সোমবার, ৩১ ডিসেম্বর, ২০১৮ ০০:০০ টা

সংগঠনের মাধ্যমে সমাজকে সুসংগঠিত করতে হবে

সালেহা বেগম

শিক্ষা, সংস্কৃতি, সমাজসেবা, জনসচেতনতা, সুনাগরিকত্ব ইত্যাদিসহ সব ধরনের সামাজিক উন্নয়নে কাজ করার লক্ষ্যেই সংগঠন প্রতিষ্ঠা করা হয়। সংগঠন একদিকে জীবনের পরিধি বিস্তৃত করে অন্যদিকে মানুষকে স্বপ্ন দেখতে শেখায়। মানুষকে আত্মবিশ্বাসী করে কাজের প্রেরণা ও সাহস জোগায়। সংগঠন মানবকল্যানমূলক কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকার ফলে মানব মনে একটা সুখ অনুভূত হয়। এরিস্টটল বলেছেন,

Pleasure in the job put perfection in the work.সংগঠন মানুষকে নেতিবাচকতা থেকে বেরিয়ে আসতে সহযোগিতা করে, হতাশা ও দুখঃবোধ থেকে মানুষকে মুক্ত করে। অন্যকে সহযোগিতা করার মানসিকতা ও সহমর্মিতার মনোভাব তৈরি করে। জীবনকে শুদ্ধভাবে উপভোগ করার পরিস্থিতিও তৈরি করে দেয়। মানুষের মধ্যে নেতৃত্বের গুণাবলি, দায়িত্বশীলতা, সহনশীলতা, নৈতিকতা ও সামাজিক দায়বদ্ধতা বাড়িয়ে তোলে। সংগঠনের লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ও প্রকৃতি নির্ভর করে সে সমাজের সংস্কৃতির ওপর। তাই সংগঠনের গুণাগুণ সংস্কৃতির ধরনের ওপর অনেকখানি নির্ভর করে। নিজ সমাজের জীবনযাত্রা ও শিক্ষার মধ্যদিয়ে জনগণ তাদের পরিবেশকে সমৃদ্ধ ও উন্নত করার চিন্তা ও চেষ্টা করে থাকে। সংস্কৃতি যেমন ব্যক্তি জীবনের তেমনি সমাজ জীবনেরও প্রতিফলন।

এ পরিপ্রেক্ষিতে উল্লেখ করা যেতে পারে, দীর্ঘ সময় এ দেশ পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ ছিল। পাল আমল, সেন আমল, পাঠানদের শাসন, মোগলদের শাসন, ব্রিটিশ শাসন এবং সবশেষে পাকিস্তানের শাসন আমল। ফলে নিজেদের ভালো-মন্দ নিজেরা নির্ধারণের সুযোগ আমাদের ছিল না। তাই দেশের উন্নয়নে উপযুক্ত সংগঠন তৈরি করার সাহসও শুরুতে আমাদের হয়ে ওঠেনি। নানা ঘাত-প্রতিঘাতে এখানকার জনগণের মধ্যে সব সময় একটা নিরাপত্তার অভাববোধ তৈরি হয়। এ কারণেই আত্মস্বার্থ বিষয়টিও মনের গভীরে গ্রথিত হতে থাকে। যুগে যুগে নানা পরিবর্তনের মাধ্যমে এক সময় এ দেশের অনেক চিন্তাশীল ব্যক্তির চেতনার প্রতিফলনে নিজস্ব একটি সংস্কৃতির ধারা বিকশিত হয়। তারা হচ্ছেন বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ, সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, শ্রী অরবিন্দ, নীহার রঞ্জন রায়, মোতাহার হোসেন, আবুল মনসুর আহম্মদ, আবুল ফজল, আহম্মদ শরীফ প্রমুখের নাম উল্লেখ করা যেতে পারে। ভারতীয় সংস্কৃতির ভিত্তি গ্রন্থে শ্রী অরবিন্দ লিখেছেন, ‘পৃথিবীকে স্বর্গে উন্নীত করাই সংস্কৃতির জীবন্ত লক্ষ্য।’ এতে এটা অনুমেয় যে, ব্যক্তিগত ও সম্মিলিত সংস্কৃতি অবলম্বন করে মানুষকে পর্যায়ক্রমে পূর্ণতার দিকে এগিয়ে চলতে হয় আর এরই ধারাবাহিকতা এক প্রজম্ম  থেকে আরেক প্রজম্মে  সঞ্চারিত হয়। আমরা এমন একটি সময়ও পেয়েছিলাম, যখন এ দেশের মানুষের মধ্যে একে অন্যের প্রতি সহমর্মিতা, সহনশীলতা, ভালোবাসা ও শ্রদ্ধাবোধ বিরাজ করছিল। মানুষের চরিত্রে নৈতিকতা, মূল্যবোধ, নিষ্ঠা, সত্যবাদিতাকে মূল্যায়ন করা হত। পরিবার, পাড়া-প্রতিবেশী, বিভিন্ন সংগঠনের মধ্যে সৌহার্দ বিদ্যমান ছিল। একের প্রয়োজনে অন্য সবাই সহযোগিতা দেয়ার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। সম্প্রীতি-সৌজন্যবোধ, অন্যের প্রতি সম্মান প্রদর্শন, বড়দের প্রতি শ্রদ্ধা, ছোটদের প্রতি স্নেহ-ভালোবাসা ছিল অফুরান। সমাজবদ্ধ হয়ে আনন্দে-উৎসবে, বিভিন্ন অনুষ্ঠান উদ্যাপনে, দৈনন্দিন জীবনযাপনে সুখের ছোঁয়া এদেশের জনমনে এসেছিল এবং সেটাই ছিল আমাদের সংস্কৃতি। যারা পঞ্চাশ ও ষাটের দশক দেখেছেন, সে সময় এত সুযোগ-সুবিধা, প্রাপ্তি, প্রত্যাশা বা আকাক্সক্ষা, এত প্রাচুর্য  ছিল না কিন্তু একের দুঃখে অন্যরা কাতর হতো, সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিত। সে সময় ছোটরা, পরিবারে, বিদ্যালয়ে ও সমাজের ব্যক্তিদের মধ্যে কাউকে না কাউকে ভালোবাসত, ভক্তি করত এবং নিজের আদর্শ মডেল মনে করে সেই আদর্শে নিজেকে পরিচালিত করার চেষ্টা করত।

কিন্তু বর্তমান বাস্তবতায় এ মনোভাব থেকে অনেকটাই সরে এসেছে সারা বিশ্বের মানবসমাজ। আমাদের দেশে বিষয়টি আরও বেশি গুরুতর ও কঠিন রূপ ধারণ করছে সময়ের ব্যবধানে। মানুষের মধ্যে অসহিষ্ণুতা, অস্থিরতা এবং সামাজিক অবক্ষয়তা বেড়েই চলছে। এগুলো দূর করতে প্রয়োজন সুস্থ সংস্কৃতির বিকাশ। এটা বিশ্বাস করা যায় যে, সংগঠনের মাধ্যমে সামাজিক সুস্থতা আনা সম্ভব। বস্তুত ব্যক্তির সঙ্গে সমাজের বন্ধন যখন দুর্বল হয়ে পড়ে তখন সমাজে নানা ধরনের সংঘাত, বিশৃঙ্খলা ও অনাকাক্সিক্ষত পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। মনে রাখা প্রয়োজন, জনমানুষের একের সঙ্গে অপরের  সম্পর্ক যত গভীর, সহমর্মিতাপূর্ণ, আন্তরিক ও সৌহার্দপূর্ণ হবে, সমাজ ততটাই সুন্দর ও নির্ভরযোগ্য হয়ে উঠবে। আমাদের আদি সংস্কৃতি ছিল জনগণের সুস্থ-স্বাভাবিক বিকাশমান সংস্কৃতি। এর মূল লক্ষ্য ছিল সব জনগোষ্ঠীর ও শ্রেণির মানুষের কল্যাণ সাধন এবং সেই সময় থেকেই সংগঠনের মাধ্যমেই জনকল্যাণ সাধনের উদ্যোগ নেয়া। কারণ সৃষ্টিশীল কাজের মাধ্যমেই মানব মনে মূল্যবোধ তৈরি করা সম্ভব। পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে ছোটদের জন্য নানা সংগঠন ছিল, যেমন মুকুল ফৌজ, খেলাঘর, ব্রতচারী ও ব্লু-বার্ড ইত্যাদি। কিশোরদের, বয়স্ক পুরুষদের ও মহিলাদের সবার জন্যও নানা সংগঠন ছিল। বর্তমানে এসব সংগঠনের সংখ্যা মোটামুটিভাবে নেহায়েতই কম। যেগুলো রয়েছে তাতে মতদ্বৈততা, শৃঙ্খলার অভাব এবং জনকল্যাণমূলক কার্যক্রম তেমন একটা পরিলক্ষিত হচ্ছে না। এর মূল কারণ হচ্ছে আত্মস্বার্থের প্রবল আকাক্সক্ষা যা সমষ্টিগত সমৃদ্ধি বা সমষ্টিগত অস্তিত্বের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে অশালীনভাবে। সংগঠনগুলো পরিচালিত হচ্ছে মুষ্টিমেয় কিছু লোকের আধিপত্যে, ভিন্নমত প্রকাশের সুযোগ সেখানে থাকছে না। ফলে সংঘাত, অসহিষ্ণুতা, সর্বগ্রাসী আত্মস্বার্থপরতার কারণে অস্থিরতা বিরাজ করছে সংগঠনগুলোতে। এমতাবস্থায় দেশের জনগণ প্রায় দিশেহারা, যুবসমাজও হানাহানিতে সম্পৃক্ত হয়ে বিপথে ধাবিত হচ্ছে। সত্যি কথা বলতে গেলে, যুব থেকে বয়স্ক সব জনগণের সংগঠনের মধ্যে একই অবস্থা বিরাজ করছে।

লেখক : কলাম লেখিকা

সর্বশেষ খবর