প্রকৃত অর্থে প্রবাসী বিনিয়োগ ত্বরান্বিত করে না, কিংবা আপামর প্রবাসী স্বার্থকেও সংরক্ষণ করে না। প্রসঙ্গত, ২০১৬ সালে অল ইউরোপিয়ান বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন-আয়েবার উদ্যোগে প্রথম বিশ্ব প্রবাসী সম্মেলনের আয়োজন করা হয় মালয়েশিয়ায়। গোটা বিশ্ব থেকে যোগ দেওয়া ছয় শতাধিক প্রবাসীর সম্মেলনের অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, প্রবাসীরা তাদের নিজের শিকড় মাতৃভূমির উন্নয়নে মেধা, অভিজ্ঞতা ও অর্থ বিনিয়োগ করতে চান। তারা চান ঝামেলামুক্ত বিনিয়োগ পরিবেশ এবং হয়রানিমুক্ত গভর্নেন্স। সে সম্মেলনে সারা বিশ্বের প্রবাসী জনগোষ্ঠী এক ছাতার নিচে আসতে ‘ওয়ার্ল্ড বাংলাদেশ অর্গাইনাজেশন’-ডব্লিউবিও গঠন করে, যে সংগঠন প্রবাসীস্বার্থ রক্ষা ও দেশের উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছে।

উপরোক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে প্রবাসীদের সমস্যা সমাধান, স্বার্থ সংরক্ষণ ও সম্ভাবনা আহরণে রাজনৈতিক দলগুলোর ইশতেহারে সন্নিবেশনের জন্য কয়েকটি সুপারিশ পেশ করা যায়- ১. যেসব প্রবাসী বিদেশে সমাজ, অর্থনীতি, শিক্ষা, ব্যবসা-বাণিজ্য, রাজনীতি ইত্যাদি ক্ষেত্রে স্বীকৃত অবদান রেখেছেন, তাদের সম্পৃক্ত করে প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয় ঢেলে সাজানো। যাতে তারা প্রবাসীদের সমস্যা সমাধান ও সম্ভাবনাকে দেশের উন্নয়নে কাজে লাগাতে পারে। এ ক্ষেত্রে প্রবাসীদের শীর্ষপদে দায়িত্ব দেওয়া কিংবা তাদের সমন্বয়ে প্রবাসীকল্যাণে জাতীয় কমিটি গঠন করা যেতে পারে। এ কার্যক্রম ত্বরান্বিত করতে সংসদে প্রবাসী কোটা প্রবর্তন, কিছুসংখ্যক আসন সংরক্ষণ  করা যেতে পারে। এর মধ্য দিয়ে প্রবাসীরা দেশ পরিচালনা কার্যক্রমে সরাসরি সংযুক্ত হতে পারবেন। ২. প্রবাসীদের পারিবারিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক নিগ্রহ, বঞ্চনা ও হয়রানির বিষয়টি সংবেদনশীল হিসেবে গণ্য করে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং বিষয়টি অগ্রাধিকারভুক্ত করা। বিমানবন্দরে প্রবাসী হয়রানি বন্ধে কার্যকর ব্যবস্থার আওতায় আনা। এসব বিষয় প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অগ্রাধিকার কার্যক্রমের আওতায় আনা। ৩. সরকার ও প্রবাসীদের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্কের সেতুবন্ধ গড়ে তোলা এবং সন্তোষজনক আস্থার পরিবেশ তৈরি করা। আস্থার পরিবেশে দেশে প্রবাসী বিনিয়োগ ত্বরান্বিত হবে। এতে প্রবাসীদের স্বার্থরক্ষার পাশাপাশি দেশের উন্নয়নেও বিনিয়োগ কাজে আসবে। পরিশেষে বলতে চাই, বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে থাকা ১১ মিলিয়ন প্রবাসীর স্বার্থে কাজ করে যাওয়া বৃহত্তম কমিউনিটি সংগঠনের নেতৃত্বে অভিজ্ঞতার আলোকে রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে সনির্বন্ধ অনুরোধ, দেশের স্বার্থের কথা বিবেচনা করে প্রবাসীদের কল্যাণ ও দেশের উন্নয়নে তাদের সম্পৃক্ত করার লক্ষ্যে উপর্যুক্ত সুপারিশগুলো ইশতেহার সন্নিবেশ করুন। নির্বাচনে বিজয়ের পর তা বাস্তবায়নের মাধ্যমে প্রবাসীদের নিয়ে উন্নয়নের পথে এগিয়ে চলুন।

লেখক : প্রেসিডেন্ট, ওয়ার্ল্ড বাংলাদেশ অর্গানাইজেশন

৪৮ রু দু ভুইয়ে, প্যারিস-৭৫০১৫, ফ্রান্স।

 

সর্বশেষ খবর