সদ্য সমাপ্ত সংসদ নির্বাচনের ফলাফল এবং একমুখী রাজনীতি নিয়ে চায়ের কাপের ঝড় প্রসঙ্গ ছাপিয়ে সুশাসনের প্রত্যাশা প্রধান আলোচ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। দেশবাসীর এখন একমাত্র প্রত্যাশা সুশাসন। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা চতুর্থবারের মতো প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নেওয়ার প্রভাবে সুশাসনের প্রত্যাশা বহুগুণ বেড়ে গেছে। যেমনটি হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের পর সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে। তবে দুটি সময়ের মধ্যে মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। সে সময় প্রত্যাশার ফর্দ ছিল অনেক লম্বা; এবার খুবই সংক্ষিপ্ত। কারণ মানুষ এখন অনেক বাস্তববাদী। ধরেই নেওয়া হয়েছে, সরকারের ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকায় উন্নয়ন কেবল চলমানই থাকবে না, কলেবরও বৃদ্ধি পাবে। পদ্মা সেতুর পর উন্নয়ন ধারায় উজ্জ্বল হয়ে ধরা দিয়েছে কর্ণফুলীর তলদেশের টানেল। সামগ্রিক প্রবণতায় ধারণা করা হচ্ছে, বাংলাদেশ অদূর ভবিষ্যতে মালয়েশিয়া পর্যায়ে যাবে। এ বিষয়টি এখন আর কেউ বাগাড়ম্বর মনে করেন না। দেশের উন্নয়ন নিয়ে জনমনে এখন আর মোটেই সন্দেহ-সংশয় নেই। কিন্তু দেশবাসীর উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার বিষয় হচ্ছে সুশাসন প্রসঙ্গ। সুশাসন প্রশ্নে বিরাজমান দৈন্যদশার কারণে অনেক ব্যতিক্রমী ঘটনা দেখছে দেশবাসী। যেমন- এক. মাদক আগ্রাসন থেকে শুরু করে ডাক্তারের স্বেচ্ছাচারিতা নিয়ন্ত্রণ করার জন্য স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীকে ‘জোরালো’ উদ্যোগ নিতে হয়। দুই. সড়কে শৃঙ্খলা আনতে এতদিন প্রায় পথেই থাকতে হয়েছে যোগাযোগমন্ত্রীকে। সম্প্রতি এ ব্যাপারে একটি কমিটির প্রধান করা হয়েছে সাবেক নৌ পরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খানকে! যাকে সড়কের নানান অরাজকতার কেন্দ্র হিসেবে বিবেচনা করে দেশের মানুষ। তিন. রেস্তরাঁর রান্নাঘর থেকে শুরু করে ভেজাল ওষুধের দোকান, নকল সেমাইর কারখানা, নিম্নমানের ক্যাবলের গুদাম- কোথায় নেই র্যাব! চার. কোন স্কুলের শিক্ষক হাজির হননি তাও সরেজমিন দেখতে হয় দুদকের মহাপরিচালককে। অবশ্য এ ধারা নতুন কিছু নয়। এটি চলে আসছে বহু বছর ধরে। বিএনপি সরকারের সময় এক পরিবেশমন্ত্রী তো পলিথিন জব্দ করার ‘জেহাদে নেমে’ কাঁচাবাজারে গিয়ে দোকানদারের সঙ্গে হাতাহাতিও করেছিলেন। সুশাসন প্রতিষ্ঠায় রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে কার্যকর না করে এরকম বেফজুল কাজের অসংখ্য উদাহরণ আছে। এ ধারা মোটেই স্বাভাবিক নয়, এ থেকে সুফল তো অনেক দূরের বিষয়। দেশে সুশাসন নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে স্বাভাবিক, প্রত্যাশিত ও কার্যকর বিষয় হচ্ছে সরকারের বিভিন্ন সংস্থাকে কার্যকর করা। এ ক্ষেত্রে প্রথমেই চলে আসে প্রশাসন ও পুলিশ। আর অনেকেই একমত হবেন, রাষ্ট্রের এ দুটি সংস্থা ক্রমাগত পথচলায় যেখানে পৌঁছেছে তা মোটেই প্রত্যাশিত নয়। উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, প্রশাসন ও পুলিশ জনপ্রত্যাশা অনুসারে প্রত্যাশিত মাত্রায় কাজ করছে না। এ ধারণা অনেকেরই। আরও স্পষ্ট করে বলা চলে, সুশাসন নিশ্চিত করার জন্য সরকারের বিভিন্ন শাখা প্রত্যাশিত মাত্রার অনেক নিচে আছে। দেশে সুশাসনে ত্রুটি কোন মাত্রায় গিয়ে ঠেকেছে তার দুটি উদাহরণ হচ্ছে মাদকের ভয়াবহ আগ্রাসন এবং দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থা এবং নদী দখলসহ নানান ক্ষেত্রে চরম নৈরাজ্য। মাদক কারবারিরা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধ করতে সক্ষম এবং চিকিৎসা কারবারিরা প্রকাশ্যে সাংবাদিক প্যাদানোর সাহস অর্জন করেছেন। এদিকে দখল হচ্ছে নদী, বিলীন হচ্ছে জলাশয়। এই হচ্ছে বিভিন্ন রকমের অব্যবস্থাপনা এবং বেপরোয়া লুটেরা চক্রের কারসাজিতে জন্ম নেওয়া বিষবৃক্ষ। শুধু তাই নয়, আরও উদ্বেগের ঘটনা জানা গেল পুরনো ঢাকার কেমিক্যাল সামগ্রী ইস্যুতে। নিমতলীতে অগ্নিদগ্ধ হয়ে ১২৪ জনের মৃত্যুর পর পুরান ঢাকা থেকে কেমিক্যালের গুদাম সরানো যায়নি ব্যবসায়ীদের ‘অনিচ্ছার’ কারণে। যা জানা গেল চকবাজারে ২০ ফেব্রুয়ারি ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে প্রায় ৭০ জনের করুণ মৃত্যুর পর ২৩ ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রীর জবানিতে। এসবই হচ্ছে লাগাতারভাবে সুশাসনের অভাবে জন্ম নেওয়া বিষবৃক্ষের প্রভাব। এ রকম অনেক আছে! যে কোনো গণতান্ত্রিক সরকার চলে প্রধানত প্রশাসনের ওপর নির্ভর করে। এমনকি সামরিক সরকারের সাফল্যও অনেকটা নির্ভর করে সিভিল প্রশাসনের দক্ষতার ওপর। যে প্রশাসন কখনো বিকশিত, আবার কখনো সংকোচিত হয়েছে। ব্রিটিশ ভারতে আইসিএস, পাকিস্তান সরকারে সিএসপি এবং বাংলাদেশ সরকারের বিসিএস- এই হচ্ছে সিভিল প্রশাসনের পরিবর্তিত নামকরণ। কিন্তু দক্ষতায় পরিবর্তন ঘটেছে আকাশ থেকে পাতালমুখী। চলমান এ অধঃগতি দ্রুততর হয় ১৯৯১ সালের খালেদা সরকারের আমল থেকে। প্রশাসন দলীয়করণের অপচেষ্টার পাশাপাশি ‘প্রকৃচি’ নামে একটি সংস্থাকে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রকের ভূমিকায় ছিলেন সে সময় সরকারের প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব মির্জা আব্বাসের এক কৃষিবিদ কুটুম। এই সূত্রেই প্রশাসনে প্রকৃচির দাপটের অনুপ্রবেশ ঘটে, পরে এদের প্রভাব কেবলই বেড়েছে। বলা হয়, এখন সরকারের প্রশাসন নিয়ন্ত্রণ করে কৃষিবিদরা। বাস্তবতার সঙ্গে এ বক্তব্যের মিল থাকতে পারে, না-ও থাকতে পারে। এদিকে বিসিএস ক্যাডার কর্মকর্তাদের দক্ষতা হ্রাস এবং অনেকের দুর্নীতির অভিযোগ ওপেন সিক্রেট ব্যাপার। এর সঙ্গে আছে নানান গ্রুপের দলাদলি। সব মিলিয়ে প্রশাসন ব্যবস্থা এমন অবস্থায় পৌঁছেছে যেসব বিষয়ে সরকারপ্রধানকে হস্তক্ষেপ করেত হয়। এ বিষয়ে কোনোই দ্বিমত নেই যে, বিভিন্ন কারণে প্রশাসনের দক্ষতা হ্রাস পাওয়ার পাশাপাশি বেড়েছে অভ্যন্তরীণ দলাদলি। সব মিলিয়ে প্রশাসনে এক মাজুল অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। ফলে যে কাজটি জেলা পর্যায়ে ডিসির দেখার কথা তা দেখতে হয় এমপি-মন্ত্রীকে। কেন্দ্রে যে কাজ তদারকির জন্য যুগ্ম-সচিব সর্বোচ্চ অথরিটি হওয়ার কথা, তা করতে গলদঘর্ম হচ্ছেন মন্ত্রী-সচিব। যে কাজ করার জন্য মন্ত্রী হওয়ার কথা সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষ, তা করতে হচ্ছে প্রধানমন্ত্রীকে। আর প্রশাসনের নানান করণীয় নিয়ে হাই কোর্ট প্রতিনিয়ত যে কত নির্দেশনা দিচ্ছে তা এক বিস্ময়। এসবের মাধ্যমেই সুশাসনের ক্ষেত্রে প্রশাসনের অক্ষমতা স্পষ্ট হয়ে ধরা দেয়। এদিকে পুলিশ প্রশাসনের অবস্থাও সুশাসনের জন্য গ্রহণযোগ্য মাত্রার বেশ বাইরে রয়েছে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণ জরুরি।
লেখক : সাংবাদিক।