সোমবার, ৩১ ডিসেম্বর, ২০১৮ ০০:০০ টা
ধর্মতত্ত্ব

হে মানুষ শুনে নিন সুন্দর হওয়ার কথা

মাওলানা সেলিম হোসাইন আজাদী

হে মানুষ শুনে নিন সুন্দর হওয়ার কথা

ব্যবহারেই বংশের পরিচয়। কারও ব্যবহার সুন্দর হলে তার অন্যান্য গুণ যেমন অর্থ-সম্পদ কিংবা বংশীয় মর্যাদা না থাকলেও মানুষের চোখে সে মর্যাদাবান ও সম্মানীত হয়ে ওঠবে। আর কারও যদি এ গুণটিই না থাকে তাহলে তার যতই অর্থবিত্ত-বংশীয় গৌরব থাকুক না কেন, মানুষের হৃদয়ে সে আসন গেড়ে বসতে পারবে না। তাই পবিত্র কোরআন এবং রাসুল (সা.) এর সুন্নাহ বারবার সুন্দর ব্যবহার এবং আদবকায়দা শেখা ও চর্চার ব্যাপারে গুরুত্ব দিয়েছে। সূরা তাহরিমের ৬ নম্বর আয়াত, ‘তোমরা নিজেদের ও পরিবার-পরিজনকে রক্ষা করো’ এর ব্যাখ্যায় তাবেয়ি মুজাহিদ (রহ.) বলেন, ‘তোমরা নিজেদের ও পরিজনকে আল্লাহর ভয়ের নির্দেশ দাও এবং তাদের সুন্দর ব্যবহার শিক্ষা দাও।’

সুন্দর ব্যবহার মানে হলো, সুন্দর বক্তব্য, চারুভাষণ, কথার লাবণ্য, ভদ্র আচরণ, শিষ্ট ব্যবহার, পরিপাটি অবয়ব, নির্মল আত্মা ও মহৎ চরিত্র। মানুষের সঙ্গে কোমল আচরণ করাই সুন্দর ব্যবহারের বড় বৈশিষ্ট্য। আমি খুব সুন্দর করে কথা বলি, মার্জিত পোশাক পরি, মানুষ আমাকে দেখলে সম্মান করে, দাঁড়িয়ে যায়, তাদের কাজ বন্ধ করে আমাকে অনুসরণ করে, কিন্তু মানুষের সঙ্গে আমার আচরণ পশুর মতো নির্মম, আমার কথা শুনে হাসি মুখ গোমরা হয়ে যায়, কারও আনন্দ নষ্ট হয়ে যায়, তার মানে হলো আমি এখনো সুন্দর সুন্দর মানুষ হওয়ার গুণ অর্জন করতে পারিনি।

জ্ঞানীরা বলেছেন, তিনটি স্বভাব থাকলে কেউ গরিব হয় না। সুন্দর ব্যবহার। কাউকে কষ্ট না দেওয়া ও সন্দেহ-সংশয় থেকে মুক্ত থাকা। ইবনে কায়্যিম (রহ.) বলেছেন, ‘মানুষের সুন্দর ব্যবহার তার সৌভাগ্য ও সফলতার প্রতিচ্ছবি। অসুন্দর ব্যবহার দুর্ভাগ্য ও ধ্বংসের চিহ্ণ। সুন্দর ব্যবহারের মতো আর কিছু দুনিয়া ও আখেরাতের কল্যাণ বয়ে আনে না। সুন্দর ব্যবহার সম্পর্কে আবু উমামা বাহেলি (রা.) এর বর্ণিত হাদিসটি অন্যতম। তিনি বলেন, রসুল (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি নিজেকে সঠিক জেনেও তর্ক-বিতর্ক থেকে বেঁচে থাকে, তার জন্য জান্নাতে একটি বাড়ি রয়েছে। যে ব্যক্তি মিথ্যা বলা থেকে বিরত থাকে, তার জন্য জান্নাতের ঠিক মাঝ বরাবর একটি বাড়ি রয়েছে। আর যে ব্যক্তি সুন্দর ব্যবহারের চর্চা করেছে, তার বাড়ি জান্নাতের সবচেয়ে উঁচু স্থানে রয়েছে। (আবু দাউদ)।

একদিন সাহাবিরা বললেন, হুজুর! ওই মহিলা রাত জেগে তাহাজ্জুদ পড়ে, দিনভর রোজা রাখে এবং ইসলামের কাজ করে। কিন্তু তার ব্যবহার সুন্দর না। রসুল (সা.) বললেন, সে জাহান্নামের জীবনযাপন করছে। আরেকজন মহিলা সম্পর্কে সাহাবিরা বললেন, হুজুর! আরেকজন মহিলা আছে, উনি অতবেশি ইবাদতগুজার নয়। তবে তার ব্যবহার এত সুন্দর, এত মিষ্টি যে, তার কাছে গেলেই মন হেসে ওঠে। হৃদয় নেচে ওঠে। হতাশা কেটে যায়। রসুল (সা.) বললেন, সে জান্নাতি জীবনযাপন করছে। (মিশকাত)।

আবদুল্লাহ ইবনে মুবারক (রহ.) বলেন, ‘আমাদের বেশি জ্ঞান শেখার চেয়ে সুন্দর ব্যবহার অল্প শেখাও যথেষ্ট।’ ইমাম মালেক (রহ.) বলেন, ‘আমার মা আমাকে পাগড়ি পরিয়ে দিয়ে বলতেন, জ্ঞানসম্রাট রাবিআর কাছে যাও। প্রথমে তার কাছে সুন্দর ব্যবহার শিখবে। তারপর শিখবে জ্ঞান।’ আবদুল্লাহ বিন ওহাব (রহ.) বলেছেন, ‘ইমাম মালেক (রহ.) আমাদের যতটুকু জ্ঞান শিখিয়েছেন, তার চেয়ে বেশি শিখিয়েছেন সুন্দর ব্যবহারের কলাকৌশল।’ ইসমাইল ইবনে উলাইয়্যা (রহ.) বলেন, ‘আহমাদ (রহ.) এর মজলিসে পাঁচ হাজার বা তার চেয়ে বেশি লোক সমবেত হতো। তাদের মধ্যে পাঁচশ লোক লিখতেন আর বাকিরা তার  থেকে সুন্দর চরিত্র ও আচরণ শিখতেন।’

খতিবে বাগদাদি (রহ.) বলেন, ‘হাদিসের শিক্ষার্থীদের কর্তব্য হলো, তারা মানুষের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সুন্দর ব্যবহারের অধিকারী হবে, সবচেয়ে বেশি বিনয়ী হবে, পবিত্রতা ও ধার্মিকতায় সবার চেয়ে বড় হবে, ক্রোধ ও হঠকারিতায় সবার চেয়ে স্বল্প হবে। কারণ সবসময় তাদের কানে বাজতে থাকে এমন সব হাদিস, যেগুলো ধারণ করে রসুলুল্লাহ (সা.) এর সর্বোত্তম চরিত্রগুলো, তাঁর আদব ও শিষ্টাচারগুলো, তাঁর পরিবার ও সাহাবিদের শ্রেষ্ঠ ও মহৎ পূর্বসূরিদের জীবনচরিত, হাদিস বর্ণনাকারীদের পাথেয়, আগের লোকদের ঐতিহ্য, ফলে সেখান থেকে তারা সবচেয়ে সুন্দর ও সবচেয়ে ভালোটা গ্রহণ করবে, সবচেয়ে মন্দ ও খারাপটা থেকে বিরত থাকবে।’ আল্লাহ তায়ালা আমাদের সুন্দর ব্যবহারের জীবন ধারণ করে জান্নাতি হওয়ার তাওফিক দিন।

লেখক : বিশিষ্ট মুফাসসিরে  কোরআন ও গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব।

চেয়ারম্যান : বাংলাদেশ মুফাসসির সোসাইটি।

www.selimazadi.com

সর্বশেষ খবর