শিরোনাম
বুধবার, ৩০ জানুয়ারি, ২০১৯ ০০:০০ টা

আওয়ামী লীগের মহাদুঃসময়ে ওরা কোথায় ছিল?

পীর হাবিবুর রহমান

আওয়ামী লীগের মহাদুঃসময়ে ওরা কোথায় ছিল?

আজকাল মনে হয়, মাঝে মাঝে যা বলতে চাই তা বলা হয় না, যা বলতে চাই না তা বলা হয়। মাঝে মাঝে এমন হয়, যা লিখতে চাই তা লেখা হয় না। যা লিখতে চাই না, তা লেখা হয়। মাঝে মাঝে আরও মনে হয়, কখনোসখনো গণমাধ্যম প্রাণহীন হয়ে যাচ্ছে। আবার কখনোসখনো মনে হয়, সত্য উন্মোচনে গণমাধ্যমই ভূমিকা রাখছে। আবার এমনও হয়, গণমাধ্যম যেন কোথায় নিজেদের ছন্দপতন ঘটাচ্ছে। অনেকে বলেন, গণমাধ্যমও কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। অবাধ তথ্যপ্রবাহের যুগে মানুষের মুখে মুখে যে সত্য ভাসে, সোশ্যাল মিডিয়ায় যে খবর ছড়িয়ে যায় তা গণমাধ্যমে ঠাঁই পায় না। মানুষের মুখের ভাষা ও জানার সঙ্গেই নয়, সোশ্যাল মিডিয়ার সঙ্গেও গণমাধ্যম ইমেজ রক্ষার লড়াই করছে। যাক, কথা বললেই বাড়ে কথা। তারপর হৈচৈ কত কিছু হয়।

বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে উপমহাদেশের প্রাচীনতম রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ টানা তৃতীয়বারের মতো ক্ষমতায় এসেছে। আর বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা চতুর্থবারের মতো প্রধানমন্ত্রী হয়ে বিশ্বরাজনীতিতে আলোচিত ও আলোকিত রাষ্ট্রনায়কের জায়গা করে নিয়েছেন।

বিএনপি বা জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট এমনকি বাম গণতান্ত্রিক জোটও একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ফলাফল প্রত্যাখ্যান করেছে এবং একগাদা অনিয়মের অভিযোগ তুলেছে। নির্বাচনী ফলাফলে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট মুজিবকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দুই-তৃতীয়াংশ আসনে বিজয়ী হবে এমনটি অনেকেই মনে করেছেন। কিন্তু ফল প্রকাশের পর যে চিত্র দেখা গেছে, তাতে আওয়ামী লীগসহ দেশের সবাই বিস্ময়ের ঘোরে পড়েছিল। যে যত যুক্তিই দেখান না কেন বিশেষ করে বিএনপির দুর্গগুলো ভেসে যাওয়ায় এবং জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট বা বিএনপির অনেক জনপ্রিয় নেতার পরাজয়ই নয়, তাদের প্রাপ্ত স্বল্প ভোট বিস্ময়ের ঘোর বাড়িয়ে দেয়। বিএনপি ফলাফল দেখে শোকস্তব্ধ হয়ে পড়ে। আর বিজয়ী শক্তি বিস্মিত হয়ে যায়।

নির্বাচনের পর শেখ হাসিনা যে সরকার গঠন করেছেন, সেখানে দলের অভিজ্ঞ প্রবীণ মন্ত্রীদের যেমন রাখেননি তেমনি আত্মীয়স্বজন কাউকেই ঠাঁই দেননি। এমনকি মহাজোটের প্রধান শরিক জাতীয় পার্টি প্রকৃত বিরোধী দলের ভূমিকা সংসদে পালন করার ঘোষণা দিয়ে তাদের জায়গা পরিষ্কার করেছে। ১৪ দলের শরিকদেরও মন্ত্রিসভায় নেওয়া হয়নি। বলা হয়েছে বিরোধী দলে যেতে। নিজের পায়ে দাঁড়াতে। তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলে শাসক দলের কট্টর সমর্থকরা বলছেন, এবার সরকারেও মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী শক্তি, বিরোধী দলেও মুক্তিযুদ্ধের শক্তি। মাঝখানে মুক্তিযুদ্ধে বিরোধিতাকারী মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত ও নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন বাতিল হওয়া জামায়াতমুক্ত সংসদ হয়েছে। এখন জামায়াতকে নিষিদ্ধকরণের প্রক্রিয়া চলছে বলেও শোনা যাচ্ছে।

আওয়ামী লীগ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে লাখো মানুষের বর্ণাঢ্য মহাসমাবেশ করে বিজয় উৎসব করেছে। অন্যদিকে বিএনপি ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের মধ্যে টানাপড়েনই চলছে না, বিএনপির অভ্যন্তরেও নেতৃত্বের পরিবর্তনের আওয়াজ উঠেছে। বিএনপি ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট সংসদে যোগদান করবে না- এ সিদ্ধান্তে এখনো অটল রয়েছে। জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের বিজয়ী আটজনের দুজন গণফোরাম থেকে জয়ী হয়েছেন। এদের দুজনই সিলেট বিভাগ থেকে। একজন অপরিচিত লন্ডনপ্রবাসী মোকাব্বির খান মূলত জয়ী হয়েছেন নিখোঁজ ইলিয়াস আলীর স্ত্রী তাহসিনা রুশদীর লুনা খানের সমর্থনের কারণে। আরেকজন সারা দেশে পরিচিত সাবেক ডাকসু ভিপি ও আজীবন আওয়ামী লীগার সুলতান মোহাম্মদ মনসুর আহমদ। সুলতান মোহাম্মদ মনসুর ধানের শীষ নিয়ে বিজয়ী হলেও শরীর থেকে যেমন মুজিবকোট খোলেননি, তেমনি কণ্ঠ থেকে বঙ্গবন্ধুর নামও মুছে দেননি। তিনি ঐক্য প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। নিবন্ধনকৃত দল হিসেবে গণফোরামে নাম লিখিয়েছিলেন। ধানের শীষ নিয়ে প্রার্থী হলেও তাকে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীরাই অক্লান্ত পরিশ্রম করে বিজয়ী করে এনেছেন।

সুলতান আওয়ামী লীগ করেছেন। আওয়ামী লীগই করতে চেয়েছেন। ঐক্যফ্রন্ট ও গণফোরাম যাই বলুক না কেন তিনি এখন পরিষ্কার বলছেন, তিনি বিএনপি বা গণফোরামের কেউ নন। তাকে এলাকাবাসী বিজয়ী করেছেন এবং তারা চায়, তিনি সংসদে যাবেন। তাই তিনি সংসদে যাচ্ছেন। হাত ভেঙে যাওয়ায় শারীরিক অসুস্থতার কারণে শপথ নিতে বিলম্ব হচ্ছে। সংসদে ফিরে যাওয়ার মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগের সুলতান আওয়ামী লীগে ফিরে গেলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। এমনকি বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা তাকে যে স্নেহ দিয়ে ছাত্রলীগের সভাপতি ও ডাকসু ভিপি করেছিলেন, সেই স্নেহ দিয়ে মন্ত্রী করলেও আমার কাছে বিস্ময়কর কিছু মনে হবে না। মনে-প্রাণে, রক্তেমাংসে বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগে বিশ্বাসী সুলতান মনসুর আওয়ামী লীগ করবেন- এটাই স্বাভাবিক। এখানেও জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট বা বিএনপি আরেক দফা ভুল করেছে বলে মনে হচ্ছে। যদি ঐক্যফ্রন্টগতভাবে সংসদে যেতেন তাহলে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও সুলতান মোহাম্মদ মনসুর আহমদ সংসদ মাতিয়ে রাখতে পারতেন।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় অভিনন্দন জানিয়েছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পও তাঁকে অভিনন্দন জানাতে ভোলেননি। শুনেছি এতে রাগে-অভিমানে বিএনপি কার্যালয়ে এক নেতা আছাড় মেরে চেয়ার ভেঙে দিয়েছেন। শেখ হাসিনা নির্বাচনের পর জাতির উদ্দেশে যে ভাষণ দিয়েছেন সেখানে তাঁর দলের বিজয়ের কারণ যেমন ব্যাখ্যা করেছেন তেমনি বিএনপির পরাজয়ের কারণও উল্লেখ করেছেন। এটা সত্য, এ নির্বাচনে বিএনপি জামায়াতনির্ভর জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট শক্তিশালী প্রস্তুতি নিয়ে নেতা-কর্মীদের উজ্জীবিত করে যেমন গোছানো নির্বাচন করতে পারেনি, তেমনি জামায়াতকে সঙ্গে নিয়ে আত্মঘাতী সিদ্ধান্তই নেয়নি, তরুণ প্রজন্মের আড়াই কোটি নতুন ভোটারকে নিজেদের বিরুদ্ধে ঠেলে দিয়েছে।

অন্যদিকে বিএনপি যেখানে এক বছর ধরে শেখ হাসিনার অধীনে নির্বাচনে যাওয়া না যাওয়া নিয়ে নেতা-কর্মী-সমর্থকদের বিভ্রান্ত করেছে, তেমনি নির্বাচনে মনোনয়ন থেকে নির্বাচন পরিচালনার কার্যকর পরিকল্পনা নিতে পারেনি। অন্যদিকে টানা ১০ বছর ক্ষমতায় থাকার সুবাদে আওয়ামী লীগ সমাজের সব শ্রেণি-পেশার মানুষকে পক্ষে টেনে এনে এক বছর ধরে দলের মাঠকর্মীদের নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত ও উজ্জীবিত করেছে। আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের নেতৃত্বে নেতারা ট্রেন সফর করে নির্বাচনী হাওয়া অনুকূলে টেনেছেন। নায়ক-নায়িকাদেরও প্রচারণায় নামিয়েছেন। শেখ হাসিনার তত্ত্বাবধানে গোছানো, সুনির্দিষ্ট অঙ্গীকার উল্লেখ করে, নির্বাচনী ইশতেহার দিয়ে মানুষের মনে প্রভাব ফেলেছে। ডিজিটাল প্রচারণাসহ সব প্রচারণায় আওয়ামী লীগের নির্বাচনী নেটওয়ার্ক ছিল শক্তিশালী।

বিএনপি এখন ঢাকা উত্তরের সিটি মেয়র পদে নির্বাচন বর্জন করার ঘোষণা দিয়েছে। এমনকি উপজেলা নির্বাচনেও আর অংশগ্রহণ করবে না। এমনকি দলীয় সরকারের অধীনে এবং বর্তমান নির্বাচন কমিশনের অধীনে কোনো নির্বাচনে যাবে না বলে ঘোষণা দিয়েছে। বিএনপি এভাবে নির্বাচন বয়কট করে সব রাজনৈতিক সভা-সমাবেশ বন্ধ করে দল গোছানোর কাজে হাত না দিয়ে কীভাবে ঘুরে দাঁড়াবে, কীভাবে জনপ্রিয়তা থাকার পরও হারানো শক্তি পুনরুদ্ধার করবে? তার কোনো পথ এখনো জনগণের সামনে উন্মুক্ত করতে পারেনি। অন্যদিকে জনগণকে নিয়ে তীব্র গণআন্দোলন তৈরি করে সরকারকে রাজপথের সংগ্রাম দিয়ে বিদায় করতে পারবে এমন বিশ্বাস ও আস্থা কিংবা রূপরেখা দিতে পারেনি। এমন অবস্থায় নেতৃত্বহীন দুর্বল বিএনপির মাঠকর্মীদের, সমর্থকদের দলে ধরে রাখাই কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে।

এদিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে এবং বিজয় সমাবেশের বক্তৃতায় তাঁর রাষ্ট্র পরিচালনার রূপরেখা উন্মোচিত করেছেন। একে একে নির্বাচনী অঙ্গীকার পূরণের কথা যেমন বলেছেন, তেমনি জঙ্গিবাদ-সন্ত্রাসবাদ ও মাদকের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতিতে সাফল্য ও আস্থা অর্জন করে এবার দুর্নীতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন। দুর্নীতি দমন কমিশনের চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদও সাহসের সঙ্গে নিজের দক্ষতায় মানুষের আস্থা কুড়াতে দিনে দিনে সক্ষম হয়েছেন।

বক্তৃতা করেই প্রধানমন্ত্রী থেমে থাকেননি। রীতিমতো অ্যাকশনেও নেমেছেন। ডাক্তারদের হাসপাতালে না থাকলে ওএসডি করে দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। দুর্নীতি দমন কমিশনের চেয়ারম্যান একটি স্কুলে আকস্মিক পরিদর্শন করে আটজন শিক্ষকের জায়গায় সাতজনকেই অনুপস্থিত পাওয়ার খবরে তোলপাড় সৃষ্টি করেছেন। অতীতের প্রশ্ন ফাঁসের কারণে কোচিং সেন্টার বন্ধ হয়েছে। শিক্ষকদের ওপর সরকার ও আদালতই নয়, জনমতেরও চাপ সৃষ্টি হয়েছে ছাত্রছাত্রীদের লেখাপড়ায় মনোযোগ বাড়াতে। এর সঙ্গে দুর্নীতির লাগাম টানতে হলে ব্যাংকিং খাতের ঋণ, বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের প্রকল্প বাস্তবায়ন, বরাদ্দ, বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, অধিদফতরের কেনাকাটা, শিক্ষা ভবনসহ সকল ভবনে স্বচ্ছতা আনা এবং পুলিশসহ সরকারি চাকরিতে নিয়োগে স্বচ্ছতা আনতে হবে।

শেখ হাসিনার চমক মন্ত্রিসভার কেউ কেউ অভিজ্ঞ হলেও বড় সংখ্যাটি নতুন। তারা নিজেরাও নিজ নিজ মন্ত্রণালয়কে দুর্নীতিমুক্ত করতে সোচ্চার হয়েছেন। এদের মধ্যে কঠোর অবস্থানে সবচেয়ে আলোচিত হচ্ছেন ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরীর কঠোর মনোভাবের কারণে।

দেশে দেশে জঙ্গিবাদ-সন্ত্রাসবাদ ও মাদকের চেয়ে দুর্নীতির বিরুদ্ধে যুদ্ধে সাফল্য অর্জন করা অনেক বড় ও কঠিন চ্যালেঞ্জ। জাতির মহত্তম নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীন যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশে নরমে-গরমে, আকুতিতে, নির্দেশে দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছিলেন। তিনি তাঁর এক বক্তৃতায় বলেছিলেন, এর জন্য আমি আমার জীবন, যৌবন কারাগারে কাটাইনি। বিশ্বমোড়লদের নীলনকশা ও জাতীয়-আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র, স্বাধীনতাবিরোধী উচ্চাভিলাষী বিশ্বাসঘাতক শ্রেণি এবং লুটেরা গোষ্ঠী বঙ্গবন্ধুকে বাঁচতে দেয়নি। পরিবার-পরিজনসহ নৃশংস হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছেন তিনি। ক্ষমতাচ্যুত হয়েছিল আওয়ামী লীগ। আর নির্দয় অত্যাচারে ক্ষতবিক্ষত হয়েছে এমনকি কারাদহনই নয় তো নির্বাসিত জীবন নিতে হয়েছে নেতা-কর্মীদের।

আজ বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা দুর্নীতির বিরুদ্ধে যে কঠিন যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন, যে অবস্থান নিয়েছেন, দেশের মানুষের তাতে অকুণ্ঠ সমর্থন রয়েছে। দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ সৎ জীবনযাপনে অভ্যস্ত। তাদের অবস্থান বরাবর দুর্নীতির বিরুদ্ধে। কিন্তু এ কথা সত্য যে, রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় ও রাজনৈতিক শক্তির আশ্রয়-প্রশ্রয় এবং প্রশাসনের সহযোগিতায় বিগত ৪৭ বছর ধরে দুর্নীতি দিনে দিনে এতটাই বিস্তৃত হয়েছে যে, সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ক্যান্সারের মতো ছড়িয়েই পড়েনি, বোধহীন সমাজ দুর্নীতির বরপুত্রদের সমীহ করতেই শেখেনি, দুর্নীতি করে যারা অঢেল অর্থবিত্তের মালিক হয়েছে তাদের সমীহ করতে শিখেছে। এই যুদ্ধ তাই কঠিন যুদ্ধ।

বিএনপি-জামায়াতের পাপের শাসনামলের দুর্নীতির দায় এখন দলটি বহন করছে। কিন্তু বিগত ১০ বছর বিএনপি ক্ষমতার বাইরে ছিল। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আছে। তাহলে এই ১০ বছরে যারা ব্যাংকিং খাত লুট করেছে, শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারি করেছে, বিদেশে অঢেল অর্থ পাচার করেছে শেখ হাসিনার দুর্নীতিবিরোধী যুদ্ধ এদের শান্তির ঘুম হারাম করেছে। স্বাস্থ্য বিভাগের নিম্ন পর্যায়ের কর্মচারী আবজাল যেখানে দেড় হাজার কোটি টাকার মালিক হয়েছে দুর্নীতির মাধ্যমে, সেখানে ওই মন্ত্রণালয়ের উপরের দিকে বাকিদের অবস্থা কী তা সহজে অনুমান করা যায়। এমনকি ঘুষের টাকাসহ অনেক সরকারি কর্মকর্তা বিভিন্ন সময় গ্রেফতার হয়েছেন। শিক্ষা খাত, বিদ্যুৎ খাত থেকে রাষ্ট্রের বিভিন্ন সেবা খাতেই নয়, রাষ্ট্রের এমন কোনো প্রতিষ্ঠান নেই যেখানে দুর্নীতির শিকড় গভীরে বিস্তৃত হয়নি।

পৃথিবীর কোনো দেশ পুরো দুর্নীতিমুক্ত হতে পারেনি। বাংলাদেশও হবে এমনটি আশা করা যায় না। কিন্তু বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা সততার সঙ্গে দুর্নীতির বিরুদ্ধে যে যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন, সেখানে একদিকে তাঁর কঠোর অবস্থান, আইনের প্রয়োগ, অন্যদিকে সরকারের মন্ত্রী, এমপি, নেতারা সততা ও মূল্যবোধের পথে দৃঢ় অবস্থান নিলে দুর্নীতিকে অবশ্যই সহনীয় অবস্থায় নিয়ে আসা সম্ভব।

জাতির জীবনে দুর্নীতি অজগরের মতো একটি অভিশাপ। প্রধানমন্ত্রী পরিষ্কার বলেছেন, যেখানে বেতন বাড়ানো হয়েছে, সেখানে ঘুষ কেন বন্ধ হবে না? সরকারের মন্ত্রী, এমপি ও উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা যদি দুর্নীতির বিরুদ্ধে সংগঠিতভাবে ইমানের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ অবস্থান নেন, অ্যাকশনে যান সব ধরনের অনিয়ম-স্বজনপ্রীতি, কমিশন বাণিজ্য, তদবির বাণিজ্য, নিয়োগ বাণিজ্য বন্ধ করে দেন, কঠোর অবস্থান নেন, সংবিধান ও আইনের খড়্গ কার্যকর হয়, তাহলে জনগণকে নিয়ে দুর্নীতির বিরুদ্ধে গণজাগরণ ঘটিয়ে সাফল্য ঘরে তোলা সম্ভব।

শাসক দল আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের নির্লোভ, নিরাভরণ, সাদামাটা জীবনের রাজনীতির পূর্বসূরিদের আদর্শকে লালন করে এ যুদ্ধে অবতীর্ণ হতে হবে। কোনোক্রমেই ভাবা চলবে না যে, প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক শক্তি বিএনপি শেষ হয়ে গেছে। আমরাই ক্ষমতায় চিরস্থায়ী। অতএব যতটা পারো এ সুযোগে কামাও। সব লোভ পরিহার করে শেখ হাসিনার জাতীয় ঐক্যের ডাকে সাড়া দিয়ে দুর্নীতির বিরুদ্ধে গণজাগরণ ঘটাতে আদর্শিক চরিত্র নিয়ে ভূমিকা রাখার এখন সময়।

দুর্নীতির বিষাক্ত সাপের ফণা উদ্যত করার আগেই তাকে দমন করার নীতি বাস্তবায়ন করতে হবে। সন্ত্রাসীদের যেমন কোনো দল নেই, দুর্নীতিবাজ সুযোগসন্ধানী সুবিধাবাদীদের তেমন কোনো দল নেই। এরা দলের শত্রু, রাষ্ট্রের শত্রু। আজ সমাজের চতুর্দিকে দেশজুড়ে যত দূর চোখ যায়, কেবল আওয়ামী লীগ আর আওয়ামী লীগ দেখা যায়। বর্ণচোরা, সুবিধাবাদীরা ক্ষমতার ভাগবাঁটোয়ারা নিতে রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতায় বা ছত্রচ্ছায়ায় ব্যক্তিগত মুনাফা লুটতে এসে ভিড় করেছে। মৌমাছির মতো মধু আহরণে নাচতে নাচতে আসছে। আওয়ামী লীগকে এ গণজোয়ারের দিকে না তাকিয়ে তার আদর্শিক, ত্যাগী দুঃসময়ের নেতা-কর্মীদের মূল্যায়ন করতে হবে। আওয়ামী লীগকে দাম্ভিক হওয়া যাবে না, ক্ষমতার দম্ভে হুঁশ হারানো যাবে না, অতীতের দুঃসময়কে ভুলে যাওয়া যাবে না, দুঃসময়ের কঠিন যুদ্ধের পথের সাথীকে ভুলে যাওয়া যাবে না। বরং সেই বেদনার জায়গা থেকে অভিজ্ঞতা নিয়ে এই যুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ ভূমিকা রাখতে হবে।

বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের পর খুনিদের কাছে বিভিন্ন বাহিনীকে নত হতে দেখা গেছে যেমন, তেমনি আওয়ামী লীগ নেতৃত্বকেও প্রতিরোধের ডাক দিতে দেখা যায়নি। কেন্দ্রীয় কারাগারে জাতীয় চার নেতাকে হত্যা করাই হয়নি, খুনি মোশতাক থেকে সেনাশাসক জিয়াউর রহমানের শাসনামল পর্যন্ত আওয়ামী লীগের প্রায় সব নেতাসহ হাজার হাজার নেতা-কর্মীকে জেলে আটকে রাখা হয়েছে। নির্বাসিত জীবন দেওয়া হয়েছে। বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম প্রতিরোধযুদ্ধের ডাক দিয়ে হাজার হাজার তরুণকে সঙ্গে নিয়ে ইজ্জত বাঁচালেও আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব কোনো বৃহৎ আন্দোলন গড়ে তুলতে পারেনি। পিতৃহত্যার বিচারের দাবিতেও না।

সেনাশাসকদের অত্যাচার-নির্যাতন উগ্রপন্থি ও অতি বামদের প্রতিহিংসার রাজনীতিও সেদিন বঙ্গবন্ধুবিদ্বেষী ও আওয়ামী লীগবিরোধিতায় অবস্থান নিয়েছিল। সেদিন অনেকেই মনে করেছিলেন আওয়ামী লীগ শেষ। বঙ্গবন্ধু যেমন শেষ হননি, তাঁর নাম যেমন ২১টি বছর সেনাশাসকরা উচ্চারণ না করতে দিয়ে মুছে ফেলতে পারেনি দেশের মাটি ও মানুষ থেকে, তেমনি আওয়ামী লীগকেও নিশ্চিহ্ন করা যায়নি।

আজকে আওয়ামী লীগের কেউ কেউ যদি মনে করেন বিএনপি একেবারেই শেষ। সেটি হবে তোষামোদকারীদের, সুযোগ-সন্ধানীদের চাটুকারিতার অংশবিশেষ। আওয়ামী লীগবিরোধী রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে বিএনপিই থাকবে। যদিও নেতৃত্বহীন বিএনপি এখন নানামুখী চাপের কাছে নত, বিভ্রান্ত এবং দুর্বল হয়ে পড়েছে। তারা যদি দল গোছানো ও দীর্ঘমেয়াদি রণকৌশল নিয়ে রাজনীতির পথ গ্রহণ করে মুক্তিযুদ্ধের মীমাংসিত সত্যকে অস্বীকার না করে, জামায়াতের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে, তাহলে একদিন ঘুরে দাঁড়াতে পারবে।

আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের স্মরণ করতে হবে আজকে সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার যেসব লোক দলটির ছায়ায় এসে দাঁড়িয়েছে, পঁচাত্তরের পর ২১ বছর তারা কোথায় দাঁড়িয়েছিল? আওয়ামী লীগের মহাদুঃসময়ে মৌমাছিরা কোথায় মধু আহরণ করেছিল? এমনিক ২০০১ সালের নির্বাচনে পরাজিত হওয়ার পর বিএনপি-জামায়াত সরকারের প্রতিহিংসার বিষের ছোবলে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা যখন ঘরবাড়িছাড়া হয়েছে, একের পর এক হত্যার শিকার হয়েছে, কারাগারে নিক্ষিপ্ত হয়েছে, গ্রেনেড বোমায় রক্তাক্ত হয়েছে- তখন এসব সুবিধাভোগী, নির্লজ্জ, বেহায়ারা কোথায় ছিল?

আওয়ামী লীগকে অতীত ভুললে চলবে না। ছাত্রলীগের রাজনীতি থেকে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ বুকে নিয়ে শেখ হাসিনার নেতৃত্বের প্রতি আনুগত্য রেখে সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশা ও দলে যেসব মহিলা নিরন্তর পথ হেঁটেছেন; সংসদের সংরক্ষিত মহিলা আসনে তাদের পেছনে ফেলে বিএনপির ঘর করাসহ দুঃসময়ে দূরে থাকা নায়ক-নায়িকরা আজ প্রতিযোগিতার মিছিলে তাদের পেছনে ফেলে দিচ্ছে। দৃশ্যমান মঞ্চে আওয়ামী লীগের পোড় খাওয়া নেতা-কর্মীদের চেয়ে সুসময়ের বন্ধু বসন্তের কোকিল বা মৌসুমি পাখিরা এসে আবির্ভূত হয়েছে। গণভবন থেকে আওয়ামী লীগ কার্যলয়, পাঁচতারকা হোটেল থেকে অভিজাত ক্লাবের আড্ডায়, অনুষ্ঠানে এখন তাদের মুখই বেশি শোভা পায়। আওয়ামী লীগ সভানেত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা দুর্দিনের নেতা-কর্মীদের যতটা মনে রাখেন দলের মন্ত্রী-নেতারা কি ততটা রাখেন? উপদেষ্টরা কি তাদের চেনেন? এ প্রশ্ন এখন সামনে এসে দাঁড়িয়েছে বলেই মাঠের নির্যাতিত নারীরা স্ট্যাটাস দেয়, রোদে পুড়ে যাওয়া ত্যাগী কর্মীদের চেহারা নায়িকাদের রূপের আগুনে হারিয়ে গেছে। অবস্থাটা এমন হয়েছে, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে রাজকীয় সমাদর থেকে সব সুযোগ-সুবিধা লাভ করবে হাইব্রিড, মৌসুমি পাখি, বসন্তের কোকিল, মৌমাছি বা কাউয়ারা। আর দল ক্ষমতার বাইরে থাকলে রাজপথে বৃষ্টিতে ভিজে, রোদে পুড়ে আন্দোলনের মিছিল থেকে পুলিশের লাঠিপেটা খেয়ে জেলে যাবে ত্যাগী কর্মীরা। আদর্শবাদীরা সুযোগ-সুবিধা না পেলেও, মূল্যায়ন না পেলেও সুসময়-দুঃসময় সব সময় দলের জন্য নিবেদিত থাকে। মনোনয়ন পান বাবার পরিচয়ে, স্বামীর পরিচয়ে। মহিলা এমপি হন অনেকের স্ত্রী, সন্তান। তাহলে দীর্ঘদিন যারা দল করলেন তাদের প্রাপ্তি কই? আর ক্ষমতার জোয়ারে নায়ক-নায়িকা যারা আজ উঠেছেন নৌকায় তাদের নিয়ে এত হৈচৈ কেন? এসেছে আদর্শ বুকে নিয়ে, বসুক। দলের কাজ করুক। রাজনৈতিক সতীত্বের দীর্ঘ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হোক- তারপর একদিন মূল্যায়ন করা হোক।

গণমুখী রাজনৈতিক সংগঠন আওয়ামী লীগের শক্তির উৎসই হচ্ছে তার নিবেদিতপ্রাণ কর্মীরা। আর সুসময়ের বন্ধুরা বিপদে পড়লে নিরাপদে কেটে পড়ে। বাতি জ্বালিয়েও তাদের খুঁজে পাওয়া যায় না। এসব বিবেচনায় রেখেই আওয়ামী লীগকে একদিকে দলকে সংগঠিত শক্তিশালী রাখা। অন্যদিকে জনগণকে নিয়ে গণজাগরণ ঘটিয়ে গণমানুষের আস্থা অর্জন করেই শেখ হাসিনার ঘোষিত দুর্নীতির বিরুদ্ধে জয়ী হতে হবে।

            লেখক : নির্বাহী সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন।

সর্বশেষ খবর