বুধবার, ৩০ জানুয়ারি, ২০১৯ ০০:০০ টা

বাংলাদেশ-ভারত ও কবিতাকৃতিতে জ্যোতি বসু

সালেম সুলেরী

বাংলাদেশ-ভারত ও কবিতাকৃতিতে জ্যোতি বসু

বিশাল ভারতের প্রজাতন্ত্র দিবস ২৬ জানুয়ারি। এই জানুয়ারি মাসের ১২ তারিখে জন্ম স্বামী বিবেকানন্দের। ২৩ তারিখে জন্ম নেতাজি সুভাষ বসুর। ১৭-তে দেহাবসান বাংলাদেশ-বান্ধব রাজনীতিক জ্যোতি বসুর। খ্রিস্টবর্ষের সূচনা-মাসটিতে রয়েছে স্মৃতিপ্রদ ইতিহাস। প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির অঙ্ক নিয়েও রয়েছে প্রামাণ্য পর্যালোচনা।

বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের পানিবণ্টন বিতর্ক দীর্ঘকালীন। ৫৪টি নদ-নদীর মধ্যে চুক্তিযুক্ত সমাধান হয়েছে একটির। সেটি গঙ্গা/ভাগীরথী বাহিত ফারাক্কা বাঁধসংক্রান্ত। প্রথম কার্যকর চুক্তিটি হয় ১৯৭৭ সালে। তখন বাংলাদেশে জিয়াউর রহমান, বীরউত্তম সরকারপ্রধান। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন জোট সরকারের মোরারজি দেশাই। শেষ চুক্তিটি ১৯৯৬ সালের ডিসেম্বরে সম্পাদিত। তখনো বাংলাদেশের সরকারপ্রধান ছিলেন শেখ হাসিনা। ভারতের দ্বাদশতম প্রধানমন্ত্রী ছিলেন এইচ ডি (হারাদানাহাল্লি দোদ্দেগৌড়া) দেবগৌড়া। ৩০ বছর মেয়াদের এ চুক্তিটি চলমান। ঐতিহাসিক চুক্তি স্বাক্ষরে দুজন ভারতীয় ব্যাপক ভূমিকা রাখেন। একজন সাবেক প্রধানমন্ত্রী আই কে গুজরাল। অন্যজন পশ্চিমবঙ্গের দীর্ঘমেয়াদি মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু।

একটানা ২৩ বছর ক্ষমতায় ছিলেন জ্যোতি বসু। ১৯৭৭ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত আলোচিত মুখ্যমন্ত্রী। সিপিআই (এম) তথা কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় নেতা ছিলেন। জন্ম ১৯১৪-এর ৮ জুলাই, অবিভক্ত ভারতে। দেহাবসান ২০১০-এর ১৭ জানুয়ারি, কলকাতায়। পৈতৃকবাস বাংলাদেশের নারায়ণগঞ্জ জেলার বারদিতে। শৈশবের অনেকটা সময় সোনারগাঁর বারদিতেই কাটে। বাবা নিশিকান্ত বসু ছিলেন পেশায় চিকিৎসক। রাজনীতিমুক্ত জীবন তবে ব্রিটিশবিরোধীদের প্রশ্রয় দিতেন। বারদির বাড়িতে বিপ্লবীরা অস্ত্রসহ আশ্রয় নিত। পুলিশের থানা তল্লাশির সময়ে বিশেষ ঘটনা ঘটে। মা হেমলতা বসু শাড়ির আঁচলে অস্ত্র লুকিয়ে রাখতেন। সেই দৃশ্য কিশোর জ্যোতিকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করে। দেশপ্রেম বা রাজনীতির প্রথম চিন্তা তখন থেকেই। পরে ব্রিটেনে আইন শাস্ত্র পড়তে গিয়ে ঘুরে দাঁড়ান। রাজনীতিকেই প্রাধান্য দিয়ে নির্ধারণ করেন জীবনের গতিপথ।

ক্ষমতায় থাকাকালে একাধিকবার সফর করেন বাংলাদেশ। নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ উপজেলার বারদিতেও পদধূলি দিতেন। পৈতৃকবসত হিসেবে বাড়িটির মালিকানা তাঁদেরই ছিল। শৈশবের স্মৃতিবারতা কুড়োতে বাড়িটিতে পা রাখতেন। নিকটাত্মীয়কে রেখেছিলেন ‘কেয়ারটেকার’ হিসেবে। কলকাতা থেকে নিয়মিত তদারকি করতেন বাড়ি ও এলাকাবাসীর।

বাংলাদেশে জেনারেল এরশাদের শাসন চলে প্রায় নয় বছর। ১৯৮২-এর ২৪ মার্চ থেকে ১৯৯০-এর ৬ ডিসেম্বর। এই সময়কালে জ্যোতি বসুর সফর ছিল আলোচিত। ১৯৮৭-তে ঢাকা সফরকালে ‘বাংলা একাডেমি’ পরিদর্শন করেন। কলকাতাস্থ ‘বাংলা আকাদেমি’ সাজাতে অভিজ্ঞতা নেন। কবি-গীতিকার ড. আবু হেনা মোস্তফা কামাল ছিলেন মহাপরিচালক। পরিদর্শনকালে গুরুত্ব পায় ‘লোক-ঐতিহ্য সংগ্রহশালা’। তৎকালীন পরিচালক শামসুজ্জামান খান, বশীর-আল-হেলাল সঙ্গ দেন। এর পরও জ্যোতি বসু বাংলাদেশ ঘুরে গিয়েছেন। এরশাদ শাসনামলে ওনার সহযোগিতা একান্ত প্রত্যাশিত ছিল। ১৯৮৮-এর প্রবল বন্যায় বাংলাদেশ অনেকাংশেই ডুবে যায়। ভারতের বাংলাদেশমুখী নদ-নদীগুলোর বাঁধ খুলে দেওয়া হয়। সবচেয়ে বড় সমস্যা ছিল ফারাক্কা বাঁধ বিষয়ে। ১৯৮৫-৮৮ সাল পর্যন্ত পানিবণ্টন চুক্তি বহাল ছিল। এরপর আর দীর্ঘমেয়াদি কোনো সমঝোতা সম্ভবপর হয়নি। ফলে নদ-নদীর পানিপ্রবাহ নিয়ে সৃষ্টি হয় অচলাবস্থা। ব্যাপক বন্যার পরই আসে খরাযুক্ত শুষ্ক মৌসুম। ১৯৮৯-তে ভারত একতরফাভাবে গঙ্গার পানি প্রত্যাহার করে। ভাগীরথী-গলি নদীতে স্থানান্তরিত হয় ফারাক্কার জলরাশি। ফলে বাংলাদেশের নদ-নদীতে পানিপ্রবাহের অবনতি ঘটে।

পানিপ্রাপ্তির আকুলতা নিয়ে সে সময় দীর্ঘ কবিতা লিখি। প্রথম প্রকাশিত হয় সর্বাধিক প্রচারিত সাপ্তাহিক ‘সন্দ্বীপ’-এ। সম্ভবত ১৯৮৯-এর জুলাই মাসের শুরুতে। ৮ জুলাই ছিল জ্যোতি বসুর ৭৫তম জন্মতিথি। বিশেষ প্রতিবেদনের সঙ্গে ছিল ‘নিবেদিত পদ্য’টি। শিরোনাম : ‘আয়রে আমার ছায়া-জ্যোতি’। বিশেষ আলোড়ন তোলে কল্যাণকামী পদাবলিটি। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সেটি সংগ্রহ করে কলকাতায় পাঠায়। প্রেসিডেন্ট এরশাদের শ্যালক জাহাঙ্গীর মহিউদ্দিনও গুরুত্ব দেন। তিনি তখন জাতিসংঘে রাষ্ট্রদূত, স্থায়ী প্রতিনিধি। কূটনৈতিক মেইলে সন্দ্বীপের সংখ্যাটি সংগ্রহ করেন। কবিতাটির সূত্র ধরে নিভৃতে নানান উদ্যোগ চলে। মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুকে প্রভাবিত করার চেষ্টাও চলছিল। কিন্তু ভারত সরকার অনেকটা মুখ ফিরিয়ে রেখেছিল। ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম ঘোষণা করায় বিতর্ক ওঠে। মধ্যপ্রাচ্যে সৈন্য পাঠানো নিয়ে ঘটে কূটনৈতিক বিপর্যয়। এরশাদ সরকারকে আস্থায় নিতে পারছিল না ভারত। অবশেষে ১৯৯০-এর ডিসেম্বরে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে রাজ-বিদায়।

১৯৯৬-এর ডিসেম্বরে শেষ হাসি হাসলেন শেখ হাসিনা। ৩০ বছর মেয়াদি পানি চুক্তি হলো ভারতের সঙ্গে। আর তাতে সর্বোচ্চ সহযোগিতা নিশ্চিত করলেন জ্যোতি বসু। যার ধারাবাহিকতা রাখতে পারেননি উত্তরসূরি বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। অথবা পশ্চিমবঙ্গের আলোড়িত মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জিও। তিস্তা নদীর পানিবণ্টন চুক্তির আকাক্সক্ষা- প্রত্যাশা পর্বেই থেকে গেল।

প্রয়াত জ্যোতি বসু বাংলাদেশের চিরসুহৃদ হয়েই বেঁচে থাকলেন। বলেছিলেন, বাংলাদেশের প্রতি আমার অনেক ঋণ। তা এই এক জীবনে শোধ হওয়ার নয়। প্রধানমন্ত্রী হতে পারলে হয়তো অন্য ব্যবস্থা করা যেত। কিন্তু যতখানি করতে পেরেছি, তা মুখ্যমন্ত্রীরও অধিক। বাংলাদেশের পানিকষ্ট নিয়ে আমার দায় আছে শুনি। কবিতা দিয়েও আমাকে আবেগ-আক্রান্ত করা হয়েছে। কিন্তু সীমাবদ্ধতার মধ্যেও তিন দশকের চুক্তি হলো। এতে শুধু বাংলাদেশ লাভবান হবে তা নয়, চুক্তি মোতাবেক পানিপ্রবাহ রাখতে পশ্চিমবঙ্গও উপকৃত হবে। এজন্য বাংলাদেশ যেন অঙ্গীকার আদায় করতে সচেষ্ট থাকে। আবার বলি, বাংলাদেশ পেলে পশ্চিমবঙ্গও পেতে পারবে। এমন একটি আয়োজনে আমি বেশ পরিতৃপ্ত। ‘তিস্তা’ নিয়েও সমঝোতার পথ খুলে গেল। এখন মৃত্যুদূত এলে প্রশান্তি নিয়েই চলে যাব।

সত্যিই চলে গিয়েছিলেন ৯৫ বছর বয়সে। স্মৃতিস্মারক তারিখটি ২০১০-এর ১৭ জানুয়ারি। জ্যোতিদা গেলেন সত্য- তবে স্মৃতিটা থাকল। থেকে গেল জল-ক্রন্দনের নিবেদিত প্রামাণ্য পদ্যটিও। বিদেহী আত্মাটি স্বর্গে প্রশান্তিতে থাক- সেটিই দৃঢ়কাম্য।

লেখক : কবি

সর্বশেষ খবর