মঙ্গলবার, ২৫ ডিসেম্বর, ২০১৮ ০০:০০ টা

যিশুর জন্মভূমিতে ইহুদি থাবা মানবতার জন্য লজ্জা

সুমন পালিত

শুভ বড়দিন আজ। হজরত ঈসা (আ.) বা যিশুখ্রিস্টের জন্মদিন হিসেবে উদ্যাপিত হয় এ দিনটি। ২৫ ডিসেম্বর মহাপুরুষ যিশুখ্রিস্টের জন্মদিন কিনা তা নিয়ে মতভেদ রয়েছে। দুনিয়ার কোটি কোটি মানুষ যেহেতু ধর্মীয় পবিত্রতার সঙ্গে এ দিনটিকেই যিশুর জন্মদিন হিসেবে বেছে নিয়েছেন, সেহেতু তা নিয়ে বিতর্ক অনর্থক। জন্মদিন নয়, যিশু যে পৃথিবীতে শান্তি, অহিংসা ও কল্যাণের বাণী নিয়ে আবির্ভূত হন তা-ই সবচেয়ে বেশি প্রাসঙ্গিক। যিশুখ্রিস্ট পৃথিবীর ৩০০ কোটিরও বেশি মানুষের কাছে একটি পবিত্র নাম। খ্রিস্টধর্মের যারা অনুসারী তাদের কাছে তাঁর মর্যাদা প্রশ্নাতীত। দুনিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম ধর্মমত ইসলাম অনুসারীদের কাছে যিশুখ্রিস্ট বা হজরত ঈসা (আ.) আল্লাহর প্রেরিত পুরুষ বা নবী হিসেবে অনন্য মর্যাদায় আসীন।

বাইবেলে বলা হয়েছে, যিশুখ্রিস্ট কুমারী মাতা মেরি বা মারিয়ামের গর্ভে জন্মগ্রহণ করেন। একে ঈশ্বরের মহিমা হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে। কোরআনেও স্বয়ং আল্লাহ হজরত ঈসা (আ.) বা যিশুখ্রিস্টের পবিত্রতা সম্পর্কে নিজে সাক্ষ্য দিয়েছেন। সূরা আলে ইমরানের ৪৫ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, ‘স্মরণ কর যখন ফেরেশতারা বলল, হে মারিয়াম! নিশ্চয় আল্লাহ তোমাকে তাঁর পক্ষ থেকে একটি পুত্রসন্তানের সুসংবাদ দিচ্ছেন। তার নাম মসিহ। মারিয়ামতনয় ঈসা, সে দুনিয়া ও আখিরাতে সম্মানিত এবং সান্নিধ্যপ্রাপ্তদের অন্যতম হবে।’ একই সূরার ৪৭ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, ‘সে (অর্থাৎ মারিয়াম) বলল, হে আমার প্রতিপালক! আমাকে কোনো পুরুষ স্পর্শ করেনি, আমার সন্তান হবে কীভাবে? তিনি বললেন, এভাবেই, আল্লাহ যা ইচ্ছা সৃষ্টি করেন। তিনি যখন কিছু স্থির করেন তখন বলেন, হও এবং তা হয়ে যায়।’ হজরত ঈসা (আ.) পৃথিবীতে এসেছিলেন শান্তি, ভালোবাসা ও কল্যাণের বাণী নিয়ে। মানুষ যখন আল্লাহর কথা ভুলে বিপথে চলছিল তখন তিনি আবির্ভূত হন বিপথগামীদের আল্লাহর পথে নিতে। বলা হয়, ইহুদিদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ তাওরাত বা বাইবেলের ওল্ড টেস্টামেন্টে যিশুখ্রিস্টের আগমনের বার্তা ছিল। ইহুদিরাও তাদের কাক্সিক্ষত এই ত্রাণকর্তার অপেক্ষাতেই ছিল। কিন্তু যিশু যখন পৃথিবীতে আসেন, তখন ইহুদিদের দ্বারাই তিনি নির্যাতিত হন। তারা তাদের ধর্মগ্রন্থের বাণী ভুলে চড়াও হয় এই প্রেরিত পুরুষের ওপর।

যিশু আনুমানিক হিসাবে আজ থেকে দুই সহস্রাব্দ বছর আগে ২৫ ডিসেম্বর জন্ম নেন প্যালেস্টাইনের বেথলেহেমের এক গোয়ালঘরে। নিপীড়িত মানুষকে মুক্তি দিতে এক শিশু জন্ম নিতে যাচ্ছে- এটি প্রচারিত হয়ে পড়ে তাঁর জন্মের আগেই। কুমারী মাতার গর্ভে এই আলোকিত শিশুর জন্মগ্রহণের পর তাঁর পিতৃত্ব নিয়ে নানা বিতর্কের সৃষ্টি হয়। পুণ্যবতী মেরি বা মারিয়ামকে নিগৃহীত হতে হয় ইহুদি ধর্মবেত্তা বা সমাজপতিদের হাতে। কিন্তু আপন যোগ্যতায় হজরত ঈসা (আ.) বা যিশুখ্রিস্ট সব ভ্রান্ত ধারণার অবসান ঘটাতে সক্ষম হন।

যিশুখ্রিস্ট বা হজরত ঈসা (আ.) ছিলেন হজরত ইবরাহিম (আ.)-এর উত্তরপুরুষ। ইহুদি ধর্মের প্রবর্তক হজরত মুসা (আ.)ও ইবরাহিমের বংশোদ্ভূত। ইসলামের প্রবর্তক হজরত মুহাম্মদ (সা.) একই বংশে জন্মগ্রহণ করেন। পৃথিবীর তিনটি প্রধান ধর্মমত একসূত্রে মিশেছে হজরত ইবরাহিমকে কেন্দ্র করে। তিনটি প্রধান ধর্মের অনুসারীর মধ্যে আজ যখন হানাহানি চলছে, পারস্পরিক আস্থার সংকট যখন বিশ্বশান্তিকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলছে, তখন মিল্লাতে ইবরাহিমের ঐক্য সমাধানের পথ দেখাতে পারে।

ইসলামী বিশ্বাস অনুসারে হজরত ঈসা (আ.) ছিলেন আল্লাহর অন্যতম পয়গম্বর বা প্রেরিত পুরুষ। তবে তিনিও ছিলেন অন্য নবী বা পয়গম্বরদের মতোই একজন মানুষ। খ্রিস্টানদের মধ্যে যিশুর মর্যাদা নিয়ে রয়েছে নানা মতভেদ। রোমান ক্যাথলিক ও প্রোটেস্ট্যান্ট খ্রিস্টানদের মতে যিশু হলেন ঈশ্বরপুত্র। তারা এ সম্পর্কে ত্রিত্ববাদের একটি ধারণাও দেন। এই ত্রিত্ববাদের তিন স্তম্ভ হলো ঈশ্বর, মেরি ও যিশু; যার ওপর আজকের খ্রিস্টধর্ম প্রতিষ্ঠিত।

যিশু বিশ্বাস করতেন ভালোবাসায়। মানুষে মানুষে ভালোবাসার কথা বলেছেন এই পবিত্র পুরুষ। হিংসা ও প্রতিহিংসার ছোবলমুক্ত এক পৃথিবীর স্বপ্ন দেখতেন তিনি। এই মহান পুরুষ তাঁর অনুসারীদের শিক্ষা দিয়েছেন যুদ্ধ, হানাহানি থেকে মুক্ত থাকতে। ভালোবাসা দিয়ে মানুষের হৃদয় জয়ের পথ বাতলে দিয়েছেন তিনি। হজরত ঈসা (আ.) বা যিশুখ্রিস্টের জন্ম হয়েছিল অলৌকিকতার মধ্য দিয়ে। পিতৃ সম্পর্ক ছাড়াই তিনি আসেন এই পৃথিবীতে। দুনিয়ার প্রথম পুরুষ হজরত আদম (আ.)-কেও আল্লাহ সৃষ্টি করেছিলেন অলৌকিকভাবে। যেখানে শুধু পিতা নয়, মাতৃগর্ভেরও কোনো সম্পর্ক ছিল না। বলা হয়, আল্লাহর নির্দেশে মাটি দিয়েই সৃষ্টি করা হয় হজরত আদমকে।

যিশু বা হজরত ঈসা (আ.)-কে পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে হয় হিংসার শিকার হয়ে। হিংসাশ্রয়ী ইহুদি ধর্মবেত্তারা প্রথম থেকেই মেনে নিতে পারেননি এই পবিত্র পুরুষকে। বিদেশি শাসকদের কাছেও তিনি ছিলেন সন্দেহ ও আশঙ্কার কেন্দ্রস্থল। ইহুদি সমাজপতিদের সঙ্গে তাঁরই এক শিষ্য জুডাস ষড়যন্ত্রে শামিল হন। ধর্মদ্রোহিতার অভিযোগে তাঁকে ক্রুশবিদ্ধ করা হয়। জন্মের মতো যিশুর মৃত্যুকাহিনীও অলৌকিকতায় ভরা। বাইবেলের মতে, যিশু ক্রুশবিদ্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করলে শিষ্যরা তাঁকে কবর দেন। পরদিন শিষ্যরা তাঁর কবরস্থানে এসে দেখেন কবরে যে পাথর চাপা দেওয়া হয়েছিল তা সেখানে নেই। কবরও শূন্য। যিশু এ সময় তাঁদের দেখা দেন। তিনি যে ঈশ্বরের কাছে ঠাঁই নিয়েছেন সে সুসমাচারও তাদের জানান। যিশু যে আবারও এ পৃথিবীতে আসবেন এ কথাও শিষ্যদের বলা হয়।

ইসলামী বিশ্বাস অনুযায়ী বিপথগামীরা আল্লাহর পয়গম্বর হজরত ঈসা (আ.)-কে ক্রুশবিদ্ধ করতে চাইলেও সফল হয়নি। আল্লাহ তাঁর এই প্রিয় বান্দাকে নিয়ে যান ঊর্ধ্বাকাশে। বিপথগামীরা হজরত ঈসা (আ.) ভেবে আরেক ব্যক্তিকে কুশবিদ্ধ করে। যিশু বা হজরত ঈসা (আ.) যে আবারও এ পৃথিবীতে আসবেন এ বিষয়ে খ্রিস্ট বিশ্বাসের সঙ্গে ইসলামী বিশ্বাসের তেমন দ্বন্দ্ব নেই।

হজরত ঈসা (আ.) বা যিশু সত্য, সুন্দর ও কল্যাণের পথে তাঁর অনুসারীদের চলার উপদেশ দিয়েছেন। তাঁর শিক্ষার মধ্যে হিংসার কোনো স্থান ছিল না। প্রতিহিংসা চরিতার্থ করাকে যিশু এড়িয়ে চলেছেন। এমনকি ক্রুশবিদ্ধ হওয়ার আগেও তিনি তাঁকে হত্যার জন্য ষড়যন্ত্রকারীদের ক্ষমা করে দেন। ঈশ্বরের কাছে প্রণতি জানান, ঈশ্বর ওরা তো জানে না কী ভুল করছে।

মানুষের প্রতি ভালোবাসা ও সহমর্মিতার যে শিক্ষা হজরত ঈসা বা যিশু খ্রিস্ট দিয়েছেন, আজকের বিশ্বে তা শান্তির পথ দেখাতে পারে। যিশুর অনুসারী বলে কাউকে দাবি করতে হলে এ শিক্ষার সঙ্গে একাত্ম হতে হবে। মানুষের অস্তিত্ব ধ্বংস করতে মারণাস্ত্র তৈরি করছে, যারা কথায় কথায় যুদ্ধের হুমকি দিয়ে বেড়ায় তারা আর যাই হোক যিশুর অনুসারী নয়। যারা যিশুর জন্মস্থান প্যালেস্টাইনে নিরীহ মানুষের রক্ত ঝরাতে মদদ জোগাচ্ছে তারা এই পবিত্র পুরুষের অনুসারী বলে নিজেদের দাবি করতে পারে না।

দুই. হজরত ঈসা (আ.) বা যিশুখ্রিস্ট ছিলেন এক পবিত্র পুরুষ। তাঁর পবিত্রতার সাক্ষ্য দিয়েছে পবিত্র ইঞ্জিল বা বাইবেল। পবিত্রতার সাক্ষ্য দিয়েছে আল কোরআন। পৃথিবীর প্রায় ৪৫০ কোটি মানুষ এ দুটি পবিত্র গ্রন্থের অনুসারী। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, আজ পশ্চিমা বিশ্ব শুধু যিশুর শিক্ষা থেকেই সরে আসেনি, তারা এই মহাপুরুষের চরিত্রহননেও উঠেপড়ে লেগেছে। ২০০২ সালে বিবিসি যিশুখ্রিস্ট সম্পর্কে যে প্রামাণ্যচিত্র তৈরি করে তাতে এই মহাপুরুষকে জারজ সন্তান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার অপপ্রয়াস চলে। বলা হয়েছে, রোমান সৈন্যরা যিশুর জননী মেরিকে ধর্ষণ করেছিল। যে কারণে কুমারী মাতার গর্ভে তাঁর জন্ম হয়। যিশুর জন্ম যে ঈশ্বরের অলৌকিকত্বের নজির, তা তারা অস্বীকার করছে।

যিশুর কোনো কোনো ভক্ত খ্রিস্টধর্মের এই মহান প্রবর্তক সম্পর্কে তাদের ধৃষ্টতার এখানেই ইতি ঘটায়নি। ২০০২ সালে ব্রিটেনের সানডে টেলিগ্রাফ পত্রিকা সে দেশের ধর্মযাজকদের যে মতামত তুলে ধরে তাতে সত্যিকারের যিশু-অনুসারীরা আতঙ্ক বোধ করবেন। এ পত্রিকার এক জরিপে বলা হয়, ব্রিটেনের প্রধান ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান প্রোটেস্ট্যান্ট চার্চের শতকরা ২৫ ভাগ ধর্মযাজক যিশুর অলৌকিক জন্মকাহিনী বিশ্বাস করেন না।

যিশুখ্রিস্ট বা হজরত ঈসা (আ.) খ্রিস্টধর্মের প্রবর্তক হলেও দুনিয়ার দেড় শ কোটি মুসলমানের কাছেও পয়গম্বর হিসেবে আকাশছোঁয়া মর্যাদার অধিকারী। ভণ্ড পাদদিদের বক্তব্য শুধু পৃথিবীর ১৭৫ কোটি খ্রিস্টানের জন্যই নয়, দেড় শ কোটি মুসলমানের সংবেদনশীলতায়ও আঘাত হেনেছে। যারা যিশুর জন্মের পবিত্রতা নিয়েই সন্দিহান, তারা নিজেদের খ্রিস্টধর্মের ধর্মযাজক ভাবেন কীভাবে? যিশুখ্রিস্ট বা হজরত ঈসা (আ.)-এর জন্মস্থান ফিলিস্তিনে যারা ইহুদি দখলদারিত্ব কায়েমে সাহায্য করেছে তারা তাঁর সত্যিকারের অনুসারী কিনা ভেবে দেখার বিষয়।

লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক

ইমেইল :[email protected]

সর্বশেষ খবর