বুধবার, ২৬ ডিসেম্বর, ২০১৮ ০০:০০ টা

নারী এখন আর অবলা নয়

তপন কুমার ঘোষ

নারী এখন আর অবলা নয়

‘মি-টু’ আন্দোলন এখন ছড়িয়ে পড়েছে দেশে দেশে। আন্দোলনের সূত্রপাত যুক্তরাষ্ট্রে। কর্মক্ষেত্রে নৈতিক অনাচারের বিরুদ্ধে এই আন্দোলন। গ্ল্যামার ওয়ার্ল্ড হলিউডের একজন প্রখ্যাত চলচ্চিত্র প্রযোজকের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগকে কেন্দ্র করে শুরু                হয় নীরবতা ভাঙার পালা। ভুক্তভোগী নারীরা একের পর এক নামিদামি ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে যৌন হেনস্তার সব ঘটনা প্রকাশ্যে নিয়ে আসছেন। ‘মি-টু’ মানে ‘আমি-ও’ (যৌন হেনস্তার শিকার)।

বাংলাদেশেও এই আন্দোলনের আঁচ ছড়িয়ে পড়েছে। সাহস করে যৌন হেনস্তার ঘটনা দু-একজন প্রকাশও করেছেন। ‘মি-টু’ আন্দোলনের সমর্থনে ঢাকায় মানববন্ধন হয়েছে। নারীরা পথে-ঘাটে-কর্মক্ষেত্রে কমবেশি যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছেন- এ কথা আমরা সবাই জানি। নারী নিগ্রহ দিন দিন বড় সমস্যা হয়ে উঠেছে। সম্প্রতি ঢাকায় আয়োজিত একটি অনুষ্ঠানে বক্তারা বলেছেন, আমাদের দেশের অর্থনৈতিক উন্নতি হওয়া সত্ত্বেও নারীর প্রতি সহিংসতা এখনো কাক্সিক্ষত মাত্রায় কমেনি। বছরের পর বছর নারীরা নিঃশব্দে এ সহিংসতা সহ্য করে যাচ্ছেন। ‘মি-টু’র মাধ্যমে তারা মুখ খোলার সুযোগ পেয়েছেন।

পত্রিকায় প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, নারী নাকি ঘরেই বেশি নির্যাতিত। গার্হস্থ্য হিংসা বা ডমেস্টিক ভায়োলেন্স কী উন্নত, কী অনুন্নত সব দেশেই কমন। ধনী-দরিদ্র, সাদা-কালো নির্বিশেষে সব দেশে সব সমাজে যৌন নিপীড়নের ঘটনা ঘটে চলেছে। অনেক বিষয়ে অমিল থাকলেও এই একটা বিষয়ে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মধ্যে একটা আশ্চর্য মিল লক্ষ্য করা যায়।  

জাতিসংঘের সাম্প্রতিক একটি রিপোর্টে বলা হয়েছে, গত বছর সারা বিশ্বে যতগুলো নারী হত্যার ঘটনা ঘটেছে তার অর্ধেকেরও বেশি ঘটেছে ডমেস্টিক ভায়োলেন্স বা গার্হস্থ্য হিংসার কারণে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব অনুযায়ী, বিশ্বে গড়ে প্রতি তিনজন নারীর মধ্যে একজন গার্হস্থ্য হিংসার শিকার। বাংলাদেশে নারীদের প্রতি তিনজনে দুজন নিজের ঘরে নির্যাতনের শিকার হন এবং অনেকেই ঘটনাগুলো চেপে যান বলে অ্যাকশনএইড বাংলাদেশের একটি গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।

আমাদের দেশের অধিকাংশ পুরুষ মনে করেন, সংসারের মূল দায়িত্বটা নারীর। পুরুষ কিছু আয়-রোজগার করেই খালাস। সংসারের যাবতীয় কাজ সামাল দিতে হয় নারীকে। দিনভর তাকে সংসারের কাজে ব্যস্ত থাকতে হয়। কর্মজীবী নারীদের দিনশেষে ঘরে ফিরেই তড়িঘড়ি হেঁশেলে ঢুকতে হয়। সমীক্ষা বলছে, পুরুষের তুলনায় নারীরা বেশি সময় কাজ করেন। কিন্তু তাদের সংসারের কাজের কোনো সম্মান বা স্বীকৃতি নেই।

আমরা নিজেদের যতই প্রগতিশীল বলে মনে করি না কেন, ভিতরে ভিতরে আমরা কিন্তু রক্ষণশীলতাকেই লালন করে চলেছি। নারীর প্রতি পুরুষের দৃষ্টিভঙ্গি এখনো ইতিবাচক নয়। ব্যতিক্রম অবশ্য আছে। স্বীকার করতে দ্বিধা নেই, একজন নারীকে পুরুষের সমকক্ষ ভাবতে পারি না। নারীর ওপর প্রভুত্ব কায়েম করতে চাই। নারীও একজন মানুষ এবং তার আত্মসম্মানবোধ আছে, এই বোধটা কজন পুরুষের আছে? থাকলে ভালো।

বাংলাদেশের জন্য সুসংবাদ, গত এক যুগে নারী-পুরুষের সমতার ক্ষেত্রে বেশ ভালো উন্নতি হয়েছে বাংলাদেশের। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে নারী-পুরুষের সমতার দিক দিয়ে দক্ষিণ এশিয়ার সব দেশের ওপরে স্থান পেয়েছে বাংলাদেশ। সার্বিক সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ১৪৯টি দেশের মধ্যে ৪৮তম। তালিকায় ভারতের অবস্থান ১০৮তম। পাকিস্তান ১৪৮তম। চারটি ক্ষেত্রে আবার বিশ্বে সবার সেরা বাংলাদেশ। এই চারটি ক্ষেত্র হলো- প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তির ক্ষেত্রে ছেলেমেয়ের সমতা, মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ছেলে ও মেয়েদের সমতা, সরকারপ্রধান হিসেবে নারীর সময়কাল এবং জন্মের সময় ছেলে ও মেয়ে শিশুর সংখ্যাগত সমতা। শেষোক্ত ক্ষেত্রটিতে অবশ্য মানুষের কোনো হাত নেই। অগ্রগতির খবর আরও আছে। যেসব দেশে নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন সবচেয়ে বেশি হয়েছে, তাদের মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে পঞ্চম। এতসব অর্জনের পাশাপাশি কিছু কিছু ক্ষেত্রে আমরা অবশ্য পিছিয়ে আছি। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে নারীরা এখনো পিছিয়ে, এটা সত্য। সামাজিক ও ধর্মীয় বিধিনিষেধের ভ্রƒকুটি উপেক্ষা করে গত এক দশকে আমাদের দেশের নারীরা অনেক এগিয়ে গেছে। নারীশিক্ষা ও নারীর ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের এই অসামান্য সাফল্য অন্যান্য ক্ষেত্রেও আমাদের সামনে এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা জোগাবে নিঃসন্দেহে। জাপানি পত্রিকা নিক্কি এশিয়ান রিভিউতে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতির স্বীকৃতি দিয়ে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ এখন একটি সফলতার গল্প।

এক সময় ছেলে ভুলানো ছড়ার মতো মেয়েদের শেখানো হতো- পতি বিনা অবলার নেই গতি, পতি পরম গুরু, জেনে রেখ নারীধর্ম পতিসেবা পরম কর্ম, আরও কত কিছু। স্বামীর প্রতি সর্বদা অনুগত থাকতে হবে। স্বামীর কথার ওপর কথা বলা যাবে না। মুখ বুজে সব নির্যাতন সহ্য করতে হবে। নারীরা এসব একরকম মেনেও নিয়েছিলেন। সেই কুসংস্কারাচ্ছন্ন সমাজের ছবিটা সবারই জানা।

সময়টা বদলে গেছে। নারী এখন আর ‘অবলা’ নয়। সব কাজেই বাংলাদেশের নারীদের পারদর্শিতা আজ প্রমাণিত। রাষ্ট্র পরিচালনা থেকে শুরু করে সংসদ কার্যক্রম পরিচালনা, বিচারকার্য পরিচালনা, জনপ্রশাসন, সামরিক ও পুলিশ প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন পদে দায়িত্ব পালন, বিমান চালনা, চিকিৎসা, প্রকৌশল, ব্যবসা, শিল্পোদ্যোগ সব ক্ষেত্রেই নারীরা আজ সফল। নারীর প্রতি পুরুষের সেই সনাতনী দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে হবে। মাতৃজাতিকে সম্মানের চোখে দেখতে হবে। এই চর্চা শুরু হোক নিজের ঘর থেকে।

‘মি-টু’ আন্দোলনের মাধ্যমে প্রকাশ্যে নিয়ে আসা যৌন হেনস্তার অভিযোগগুলো প্রমাণসাপেক্ষ। পুরনো অভিযোগ প্রমাণ করা কঠিন। গোপন অপরাধের কি আর সাক্ষী থাকে! একদা অপরাধ করে পার পাওয়া গেলেও উন্নত প্রযুক্তির এই যুগে অপরাধ অস্বীকার করার সুযোগ নেই।  ভদ্রবেশী কিছু মানুষের মুখোশ খুলে দেওয়া দরকার।  এদের বিরুদ্ধে শুধু নারীকুল নয়, আমাদের সবাইকে সোচ্চার হতে হবে।

লেখক : সাবেক উপব্যবস্থাপনা পরিচালক, জনতা ব্যাংক লিমিটেড।

 

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর