শনিবার, ২৯ ডিসেম্বর, ২০১৮ ০০:০০ টা

দুই মহৎ ঐতিহাসিক জন্মতিথির অপেক্ষায়

হারুন হাবীব

দুই মহৎ ঐতিহাসিক জন্মতিথির অপেক্ষায়

সবাই রাজনীতিতে জড়াবেন, এমনটা নয়। কিন্তু দৃশ্যতই আমাদের তরুণদের বেশির ভাগ রাজনীতিতে যোগ দিতে অনাগ্রহী থাকে। তারা জীবনটাকে প্রচলিত রাজনীতির আবর্ত থেকে সরিয়ে স্ব স্ব ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত হতে চায়, যার যার পেশায় মনোযোগী হতে চায়। রাজনীতির চেহারা হয়তো তাদের তেমন আকৃষ্ট করে না। কিন্তু যেভাবে দেখি না কেন, রাজনীতি সবাইকে স্পর্শ করে। রাজনীতি সমাজ ও রাষ্ট্র থেকে বিচ্ছিন্ন কিছু নয়। অতএব তাকে উপেক্ষা করার সুযোগ নেই। সে কারণে রাজনীতিতে শিক্ষিত, আদর্শবান ও ত্যাগী যুবতারুণ্যের অংশগ্রহণ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, যা বিদ্যমান সংস্কৃতির পরিবর্তন আনতে সক্ষম।

তবে আশার কথা, দেশে যখন জাতীয় নির্বাচনের মতো ঘটনা ঘটে, তখন পরিস্থিতি পাল্টে যায়। আমাদের যুবতারুণ্য প্রবলভাবে রাজনীতিসচেতন হয়ে ওঠে, নানা দলমতে ভাগ হয়ে তারা ভোটের মাঠে সরব হয়। যার যার পছন্দের দল বা ব্যক্তিকে জেতাবার লড়াইয়ে নামে। বলতে কি, তখন একেবারেই মনে হয় না আমাদের তারুণ্যের রাজনীতিবিমুখতা আছে!

সব নির্বাচনই বড় ঘটনা, শুধু আমাদের দেশে নয়, অন্য দেশেও। তবে নানান কারণে ৩০ ডিসেম্বরের ভোট নিয়ে অনেক মহলেই শঙ্কা-সতর্কতা দেখা দিয়েছে। কারণ এই ভোটের মধ্য দিয়েই স্থির হবে বাংলাদেশ রাষ্ট্র ভবিষ্যতে কোন পথে চলবে, রাষ্ট্রনীতির পরিবর্তন ঘটবে নাকি যা চলে আসছিল সে ধারাতেই চলতে থাকবে।

আরও একটি বৈশিষ্ট্য, এবারের সংসদীয় নির্বাচন পাঁচ বছর আগের মতো নয়। গেলবারের মতো এবারে কেউই ভোট বর্জন করেনি, বরং প্রতিটি দলমত নির্বাচনে অংশ নিয়েছে। সবাই যার যার নির্বাচনী ইশতেহার প্রকাশ করেছে। ভোটের প্রচার চলছে জোরকদমে। ভোটের শোরগোল কেবল শহরগঞ্জে নয়, ছড়িয়েছে গ্রামগ্রামান্তরেও।

১৯৭৫-এর পর সামরিক ও আধাসামরিক যে রাষ্ট্রশক্তিগুলো রাষ্ট্রপিতাকে ও মুক্তিযুদ্ধকে আঘাত করেছে, অপমানিত করেছে, আমরা চাই না সেই অপশক্তির কাছে লাখো শহীদের রক্তে ভেজা বাংলাদেশ আবারও ফিরে যাক। বাংলাদেশের মতো দেশে, বলা যায় প্রায় সব দেশেই, সরকারি নীতি-কর্মের সমালোচনা, শক্ত সমালোচনা থাকে। দুঃখজনক হলেও অনেক ক্ষেত্রেই ক্ষমতাসীন দল ও ব্যক্তির বাড়াবাড়ি থাকে। এ দেশেও প্রায় প্রতিটি সরকার সেই সমালোচনার মুখে পড়েছে। কাজেই সরকারি কাজ বা তার সমালোচনার পক্ষ-বিপক্ষ থাকবেই। কিন্তু মহান মুক্তিযুদ্ধের রক্তধারায় জন্ম নেওয়া বাংলাদেশ রাষ্ট্র যারা পরিচালনা করবেন তারা সাম্প্রদায়িক নীতি-আদর্শে দীক্ষিত হতে পারেন না; মুক্তিযুদ্ধ থেকে, জাতির ইতিহাস ও ঐতিহ্য থেকে তারা জাতিকে বিচ্যুত করতে পারেন না। আর যারা তা করেন আমরা তাদের অশ্রদ্ধা করি, পরিপূর্ণভাবে পরিত্যাগ করি।

স্বাধীনতার ৪৭ বছর পর মুক্তিযুদ্ধ আর কখনো এই বাংলাদেশে জেগে উঠবে না; বাঙালি জাতি আর কখনই লাখো শহীদের ডাক শুনতে পাবে না, শুনবে না একাত্তরের লাখো নির্যাতিত নারীর আর্তনাদ। কিংবা এমনটিও হয়তো ভেবে বসেছিলেন, মুক্তিযুদ্ধের ঘাতক-দালালদের, পঁচাত্তরের কুশীলব ও তাদের সমর্থকদের মুখ ভুলে গেছে মানুষ। কিন্তু আমার দৃঢ় আস্থা, আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ, এতকাল পরও, নতুন করে তার স্বমহিমায় দীপ্যমান হয়ে উঠেছে ১১তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে। মুখোশের আড়ালে যারা একাত্তরের পরাজিত সেই অপশক্তিকে আশ্রয় দিচ্ছেন, প্রশ্রয় দিচ্ছেন, সৌভাগ্য যে, তাদের মুখগুলোও স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হয়ে উঠেছে আজ। অর্থাৎ ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ ২০১৮ সালে এসেও নতুন করে প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে। আমরা আরও আশ্বস্ত এই উপলব্ধিতে যে, নব প্রজন্মের তাৎপর্যময় অংশ মুক্তিযুদ্ধের প্রতি অবিচল আস্থা রেখেছে। তারা মাটি খুঁড়ে বের করে এনেছে সেই ইতিহাস, যে ইতিহাস বরেণ্য, যে ইতিহাস সৃষ্টি করেছিল তাদেরই পূর্বপুরুষ।

আমরা একটা নতুন অভিযাত্রা চাই আমাদের জন্মভূমির, মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশের। সেই অভিযাত্রা হবে সৌহার্দ্যরে, বিশ্বাসের, ইতিহাসের। একাত্তরের নৌকায় চেপে আমরা পাড়ি দিতে চাই সামনে, সৃষ্টি করতে চাই একটি মানবিক বাংলাদেশ, গণমানুষের বাংলাদেশ। একটি আস্থা ও বিশ্বাসের কথা বলেই সংক্ষিপ্ত এ নিবন্ধটি শেষ করতে চাই। ৩০ ডিসেম্বর গণমানুষের সর্বজনীন ভোটে নতুন যে সরকার হবে বাংলাদেশের, তা হবে মুক্তিযুদ্ধের পরীক্ষিত রাজনৈতিক শক্তির। মুক্তিযুদ্ধবিরোধী সাম্প্রদায়িক শক্তি যতই সঙ্ঘবদ্ধ হোক, একাত্তরের পরাজিত অপশক্তি যতই আস্ফালন করুক, শহীদের রক্তস্নাত এই বাংলাদেশে তাদের সুনিশ্চিত পরাজয় হবে। আরও একটি স্বপ্নের কথা আছে। আগামী দুই বছরের মধ্যে বিস্তারিত কর্মসূচিতে উদ্যাপন হবে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ৫০তম স্বাধীনতাবার্ষিকী। সেইসঙ্গে মহাসাড়ম্বরে উদ্‌যাপন হবে রাষ্ট্রের স্রষ্টা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শততম জন্মবার্ষিকী। ভালো লাগছে এই ভেবে যে, এ দুই মহৎ ঐতিহাসিক জন্মতিথি উদ্যাপন হবে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে পরিচালিত নতুন সরকারের হাতে।

লেখক : মুক্তিযোদ্ধা ও জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক।

সর্বশেষ খবর