রবিবার, ২৩ ডিসেম্বর, ২০১৮ ০০:০০ টা

আল্লাহ তওবাকারীদের ভালোবাসেন

মুফতি মুহাম্মদ মর্তুজা

আল্লাহ তওবাকারীদের ভালোবাসেন

মানুষমাত্রই ভুল করে। কিন্তু তারাই উত্তম মানুষ যারা ভুল হয়ে গেলে ক্ষমা চেয়ে নেয়, তওবা করে ফেলে। রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘প্রত্যেক আদম সন্তানই ভুল করে। তাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ তারা যারা তওবা করে।’ তিরমিজি। সূরা বাকারার ২২২ নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তওবাকারীদের ভালোবাসেন এবং শুদ্ধাচারীদের ভালোবেসে থাকেন।’

জীবনে চলার পথে আমরা অনেক ভুলভ্রান্তি করে ফেলি, যার দরুন সর্বদা আল্লাহর হক তো নষ্ট হয়ই, কখনো কখনো বান্দার হকও নষ্ট হয়ে যায়। আল্লাহ রহমানুর রহিম, তাই বান্দা যত পাপীই হোক তাঁর কাছে কৃত গোনাহের ওপর লজ্জিত হয়ে তওবা (ক্ষমাপ্রার্থনা) করলে তিনি ক্ষমা করে দেন। মহাগ্রন্থ আল কোরআনে রব্বুল আলামিন ইরশাদ করেন, ‘আর যে তা করবে না সে আজাবপ্রাপ্ত হবে। কিয়ামতের দিন তার আজাব বাড়িয়ে দেওয়া হবে এবং সেখানে সে অপমানিত অবস্থায় স্থায়ী হবে। তবে যে তওবা করে, ইমান আনে এবং সৎকর্ম করে, পরিণামে আল্লাহ তার পাপগুলো পুণ্যদ্বারা পরিবর্তন করে দেবেন। আল্লাহ অতীব ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।’ সূরা ফুরকান, আয়াত ৬৮-৭০। তবে আল্লাহ বান্দার হক নষ্টকারীকে কখনো ক্ষমা করেন না। কারও দ্বারা যদি কোনো বান্দার হক নষ্ট হয়, তবে সেই মানুষটির কাছেই ক্ষমা চেয়ে নিতে হবে যার হক নষ্ট করা হয়েছে। কিন্তু আল্লাহ তাঁর বান্দাদের সর্বদা ক্ষমা করার প্রতি উদ্বুদ্ধ করেছেন। আল কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমরা তোমাদের রবের ক্ষমালাভের জন্য প্রতিযোগিতা কর আর প্রতিযোগিতা কর সেই জান্নাতের জন্য যার বিশালতা আসমান-জমিনের বিশালতার সমান, যা প্রস্তুত করে রাখা হয়েছে মুত্তাকিদের জন্য। (জান্নাতের উত্তরাধিকারী ভাগ্যবান তারা) যারা সচ্ছল কি অসচ্ছল সব অবস্থায় নিজেদের সম্পদ আল্লাহর রাস্তায় ব্যয় করে আর যারা নিজেদের ক্রোধ সংবরণ করে এবং মানুষের অপরাধগুলো ক্ষমা করে দেয়। (এটা সৎ মানুষের গুণ) আর সৎ মানুষদের সবসময় আল্লাহ ভালোবাসেন।’ সূরা আলে ইমরান, আয়াত ১৩৩-১৩৪। মক্কা বিজয়ের পর যখন প্রথম রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মক্কায় প্রবেশ করলেন, তখন তিনি মক্কার সেই শত্রুদের ক্ষমা করে দেন যারা বছরের পর বছর রসুলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে। কঠিন নির্যাতনের মাধ্যমে হত্যা করেছে অসংখ্য সাহাবিকে। তিনি সেই নরপশুদের সবাইকে মাফ করে দেন, এমনকি হিন্দাকেও; যে তাঁর চাচা হজরত হামজা (রা.)-কে হত্যার পর তাঁর দেহকে ক্ষতবিক্ষত করেছিলেন, চিবিয়েছিলেন হামজা (রা.)-এর মতো একজন বিখ্যাত সাহাবির কলিজা। কিন্তু যখনই তিনি ইসলাম গ্রহণ করলেন, রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও তাকে ক্ষমা করে দিলেন। শুধু তাই নয়, হজরত আবুবকর (রা.)-এর একজন নিকটাত্মীয় ছিলেন মিসতাহ (রা.)। তিনি ছিলেন খুবই দরিদ্র। দৈনন্দিন জীবনযাত্রার সংস্থানও তার ছিল না। হজরত আবুবকর সিদ্দিক (রা.) প্রতি মাসে তাকে খরচের জন্য নির্দিষ্ট হারে অনুদান দিতেন। এই মিসতাহ (রা.) একবার শয়তানের ধোঁকায় পড়ে হজরত আয়েশা সিদ্দিকা (রা.)-এর বিরুদ্ধে অপবাদ রটনায় লিপ্ত হয়ে যান। বিষয়টি জানতে পেরে হজরত আবুবকর (রা.) মিসতাহকে অনুদান দেওয়া বন্ধ করে দেন এবং ভবিষ্যতে আর কোনো ধরনের সহযোগিতা না করার শপথ করেন। তখন আল্লাহতায়ালা কোরআনের আয়াত নাজিল করেন, ‘তোমাদের মধ্যে যারা দীনি মর্যাদা ও পার্থিব প্রাচুর্যের অধিকারী, তারা যেন এ মর্মে শপথ না করে যে তারা তাদের গরিব আত্মীয়স্বজন, অভাবগ্রস্ত এবং যারা আল্লাহর রাস্তায় হিজরত করেছে তাদের কোনো প্রকার সাহায্য-সহযোগিতা করবে না। বরং তাদের উচিত তারা যেন তাদের ক্ষমা করে দেয় এবং তাদের দোষত্রুটি উপেক্ষা করে; তোমরা কি চাও না যে আল্লাহ তোমাদের ক্ষমা করে দিন; আল্লাহ তো ক্ষমাশীল পরম দয়ালু।’ সূরা আন নূর, আয়াত ২২। উপরোক্ত আয়াত দ্বারা আমরা বুঝতে পারি, আল্লাহর ক্ষমা পেতে ও একটি সুন্দর পৃথিবী সাজাতে গেলে ক্ষমাশীলতার বিকল্প নেই। প্রতিহিংসা তো শুধু ধ্বংসই করতে জানে। মুহূর্তেই পারে একটি সাজানো বাগানকে মৃত্যুপুরীতে পরিণত করতে। কিন্তু ক্ষমা ও ভালোবাসা সেই মৃত্যুপুরীকে ফুলে-ফলে ভরা উদ্যানে পরিণত করে। তাই আমাদের সবাইকে ক্ষমাশীলতার চাদরে আবৃত করতে হবে। আমাদের দ্বারা কারও ক্ষতি হলে নির্দ্বিধায় তাঁর কাছে ক্ষমা চেয়ে নিতে হবে। কারণ আল্লাহ ক্ষমাশীলকে যেমন ভালোবাসেন, ক্ষমাপ্রার্থীকেও তেমন ভালোবাসেন। শয়তানের ধোঁকায় পড়ে কোনো গোনাহে লিপ্ত হয়ে গেলে কিংবা কারও ওপর জুলুম হয়ে গেলে ক্ষমা চাওয়ায় কোনো লজ্জা নেই। আল্লাহ তওবাকারীদেরই (ক্ষমাপ্রার্থীদের) সফলতা দেন। আল কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমরা সবাই আল্লাহর কাছে তওবা কর, যাতে তোমরা সফলকাম হতে পারো।’ সূরা আন নূর, আয়াত ৩১।

         

লেখক : প্রাবন্ধিক, গবেষক।

 

সর্বশেষ খবর