বাংলাদেশ অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নে উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য রোল মডেল হিসেবে বিবেচিত। এ দেশের উন্নয়নের সামগ্রিক চিত্র প্রতিফলিত হয় অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে বিভিন্ন সূচকের ধারাবাহিক অগ্রযাত্রার মাধ্যমে। ইতিমধ্যে বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। এ মুহূর্তে আমাদের দারিদ্র্যের হার ২১% এবং গড় আয়ু ৭৩ বছর। বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু আয় ১৭৫২ ডলার এবং জিডিপি ৭.৮৬%। পর্যটন শিল্পের অবদান বাংলাদেশের জিডিপিতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ৪.৩% এবং সরাসরি প্রায় ১৩ লাখ লোক এ কাজে জড়িত। পর্যটনই একমাত্র শিল্প যা কোনো রাষ্ট্রের সামাজিক ও পরিবেশগত উন্নয়ন ঘটায়।
পর্যটন শিল্প হতে পারে সামগ্রিক উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়নের একটি হাতিয়ার। এটি শুধু অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করবে না বরং নাগরিকদের আর্থ-সামাজিক নিরাপত্তাবিধানে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে। পর্যটন একটি শ্রমঘন শিল্প। এ শিল্পটি সাম্প্রতিক বছরগুলোয় বিশ্বব্যাপী অর্থনীতির একটি দ্রুততম ও ক্রমবর্ধমান খাত হিসেবে গড়ে উঠেছে এবং সেই সঙ্গে আঞ্চলিক ও জাতীয় অর্থনৈতিক উন্নয়নে অবদান রাখার জন্য স্বীকৃত হয়েছে। অর্থনৈতিক বৈচিত্র্য আনয়নে ও অন্য শিল্পসমূহের ওপর নির্ভরশীলতা কমাতে পর্যটন শিল্প উন্নয়নশীল দেশগুলোয় ব্যাপক সফলতা বয়ে আনছে। গবেষণায় প্রতীয়মান হয়, এ শিল্পটি ১০৯টি খাতের সঙ্গে সম্পৃক্ত।
![](/assets/archive/images/Print-Edition/2019/January%20-%202019/27-01-2019/bd-2a-2019-01-27-4.jpg)
বর্তমানে পর্যটন শিল্পের উন্নয়নের জন্য সরকার এলাকাভিত্তিক বিভিন্ন উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করে আসছে; যার ফলে পর্যটন শিল্পে নীরব বিপ্লব ঘটবে বলে আশা করা যাচ্ছে। এসব উন্নয়ন পরিকল্পনার মধ্যে সম্প্রতি কক্সবাজার থেকে টেকনাফ পর্যন্ত সাগরের পাড় বেঁধে ৮০ কিলোমিটার দীর্ঘ মেরিন ড্রাইভ নির্মাণ অন্যতম। এর ফলে দেশি-বিদেশি পর্যটকের কাছে পর্যটননগর কক্সবাজারের আকর্ষণ আরও বাড়িয়ে দেবে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে পর্যটক আকর্ষণে কক্সবাজারে তিনটি পর্যটন পার্ক তৈরির পরিকল্পনা করেছে বর্তমান সরকার। প্রতি বছরে এতে বাড়তি ২০০ কোটি মার্কিন ডলারের অর্থনৈতিক কার্যক্রমের সুযোগ সৃষ্টি হবে। এ তিনটি ট্যুরিজম পার্ক হলো সাবরাং ট্যুরিজম পার্ক, নাফ ট্যুরিজম পার্ক ও সোনাদিয়া ইকো ট্যুরিজম পার্ক। এসব স্থানে প্রায় ৪০ হাজার কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে।
বর্তমান সরকারের কিছু পদক্ষেপ বিশেষ করে নাফ ট্যুরিজম পার্ক গড়ে তোলার ঘোষণা পর্যটন বিকাশকে ত্বরান্বিত করবে। কারণ এতে বিনিয়োগ করছে থাইল্যান্ডের বিখ্যাত কোম্পানি সিয়াম সিয়াম ইন্টারন্যাশনাল। প্রাথমিকভাবে কোম্পানিটি ৫০ কোটি মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করবে। ২৭১ একর জায়গাজুড়ে প্রায় ৪ হাজার ২০০ কোটি টাকার এ প্রকল্পটি ১২ হাজারের বেশি লোকের কর্মসংস্থান জোগাবে। আর এ নাফ ট্যুরিজম পার্ক উন্নয়নের প্রকল্প ব্যয় ১৭০ কোটি টাকা এবং এ প্রকল্প বাস্তবায়নের সময় নির্ধারণ করা হয়েছে ২০১৯ সাল। ইতিমধ্যে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা) নাফ ট্যুরিজম পার্কের উন্নয়ন কাজ হাতে নিয়েছে। অন্যদিকে সাবরাং ট্যুরিজম পার্ক স্থাপনে প্রয়োজনীয় সমীক্ষা সম্পন্ন করেছে। অন্যদিকে সোনাদিয়া ইকো ট্যুরিজম পার্ক স্থাপনের উদ্দেশ্যে বেজা সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে মতবিনিময় করছে। এ ছাড়া কক্সবাজারের টেকনাফে প্রস্তাবিত নাফ ও সাবরাং ট্যুরিজম পার্কের অবকাঠামো উন্নয়নে ১ শতাংশ সুদে ঋণ গ্রহণের সিদ্ধান্ত হয়েছে। সরকারের কাছ থেকে এ ঋণ নেবে বেজা। যে কোনো ক্ষেত্রে উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড সম্পাদনের লক্ষ্যে সিদ্ধান্ত গ্রহণে গুরুত্বপূর্ণ তথ্যের ব্যবহার পারে টেকসই উন্নয়ন সম্ভাবনা নিশ্চিত করতে। তাই গবেষণাধর্মী কার্যক্রম বৃদ্ধির মাধ্যমে সিদ্ধান্ত গ্রহণে উপযোগী তথ্যের উদ্ঘাটন ও সংরক্ষণ নিঃসন্দেহে জনকল্যাণে সমৃদ্ধি আনয়নে উল্লখযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারে। অপার সম্ভাবনাময় ও প্রাকৃতিকভাবে সৌন্দর্যমণ্ডিত হওয়া সত্ত্বেও মহান স্বাধীনতা অর্জনের ৪৭ বছরেও আমরা পুরোপুরি সক্ষম হইনি পর্যটন খাতকে ঢেলে সাজাতে। তবে বর্তমান বছরগুলোয় সরকারসহ বেসরকারি অনেক প্রতিষ্ঠান পর্যটনকে অর্থনৈতিক একটি কার্যকর খাত হিসেবে রূপান্তরে সচেষ্ট হয়েছে। তাই পর্যটন শিল্পের বিকাশে গবেষণাধর্মী কর্মকাণ্ড বৃদ্ধির লক্ষ্যে দেশের সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় পর্যটনের ওপর উচ্চশিক্ষা প্রদানের ব্যবস্থাসহ বেসরকারি পর্যায়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান প্রতিনিয়ত অনুমোদন দিচ্ছে।
বাংলাদেশের উন্নয়নযাত্রায় পর্যটন শিল্পের সংযোজন শুধু আর্থিক সুফলতা বয়ে আনবে না, সেই সঙ্গে প্রান্তিক পর্যায়ে এর সুফল ছড়িয়ে দেবে স্থানীয়দের অংশগ্রহণের মাধ্যমে। ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের ক্ষেত্রে পর্যটন শিল্প বাংলাদেশের জন্য হয়ে উঠতে পারে অন্যতম হাতিয়ার। এজন্য প্রয়োজন সরকারের উন্নয়ন ভাবনায় পর্যটন শিল্পকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া।
লেখক : চেয়ারম্যান, ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।