শনিবার, ২৯ ডিসেম্বর, ২০১৮ ০০:০০ টা

গণতন্ত্রই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা

মো. আবুসালেহ সেকেন্দার

রাজতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার ইতিহাস পেরিয়ে আজ আমরা গণতন্ত্রের যুগে বাস করছি। দুঃখজনক হলেও সত্য ‘বাংলাদেশে আজও পরিপূর্ণ গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়নি।’ এই কথা শুনে গণতন্ত্র প্রেমিকরা অবাক হতে পারেন। রাজনীতিবিদরা মাতম তুলতে পারেন। তবে উপরোক্ত কথা সত্য সে বিষয়ে ভূরি ভূরি প্রমাণ আছে। রাজনীতিবিদরা গণতন্ত্রকে মনে প্রাণে ধারণ করতে পারেননি বলেই বার বার এদেশের গণতন্ত্র সামরিকতন্ত্রের জাঁতাকলে পিষ্ট হয়েছে অথবা ভবিষ্যতেও হতে পারে রাজনীতিবিদরা সবর্দা এমন আতঙ্কে ভুগছে। অন্যদিকে পরিবারতন্ত্রের বেড়াজাল ডিঙিয়ে সব মানুষের জন্য রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার দিন এখনো সুদূরপরাহত। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রান্তিক মানুষ হিরো আলমকে নিয়ে ট্রল করাই তা প্রমাণ করছে। অন্যদিকে এবার নির্বাচনে প্রার্থী নির্বাচনের ক্ষেত্রে প্রধান দুই দলই পরিবারতন্ত্রকে প্রাধান্য দিয়েছে। অনেক আসনেই অন্য যোগ্য প্রার্থী থাকা সত্ত্বেও পিতৃ অথবা মাতৃ পরিচয়ই অনেক ক্ষেত্রে প্রার্থী নির্বাচনের ক্ষেত্রে মূল মাপকাঠি হিসেবে কাজ করেছে। যা প্রমাণ করছে যে, যোগ্যতা বা দলের প্রতি শ্রম নয়, এখনো রাজনীতিতে পিতৃ-মাতৃ পরিচয়ই মুখ্য।

যদিও জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট দুইবারের বেশি একটানা কেউ প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন না বলে তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে উল্লেখ করেছে। শেষ পর্যন্ত তারা যদি তাদের এই নির্বাচনী ইশতেহার বাস্তবায়ন করতে পারে তবে এদেশের সাধারণ মানুষের জন্য প্রধানমন্ত্রী হওয়ার দ্বার উন্মুক্ত হবে। দক্ষিণ এশিয়ার অন্য রাষ্ট্রগুলো বিশেষ করে ভারত, পাকিস্তান এবং শ্রীলঙ্কায়ও দীর্ঘদিন বংশ পরম্পরার রাজনীতির প্রভাব ছিল। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার অনেক বক্তৃতায় উল্লেখ করেছেন যে আজকের শিশুরা ভবিষ্যতে প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে বড় বড় বিজ্ঞানী, সাংস্কৃতিক কর্মী হতে পারবে। যা ভবিষ্যতে আওয়ামী লীগের মনোভাব পরিবর্তনের ইঙ্গিত হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে। অবশ্যই এ কথা ঠিক যে এখনো বাংলাদেশে বিশেষ করে আওয়ামী লীগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিকল্প যোগ্য নেতা খুঁজে পাওয়া কঠিন। বিএনপির ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। বেগম খালেদা জিয়ার বিকল্প ওই দলে নেই। তাই যতই জাতীয় ঐক্যফন্ট্রের ইশতেহারে বলা হোক না কেন পরপর তিনবার কেউ প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন না। বাস্তবে তা কতটুকু সম্ভব হবে ভবিষ্যৎ সময় তা বলে দেবে!

দুই. অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জোরালো দাবি বিরোধী দল বার বার করছে। বিভিন্ন স্থানে বিরোধী দলের প্রার্থী, কর্মী ও সর্মথকদের ওপর হামলা এ বার্তা দিচ্ছে যে এখনো নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি হয়নি। যদিও প্রধান নির্বাচন কমিশনার দাবি করছেন যে বিরোধী দলের দাবিগুলো সত্য নয়। সারাদেশের তৃণমূল পর্যায়ে খোঁজ নিলে দেখা যাবে যে শুধু বিরোধী দল নয়, অনেক ক্ষেত্রে সরকারি দলের নির্বাচনী কার্যালয়েও হামলার ঘটনা ঘটছে।

নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী সব রাজনৈতিক দলই নিজেদের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি দাবি করছে। যদি সত্যিকার অর্থে সবাই মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি হয় তাহলে স্বাধীন বাংলাদেশে নির্বাচনে সহিংসতা হওয়ার কথা নয়। একাত্তরে ৩০ লাখ মানুষ প্রাণ উৎসর্গ করেছিলেন শুধু একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য নয়। একটি সুখী, সমৃদ্ধশালী এবং নিরাপদ বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার জন্যও। নির্বাচনে সহিংসতায় জড়িয়ে সাধারণ মানুষের প্রাণ কেড়ে নেওয়ার মাধ্যমে রাজনীতিবিদরা বাংলাদেশকে অনিরাপদ করে তুলছে। প্রতিদিন সাধারণ মানুষকে আতঙ্কে ঠেলে দিচ্ছে।

অন্য আর একটি বিষয় মনে রাখা দরকার, একাত্তরে এদেশের ৩০ লাখ প্রাণ উৎসর্গিত হয়েছিল মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য। ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষ কারণ ছিল ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠা। গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা চালু করা। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন লাভ এবং পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর সেই নির্বাচনী ফলাফলকে উপেক্ষা করে শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে জনগণের কণ্ঠস্বরকে রুদ্ধ করার চেষ্টাই এদেশের শান্তিকামী-মুক্তিকামী মানুষকে স্বায়ত্ত শাসনের বদলে স্বাধীনতার দাবি উত্থাপনের দিকে ঠেলে দেয়। ১৯৭০ সালের নির্বাচনের ফলাফল মেনে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী ক্ষমতা হস্তান্তর করলে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের পথ আরও দীর্ঘ হতো। ইতিহাসের পথ পরিক্রমা ভিন্ন হতো। তাই সত্যিকারের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা হচ্ছে- মানুষের ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠা। একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার ধারাবাহিকতা রক্ষা করা। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী ও দাবিকারী সব রাজনৈতিক দল সেই বিষয়টি মনে রাখবে বলে আমরা আশা করি।

লেখক : শিক্ষক, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।

 

সর্বশেষ খবর