সোমবার, ৩১ ডিসেম্বর, ২০১৮ ০০:০০ টা

নতুন সরকার নতুন প্রত্যাশা

মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কোনোরকম আপস করা যাবে না। সংসদে বিরোধী দলকে যথাযোগ্য মর্যাদা দিতে হবে। দুদককে স্বয়ংসম্পূর্ণ একটি প্রতিষ্ঠানে পরিণত করতে হবে। মেগা প্রকল্পগুলো দ্রুত শেষ করার জন্য উদ্যোগ নিতে হবে। ১০০ দিনের কর্মপরিকল্পনা নিতে হবে। তরুণদের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি এবং ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। কোনো অবস্থাতেই ইন্টারনেট বন্ধ করা যাবে না। গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনের সঙ্গে আলাপে দেশের বিশিষ্টজনেরা নতুন সরকারের কাছে তাদের এসব প্রত্যাশা তুলে ধরেন। বিস্তারিত তুলে ধরেছেন জিন্নাতুন নূরজয়শ্রী ভাদুড়ী

 

 

মাশরাফির বক্তব্য ও তার কার্যক্রম ভালো লেগেছে

রাজধানীর ঢাকা সিটি কলেজ কেন্দ্রে গতকাল সস্ত্রীক ভোট দিতে গিয়েছিলেন। এ কেন্দ্রে ভোট দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও। কিন্তু মোবাশ্বের হোসেন গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনের কাছে অভিযোগ করেন, অব্যবস্থাপনার কারণে তার স্ত্রী ভোট কেন্দ্রে গিয়েও শেষ পর্যন্ত ভোট দিতে পারেননি। এই স্থপতির স্ত্রী হুইল চেয়ারে করে চলাফেরা করেন। একদিকে রাজধানীতে যানবাহন চলাচলে নিষেধাজ্ঞা অন্যদিকে সিটি কলেজের লিফ্টটিও সাধারণ ভোটারদের জন্য ভোটের দিন বন্ধ রাখায় সেটি ব্যবহার করার সুযোগ পাননি মোবাশ্বের হোসেনের স্ত্রী। ফলে ভোট না দিয়েই তাকে ফিরে যেতে হয়। তিনি বলেন, ভোট কেন্দ্রে প্রতিবন্ধীদের ভোট দেওয়ার জন্য ব্যবস্থা রাখতে হবে যা আমাদের ভোট কেন্দ্রগুলোয় নেই। নতুন সরকার ও সংশ্লিষ্টদের এ বিষয়টি শোধরানোর জন্য আহ্বান জানাচ্ছি। তিনি বলেন, এবার ভোটে আমাকে অন্তত কয়েক শ নতুন ভোটার বলেছে যে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়তে রাজনৈতিক দলগুলো যে ইশতেহার দিয়েছে তার যথাযথ বাস্তবায়ন করতে হবে। বিশেষ করে কোনো অবস্থাতেই ইন্টারনেট বন্ধ করা যাবে না। ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়তে হলে এই প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের দিয়ে তার বাস্তবায়ন করতে হবে। মোবাশ্বের হোসেন বলেন, এবারের ভোটে মাশরাফির বক্তব্য এবং তার কার্যক্রম আমার কাছে বেশ ভালো লেগেছে। আমি মনে করি দেশের অন্য জনপ্রতিনিধিদেরও মাশরাফির মতো আদর্শে উজ্জীবিত হয়ে রাজনীতির চর্চা করা উচিত। তিনি বলেন, আনন্দ উৎসব করে ভোট দিন এমনটি বললেই হবে না। ভোটাররা যাতে সুষ্ঠুভাবে ভোট দিতে পারেন তার ব্যবস্থাও করতে হবে। আবার নির্বাচনের দিন শহরে গাড়ি বন্ধ করে দেওয়াটাও যৌক্তিক নয়, এ ব্যাপারে বাস্তবধর্মী সিদ্ধান্ত নিতে হবে। ভোটের সময় স্বাভাবিক জীবনব্যবস্থা বজায় রাখতে হবে। দুঃখজনক যে, যারা নির্বাচনের দিন যানবাহন বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তারা নিজেরাই গাড়িতে করে যাতায়াত করেছেন।

 

মুক্তিযোদ্ধা যে দলেরই হোক তাকে সম্মান দিতে হবে

নির্বাচনী সহিংসতায় বেশ কয়েকটি প্রাণ হারিয়েছে। সাধারণ মানুষের পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপরও হামলা হয়েছে। অনেক প্রার্থী নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন। এগুলো নির্বাচনের ওপর একটি দাগ। এ ক্ষেত্রে নির্বাচন শান্তিপূর্ণ হবে বলে আমাদের যে প্রত্যাশা ছিল তা পূরণ হয়নি। তবে যে দল বিজয়ী হবে তাদের ওপর আমাদের বেশকিছু প্রত্যাশা আছে। বিজয়ী দলকে মুক্তিযুদ্ধকে ধারণ করতে হবে। এ বিষয়ে যেন কোনো বিভ্রান্তি না থাকে। মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কোনো বিতর্ক থাকা যাবে না। ১৯৭৫ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত দেশের ইতিহাস বিকৃত করা হয়েছিল। একজন মুক্তিযোদ্ধা তিনি যে দলেরই হোন না কেন তাকে সম্মান দিতে হবে। সত্যিকার অর্থে প্রশাসনকে স্বচ্ছ হতে হবে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে আমাদের শক্ত অবস্থানে যেতে হবে। সংসদে বিরোধী দলকে আসন দিতে হবে। নতুন যে সরকার সংসদের দায়িত্ব নেবে তাদের সংসদীয় কমিটিতে বিরোধী দলের জন্য অবস্থান রাখতে হবে। টিআইবির মতো যেসব সংস্থা আছে সেগুলোকে হুমকি দেওয়া যাবে না। দুর্নীতি দমন কমিশনকে (দুদক) শক্তিশালী করে গড়ে তুলতে হবে। প্রয়োজনে দুদককে স্বয়ংসম্পূর্ণ একটি প্রতিষ্ঠানে পরিণত করতে হবে। দুদকের সরকারি সিদ্ধান্তের বাইরে নিজের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা থাকতে হবে। দেশের মেগা প্রকল্পের যেগুলোয় হাত দেওয়া হয়েছে তা দ্রুত শেষ করার জন্য উদ্যোগ নিতে হবে। আগামী তিন বছরের মধ্যে নতুন বিমানবন্দর তৈরির কাজ শেষ করতে হবে। ঢাকা-চট্টগ্রাম লাইনে বুলেট ট্রেনের মতো রেলওয়ের মেগা প্রকল্পগুলো দ্রুত গতিতে শেষ করতে হবে। জনজীবনে শৃঙ্খলা আনতে হবে। কিশোরদের নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনের দাবি মেনে দেশের সড়কগুলো শতভাগ নিরাপদ করতে হবে। নতুন সরকারকে তাদের দেওয়া ইশতেহারের শতভাগ বাস্তবায়ন করতে হবে। ইশতেহার যেন শুধু লোক দেখানো এবং প্রতারণামূলক না হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। একইসঙ্গে আমরা প্রত্যাশা করছি নতুন গঠিত সরকার প্রতিহিংসা ও প্রতিশোধের রাজনৈতিক চর্চা করবে না। কারণ এমনটি করলে দেশ আবারও বিভাজিত হবে। ১০০ দিনের কর্মপরিকল্পনা নিতে হবে। আইসিটি অ্যাক্ট তুলে দিতে হবে। তবে ফেসবুকে যারা মানুষকে নিয়ে কটূক্তি করে এবং নারীদের হয়রানি করে তাদের বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে হবে। আবার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা ও মুক্তমত প্রকাশে যাতে কোনো বাধা না থাকে তা নিশ্চিত করতে হবে।

 

নারীর ক্ষমতায়ন ও অগ্রযাত্রা অব্যাহত থাকুক

দলীয় সরকারের অধীনে এ নির্বাচন মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে আরও জোরদার করবে। এ বিজয় মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং ৩০ লাখ শহীদের সম্মান আরও বাড়িয়ে দেবে। এ ভোটে পোশাক পাল্টানো নীতিহীন রাজনীতিবিদদের চেহারা উন্মোচিত হয়েছে। তরুণরা ডিগবাজি দেওয়া নীতিহীন রাজনীতিকে সাপোর্ট করে না। জাতির পিতার সঙ্গে তার আদর্শে যারা রাজনীতি করতেন তারা কীভাবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিপক্ষে অবস্থান নেন তা দেখার বিষয়। এ নির্বাচন রাজনীতিতে একটা ভিন্ন মাত্রা তুলে ধরেছে। তরুণ ভোটাররা এ নির্বাচনের গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর। তারা একইসঙ্গে লোকাল ও গ্লোবাল। নারীর ক্ষমতায়নের অগ্রযাত্রা অব্যাহত থাকবে এ প্রত্যাশা থাকবে আগামীর সরকারের কাছে।

 

 

শিল্পনির্ভর অর্থনীতির অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখতে হবে

আমি এবং আমার মেয়ে সেগুনবাগিচায় ভোট কেন্দ্রে ভোট দিতে গেলেও ভোটার নম্বরের জটিলতার কারণে শেষ পর্যন্ত ভোট দিতে পারিনি। তবে নতুন সরকারের কাছে এই অর্থনীতিবিদের প্রত্যাশা দলমতনির্বিশেষে বেসরকারি খাতের যে উত্থান ঘটেছে বিশেষ করে শিল্পনির্ভর অর্থনীতির যে অগ্রযাত্রা তা অব্যাহত রাখতে হবে। বাংলাদেশের উন্নয়ন নিয়ে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন স্বীকৃতি যেমন উন্নয়নশীল দেশ হয়ে ওঠা ও এসডিজিবিষয়ক বিভিন্ন লক্ষ্য অর্জনের ব্যাপারে নতুন সরকারকে আরও যত্নশীল হতে হবে। কেননা কোনো কারণে এগুলোর লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হলে আমরা উন্নয়নশীল দেশ গঠন করতে পারব না। এর পাশাপাশি তরুণদের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। কেননা কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা গেলেই আয়-ব্যয়ের বৈষম্য কমবে। সেইসঙ্গে আর্থিক খাতে ডিসিপ্লিন আনতে হবে।

 

দুর্নীতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করতে হবে

রাজধানীর রাজউক স্কুল অ্যান্ড কলেজ কেন্দ্রে ভোট দেন। তিনি নতুন যে সরকার গঠন হবে তাদের মাধ্যমে সৌহার্দ্য ও শান্তিপূর্ণভাবে বাংলাদেশের ব্যবসায়িক অগ্রযাত্রা আরও বেগবান হবে বলে প্রত্যাশা করেন। নতুন সরকারের ইতিবাচক উদ্যোগ গ্রহণের ফলে ব্যবসা-বাণিজ্যের পরিবেশ আরও অনুকূলে যাবে এবং বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশও এগিয়ে যাবে। দেশের অসমাপ্ত যে বড় প্রকল্পগুলো রয়েছে তা শেষ করতে হবে। একইসঙ্গে আইনের শাসন কার্যকর করতে হবে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করতে হবে। নতুন নতুন কর্মসূচি গ্রহণের মাধ্যমে তরুণদের জন্য কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে।

 

ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে হবে

ঘোড়াশালে পাইলট হাইস্কুলে ভোট দিয়েছেন। নতুন সরকারের কাছে তার প্রত্যাশা হচ্ছে ব্যবসার ক্ষেত্রে সহজীকরণ পদক্ষেপ গ্রহণ। অ্যাজ অব ডুয়িং বিজনেস ইনডেক্স অনুযায়ী ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিতে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। একইসঙ্গে দুর্নীতিতে জিরো টলারেন্স নীতি অনুসরণ ও দেশে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার ব্যাপারেও নতুন সরকারকে ভূমিকা রাখতে হবে। তিনি বলেন, আমরা আশা করছি যে নির্বাচনের ফলাফলে স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির পরাজয় হবে। ভোটের আগে ব্যবসায়ীরা এক সম্মেলনে সরকারের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্যে উন্নয়নের ধারাবাহিকতা রক্ষার জন্য ধরে ধরে বিভিন্ন সমস্যা চিহ্নিত করেছেন। যদি একটি একটি করে এসব সমস্যার সমাধান করা যায় তবে তা সুষ্ঠু ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিতে ভূমিকা রাখবে বলে আমি আশাবাদী। এ ছাড়া ব্যবসার ক্ষেত্রে যে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা রয়েছে তা দূর করার জন্য নতুন সরকারের কাছে আহ্বান জানিয়েছেন ব্যারিস্টার নিহাদ কবীর। তিনি বলেন, আমি মনে করি, ব্যবসা খাতের উন্নয়নে নতুন সরকার ১০০ দিনের একটি কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করলে তা হবে ইতিবাচক উদ্যোগ।

 

উন্নয়নের অগ্রযাত্রা শক্তিশালী করতে হবে

এটি নতুন সূর্যোদয়। বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষশক্তি টানা তৃতীয়বারের মতো সরকার গঠন করতে চলেছে। নতুন বছরে নতুন সরকারের কাছে প্রত্যাশা থাকবে উন্নয়নের অগ্রযাত্রাকে আরও শক্তিশালী করার।

গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি আরও বলেন, নারী ও তরুণ ভোটাররা বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনা নিয়ে ভোট দিয়েছে। এ সরকার মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে আরও শক্তিশালী করবে বলে আমি আশাবাদী। তারা দেশের উন্নয়নকে এগিয়ে নিতে কাজের ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখবে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে জয়যুক্ত করতে ভোটাররা ভালোবাসার জায়গা থেকে ভোট দিয়েছেন। আশা করি নতুন যারা দায়িত্ব নেবেন তারা জনমতকে মূল্যায়ন করবেন।

সর্বশেষ খবর