১৯৭২ কিংবা ৭৩ সাল সেটি সঠিক মনে নেই। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরে নওরোজ কিতাবিস্তানের জর্জ একদিন আমার বড় বোনের লক্ষ্মীবাজারের বাসায় এসে জানাল, সে একটা সুন্দর জামদানি শাড়ির খোঁজে এসেছে। জামদানি শাড়ির ছবি তুলে সেটা দিয়ে একটা কবিতার বইয়ের প্রচ্ছদ করবে। আমার বড় বোন মাথা নেড়ে স্বীকৃতি জানাতে কাঠের আলমারির তাক থেকে কয়েকটি জামদানি শাড়ি মেঝেতে বিছিয়ে বাছাই করা শুরু হলো। কালবিলম্ব না করে আমরা অপেক্ষাকৃত কম বয়সীরা প্রবল উৎসাহে কবিতার বইয়ের প্রচ্ছদের ছবির জন্য শাড়ি নির্বাচন করার কাজে নেমে পড়লাম। অন্য সমবয়সীরা কোন চিন্তা থেকে শাড়ি নির্বাচনে এত উৎসাহ দেখাচ্ছিল সেটা আমার জানা নেই। আমি নিজে সুন্দর একটি শাড়ি নির্বাচনের জন্য ব্যাকুল ছিলাম কারণ জর্জ বলেছিল শাড়ির ছবি দিয়ে একটি কবিতার বইয়ের প্রচ্ছদ হবে। সেই অল্প বয়সেই আমার মনে একটি দার্শনিক চিন্তা উঁকি দিয়েছিল। মনে হয়েছিল, জামদানি শাড়িটা একদিন ছিঁড়ে ফেটে নষ্ট হয়ে যাবে। কিন্তু তার ছবি কবিতার বইয়ের সঙ্গে অনেক দিন বেঁচে থাকবে। অনেকগুলো জামদানি শাড়ি বেছে ছবি তোলার জন্য একটি শাড়ি নির্বাচন করে জর্জ খবরের কাগজে মুড়ে নিয়ে যাওয়ার পরে আমি আগ্রহভরে সেই কবিতার বইয়ের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম। এক সময় আমার অপেক্ষার পালা শেষ হলো। এক সন্ধ্যায় জর্জ একটি কবিতার বই এনে আমার বোনের হাতে দিয়ে বলল, খালা, আপনার শাড়ির পাড় দিয়ে এই বইটার প্রচ্ছদ করেছি। সবাই বইটি হাতে নিয়ে যখন তার প্রচ্ছদ দেখায় ব্যস্ত সে সময় আমি এক ফাঁকে কবিতার বইয়ে নাম পড়ে ফেললাম ‘সোনালী কাবিন’। লেখকের নামটিও চোখে পড়ল ‘আল মাহমুদ’। প্রচ্ছদের ছবি দেখা শেষ করে সবাই যখন বইটির প্রতি আগ্রহ হারিয়ে টেবিলের ওপর নামিয়ে রাখল তখন আমি সেটি লুফে নিয়ে সিঁড়ির কোনায় বসে পড়তে শুরু করলাম। ওই বাড়িতে আমি ছাড়া আর কোনো সহৃদয়-হৃদয়-সংবেদি না থাকায় বইটি অনেক দিন আমার একার কব্জায় ছিল। সোনালী কাবিন আমি যতবার পড়তাম ততবার কবিতার পঙ্ক্তিগুলো আমার মগজে নয় বুকের গভীরে গিয়ে অন্য এক খেলার জন্ম দিত। গ্রামীণ জনপদ ছেড়ে শহুরে জীবনে ঠাঁই নেওয়া একজন কিশোরীর মনে সোনালী কাবিন সেদিন যে ছায়া ফেলেছিল সেটি একান্ত একজন পাঠকের অনুভূতি। আল মাহমুদ বোদ্ধা পাঠকের কাছে কী রূপে ধরা দেন সেটি আমি জানি না। কাব্য সমালোচকরা তার সৃষ্টি নিয়ে কী বাহানার অবতারণা করেন সেটি নিয়েও আমার কোনো কৌতূহল নেই। আমার মনে হয় গ্রামীণ জীবনে শৈশবের সুতা ছিঁড়ে যে কিশোরী শহুরে জীবনে অভ্যস্ত হতে চাচ্ছে তার মনের ওপর সোনালী কাবিন কী প্রভাব ফেলেছিল তার স্বরূপ কোনো কাব্য সমালোচক ঠিক ধরতে পারবেন না। সোনালী কাবিন বারবার পড়ার অনুভূতি স্মরণ করে রবীন্দ্রনাথের ভাষায় বলতে পারি কবিতা বুঝিবার বিষয় নহে। বারবার পড়ে সোনালী কাবিনের পঙ্ক্তিগুলো আমি অনুভব করতে চেয়েছিলাম, আমি কিছু বুঝতে চাইনি। সে জন্যই আজও সোনালী কাবিন আমার কাছে শুধুই কবিতা।
আমাদের ছাত্রজীবনে সম্ভবত ১৯৭৯ কিংবা ’৮০ সালে পশ্চিমবঙ্গের যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন বাংলার অধ্যাপক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেছিলেন। তাকে সংবর্ধনা জানানোর জন্য টিএসসির সুইমিং পুলের কিনারে বাংলা বিভাগের ছাত্রছাত্রীদের ছোট পরিসরে একটি সমাবেশ হয়েছিল। আমরা সুইমিং পুলের কিনারে ঘাসের চত্বরে বসে বাংলা সাহিত্যে সুপণ্ডিত অধ্যাপকের বক্তৃতা শুনেছিলাম। এত বছর পরে আমি সেই পণ্ডিত ব্যক্তির নাম ভুলে গেছি। কিন্তু তার বলা একটি কথা আজও ভুলিনি। তিনি বলেছিলেন, বাংলা কবিতায় একজন ক্ষণজন্মা কবির আবির্ভাব হয়েছে। বাংলাদেশ তাকে নিয়ে গর্ব করতে পারে। এই কবির সৃষ্টি কালের কলস এবং সোনালী কাবিন মৌলিকত্বের কারণে কালান্তরে প্রবেশ করবে। কালের কলস এবং সোনালী কাবিন সৃষ্টি করে কবি আল মাহমুদ বাংলা কবিতায় নতুন কাব্য ধারার জন্ম দিয়েছেন। সেই কারণে তিনি বাংলা সাহিত্যে অমর হয়ে থাকবেন। আমি সাহিত্যবোদ্ধা নই। কিন্তু যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক কবি আল মাহমুদকে যেভাবে মূল্যায়ন করেছিলেন সেটি আমার মনে গেঁথে গিয়েছিল। সেই সঙ্গে আমার মনে প্রশ্ন জেগেছিল, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো অধ্যাপকের মুখ থেকে কথাটি আজও শুনিনি কেন? এদেশের সাহিত্য সমালোচকরা কেউ মন খুলে এই কবির গুণগান করে না কেন? বরং কবি আল মাহমুদকে অনুকরণ করে লেখা আরেক কবির সস্তা একখানি কবিতার বই নিয়ে সে সময় যত্রতত্র মাতামাতি হতে দেখতাম। চারপাশে যখন তখন নকল কবির চটুল পঙ্ক্তি উচ্চারণ করতে শুনে মনে হতো আমরা আসল ছেড়ে নকলের পূজায় দারুণ পোক্ত। সেই সঙ্গে আরও মনে হয়েছিল, সস্তা দরের লেখকরা কবিতা লেখায় তেমন দক্ষ না হলেও তারা আত্মপ্রচারের কাজে বেশ পারঙ্গম। আমার প্রিয় কবি আল মাহমুদ বোধহয় আত্মপ্রচারে বেশ পিছিয়ে ছিলেন। সে জন্য তার ভোগের পাল্লা শূন্য হলেও জীবনভর তার দুর্ভোগের শেষ ছিল না।
বর্তমান সময়ে বাংলা ভাষা এবং সাহিত্যের বন্ধ্যা দশা দেখে মনে হয় জাতি তার অনেক অনাচারের কাফ্ফারা দিতে শুরু করেছে। একদল তথাকথিত প্রগতিশীল লেখক নামের আবর্জনা আমাদের মননশীলতা গ্রাস করে নিয়েছে। কবি আল মাহমুদ রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার কতটা হয়েছিলেন সেটা জানি না। তবে তিনি কিছু সাহিত্যিক লেবাসধারী অক্ষম মানুষের হিংসার শিকার হয়েছিলেন।
অক্ষমের পরশ্রীকাতরতা যখন সক্ষমের সাফল্যকে হেয় করতে উদ্যত হয় সেই সময়কাল একটি সমাজের জন্য আঁধার যুগ। সাহিত্য অঙ্গনের দুর্দশার দিকে চেয়ে বলতে পারি আমরা একটি আঁধার যুগ পার হচ্ছি। এই বন্ধ্যা সময় পেরিয়ে বাংলা সাহিত্যে আবার একজন আল মাহমুদের জন্ম হলে হয়তো বাংলা সাহিত্যের আঁধার যুগের অবসান হবে। সাহিত্যের দুনিয়ায় আবার একদিন সোনালি সময় আসবে বলে আমি আশায় বুক বাঁধতে চাই। একজন ক্ষণজন্মা আল মাহমুদের উদ্দেশে শ্রদ্ধার্ঘ নিবেদন করে অনাগত দিনে আবার একজন আল মাহমুদের আবির্ভাবের আশায় আমি পথ চেয়ে রইলাম।
লেখক : কথাসাহিত্যিক।