বুধবার, ২৬ ডিসেম্বর, ২০১৮ ০০:০০ টা

শোকের দিনে কি নৈশভোজ মানায়!

আফরোজা পারভীন

শোকের দিনে কি নৈশভোজ মানায়!

আমরা স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধ, চেতনা নিয়ে বড় বড় কথা বলি। কেউ কেউ মরিয়া হয়ে উঠি বঙ্গবন্ধুর কতটা কাছে ছিলেন সেটা প্রমাণ করার জন্য। এ দেশ নির্মাণে তার/তাদের ত্যাগ-তিতিক্ষা বীরত্ব  সাহসিকতা কমিটমেন্টের গল্প করতে গিয়ে থামতে ভুলে যান।  বঙ্গবন্ধুর কথা বলতে বলতে কেঁদে বুক ভাসান। হ্যাঁ, এটাই এখন মোটামুটি আমাদের একশ্রেণির সুবিধাবাদী চেতনাবাজের চরিত্র। তারা আবার বিভিন্ন বয়সী, তরুণ থেকে বৃদ্ধ পর্যন্ত। বৃদ্ধদের সুবিধা বেশি। বয়স বেশি হলে বঙ্গবন্ধুর কাছে যাওয়ার সুযোগ বেশি, মুক্তিযোদ্ধা হওয়ার সুযোগ বেশি।

সুযোগ শব্দটি মারাত্মক। এ সুযোগের সদ্ব্যবহার যিনি সঠিকভাবে করতে পেরেছেন তিনি উপরেরও খেয়েছেন তলারও কুড়িয়েছেন। খেয়ে আর কুড়িয়ে চলেছেনও। চলবেনও। এরা আবার অমেরুদণ্ডি। প্রয়োজন হলে মুহূর্তে আপসও করে ফেলেন। কাজেই বিপদেও পড়েন না। তারা বিএনপির আমলে বিএনপির সৈনিক, জাতীয় পার্টির আমলে জাতীয় পার্টির। পদ-পদবি জমাজমি বাড়িঘর কোনো কিছু পেতে বা নিতে তাদের অসুবিধা হয়নি। দিতেও কার্পণ্য করেনি কেউ। কারণ ওই সুবিধা নেওয়ার কৌশল জানা। তরিকা তারা ভালোই জানেন। তারা এখনো চেতনার ফেরিওয়ালা। পরেও ফেরি করবেন যতদিন বাঁচেন।

কিন্তু এ মানুষগুলো বাস্তবিক দেশকে কতটা ভালোবাসেন, স্বাধীনতার চেতনা তারা বুকে কতটা ধারণ করেন সেটা ভাবিয়ে তুলেছে। বলছি না যে বিএনপি বা জাতীয় পার্টি হলে দেশকে ভালোবাসা যাবে না, মুক্তিযুদ্ধকে বুকে ধারণ করা যাবে। যাবে অবশ্যই, যেমন বুকে ধারণ করেন আমার মতো এদেশের অসংখ্য নির্দলীয় সাধারণ মানুষ।

যে মানুষগুলো গ্রামেগঞ্জে আছেন, যুদ্ধ করেছেন, জীবন দিয়েছেন, পঙ্গু হয়ে পড়ে আছেন তাদের কথা মোটেও আলোচিত হয় না। যদি কখনো কোনো অনুসন্ধানী সাংবাদিক তাদের আলোয় তুলে আনেন তারা কিছুটা আলোচিত হন। তারপর অন্ধকারে হারিয়ে যান। আর অগণিত পড়ে থাকেন আলোচনার বাইরে। তারা পদ পাননি, পদবি, জমি বাড়ি কিছুই পাননি। অনেকেরই মুক্তিযোদ্ধা সার্টিফিকেট নেই। এ জিনিসটা যে এক সময় এত দরকারি জিনিস হবে তারা বোঝেননি। প্রাণের তাগিদেই তো মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিলেন। আবার এক বিরাটসংখ্যক মুক্তিযোদ্ধা জেনেও সার্টিফিকেট নেননি। তারা মনে করেছেন, দেশের জন্য যুদ্ধে গেছেন, মুক্তিযোদ্ধা সার্টিফিকেট নেওয়ার জন্য তো না। তাই তারা মুক্তিযোদ্ধার ভাতারও বাইরে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, বিরাট অঙ্কের ইনকাম ট্যাক্স দেন এমন অনেক লোক মুক্তিযোদ্ধা ভাতা পান, অথচ গ্রামগঞ্জের দরিদ্র প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা না খেয়ে বিনা চিকিৎসায় ধুঁকে ধুঁকে মরেন।

শহীদ বুদ্ধিজীবী বলুন আর মুক্তিযোদ্ধা সবই যেন ঢাকাকেন্দ্রিক। ১৪ ডিসেম্বর যারা শহীদ হয়েছেন শুধু তারাই তো শহীদ বুদ্ধিজীবী নন। দেশব্যাপী মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে অংশ নেওয়ায় পাকিস্তানিদের রাইফেল বেয়নেটের মুখে প্রাণ দিয়েছেন অসংখ্য বুদ্ধিজীবী। তাদের নাম আলোচনায় আসে না, তাদের নিয়ে টকশো হয় না, বিশেষ ক্রোড়পত্রে তাদের কথা লেখা হয় না। ওই যে সুযোগ। ঢাকায় থাকার কারণে মুষ্টিমেয় কয়েকজন বুদ্ধিজীবীর পরিবার সুযোগের সুবিধা যেভাবে নিতে পেরেছেন গ্রামগঞ্জের মানুষ তা পারেনি বা পারলেও অভিমানে নিতে চায়নি। তাই তারা আজও অন্ধকারে। মুক্তিযোদ্ধাদের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। স্বামী শহীদ হওয়ার পর বিয়ে করেছেন, আজও বিবাহিত এমন শহীদ জায়া এখনো সদর্পে আছেন। আর সেই শহীদ জায়ারা যারা অল্প বয়সে স্বামী হারিয়ে বৈধব্যকে সাথী করে জীবন কাটিয়ে দিলেন তাদের কথা কেউ জানে না। নিউমনিয়াতে মৃত স্বামীকে শহীদ বানিয়ে ফেলেছেন এমন সুযোগসন্ধানীও আছেন। আর তাদের কথাই বা বলি কেন, ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাতে তো দেশ সয়লাব। সচিবদের ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সার্টিফিকেট যখন বাতিল হয় লজ্জায় মরে যেতে ইচ্ছা করে। মরে যেতে ইচ্ছা করে যখন মুক্তিযুদ্ধে সহায়তা করার জন্য বিদেশিদের দেওয়া মুক্তিযুদ্ধের সম্মাননা স্মারকে সোনার বদলে পিতল পাওয়া যায়!

এটা হলো চেতনার একটা দিক। চেতনার আরেকটা দিক হচ্ছে আমাদের স্ববিরোধিতা। আমরা বলি, দেশকে ভালোবাসি, অন্তরে লালন করি, কিন্তু করি না। মনে আছে বেশ কয়েক বছর আগে আমার এক আত্মীয়ের ২১ ফেব্রুয়ারিতে বিয়ে হয়েছিল। আমি যাইনি। তা নিয়ে পরিবারে অনেক সমস্যা হয়েছিল। আজও তারা আমার সঙ্গে ভালোভাবে কথা বলে না। আর একবার আমার বন্ধুরা আড্ডার আয়োজন করেছিল ১৪ ডিসেম্বর। সেবারও আমি যাইনি। তাদের যুক্তি ওদিন ছুটি। হ্যাঁ, ছুটি শহীদদের স্মৃতি তর্পণের জন্য, তাদের উদ্দেশে শ্রদ্ধা জানানোর জন্য, ভূরিভোজ খাওয়ার জন্য নয়। আমরা ঈদের দুটি দিনকে যদি বিয়ে জন্মদিন বা ওই জাতীয় অনুষ্ঠান থেকে বাদ রাখতে পারি তাহলে শোকের দিনগুলো যেমন ২১ ফেব্রুয়ারি, ১৫ আগস্ট, ১৪ ডিসেম্বর কেন পারি না? আপনার পরিবারের কারও মৃত্যুদিবসে কি আপনি কোনো আনন্দ অনুষ্ঠান করেন? তা যদি না করেন আমাদের শহীদ ভাইদের মৃত্যুদিবসে কেন আনন্দ অনুষ্ঠান করবেন। অনুষ্ঠানটা দুই দিন পেছালে কি আপনাদের আনন্দটা একটু কম হয়? নাকি ওই দিনগুলোতে অনুষ্ঠান করে প্রমাণ করতে চান যেহেতু ওটা শোকের দিন ওইদিন অনুষ্ঠান করে আপনারা অন্য দিনের চেয়ে বেশি আনন্দ পান। আপনি আপনারা স্যাডিস্ট!

হ্যাঁ, কথাগুলো বলছি এ জন্য যে, ২১ ফেব্রুয়ারি, ১৪ ডিসেম্বর, ১৫ আগস্টের মতো দিনগুলোতে কার্ড ছাপিয়ে হল ভাড়া করে বিয়ে, জন্মদিন বা বিয়ের ৫০ বছর পূর্তির মতো হাস্যকর ভাঁড়ামিপূর্ণ অনুষ্ঠান করা হচ্ছে। যারা করছে তাদের কেউ কেউ নিজেদের মুক্তিযোদ্ধা বলে দাবি করে, বঙ্গবন্ধুর কাছের মানুষ বলে দাবি করে, নানারকম সুযোগ-সুবিধা নিয়েছে, নিচ্ছে। আর যারা সেসব অনুষ্ঠানে যায় তাদের অনেকেও নিজেদের মুক্তিযোদ্ধা বা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লোক বলতে সোচ্চার।

আমি বুঝে উঠতে পারি না, এ দিনগুলোতে মানুষের গলা দিয়ে বিশেষ খাবার কী করে নামে! হ্যাঁ, আপনারা হয়তো বলবেন, ওইদিন কি আমরা ভাত খাই না, মাছ খাই না। কোনো কিছু কি থেমে থাকে। খাই, কারণ না খেলে মানুষ বাঁচে না। কাজ থেমে থাকে না, কারণ জীবন চলমান। কিন্তু ভূরিভোজ খেতে সত্যিই আমাদের বাধে। যারা রাজনীতি করেন তাদের সঙ্গে নিয়েই বলছি, ২১ ফেব্রুয়ারি আর ১৪ ডিসেম্বর তো আমাদের সবার। আমাদের জাতিসত্তার । সব দলের, সব মতের। আর ১৫ আগস্ট! শিশু রাসেল কোনো দলের কোনো মতের ছিল না। বঙ্গবন্ধু এ দেশ নির্মাণের কারিগর। সে হিসেবেও এ দিন সবার। তাহলে কোন প্রাণে আমরা হল ভাড়া করে নৈশভোজ বা দ্বিপ্রাহরিক ভোজের আয়োজন করি ওইসব দিনে! আপনি যে সময়টাকে ভোজ খাওয়ান হয়তো ওই সময়টাতেই ’৭১-এর ১৪ ডিসেম্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী একের পর এক হত্যা করছিল বুদ্ধিজীবীদের। তাদের বুকচিরে নামছিল রক্তের ধারা। ভাই, আপনারা যারা এসব করেন তাদের কেউ কি মুক্তিযুদ্ধে ছিলেন না? কারও পরিবার থেকে কি একবিন্দু রক্ত ক্ষয় হয়নি? আপনারা কি নামে বাঙালি মনে পাকিস্তানি?

সরকারের কাছে অনুরোধ, শোকের দিনগুলোতে কোনোরকম আনন্দ আনুষ্ঠান না করার বাধ্যবাধকতা করে আইন পাস করুন। সচেতন জনগণের কাছে প্রার্থনা, শহীদদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে আনন্দ অনুষ্ঠান বর্জন করুন শোকের দিনগুলোতে।  যারা এসব করে তাদের প্রাণ থেকে ঘৃণা করুন। তাহলেই আপনি প্রকৃত দেশপ্রেমিক। সে আপনি যে দলেরই হোন না কেন।

                লেখক : কথাশিল্পী

 

সর্বশেষ খবর