ডাকসু নির্বাচন আজ। সাড়ে আটাশ বছর পর নির্বাচন হচ্ছে বলে প্রথম প্রথম উৎকণ্ঠা-উদ্বেগ ছিল নির্বাচন হবে কি হবে না তা নিয়ে। এখন সে সব উদ্বেগ অনেকটাই কেটে গেছে। এখন বিপুল আগ্রহ, উদ্দীপনা নির্বাচনের দিনটির জন্য। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিতর ও বাইরে সবাই এখন কামনা করছি- ডাকসু নির্বাচন সফল হোক।
এবারকার ডাকসু নির্বাচন বিভিন্ন দিক দিয়ে অন্যান্য ডাকসু নির্বাচনের চাইতে আলাদা। মিলও আছে বা মিল রাখার চেষ্টাও আছে। নির্বাচনী প্রচারণা জমিয়ে তোলার জন্য সব প্রতিদ্বন্দ্বী প্যানেল প্রাণান্তকর চেষ্টা চালিয়েছে। এটা মিলের দিক। বাইরে থেকে আমার কাছে মনে হয়েছে নির্বাচনটা তেমন জমে ওঠেনি। আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র না হলেও ১৯৬৯ সাল হতে স্কুল থেকেই ছাত্রলীগের (পরবর্তীতে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র সমর্থক ছাত্রলীগ) কর্মী। সে সুবাদে ১৯৭০, ১৯৭২, ১৯৭৩, ১৯৭৯, ১৯৮০, ১৯৮২-তে নির্বাচন দেখেছি ও শেষের নির্বাচনগুলোয় কেন্দ্রীয় সংসদ সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছি। ১৯৮৯ ও ১৯৯০-এর নির্বাচনে সরাসরি প্রার্থী হয়েছি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হিসেবে। সেসব নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী একাধিক ছাত্র সংগঠন পূর্ণ প্যানেলে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছে। এবার সরকার সমর্থক ছাত্রলীগই কেবল পূর্ণ প্যানেলে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে। হল ছাত্র সংসদে এক-পঞ্চমাংশেরও বেশি পদে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সরকার সমর্থক ছাত্রলীগের প্রার্থীরা জয়লাভ করেছে। গত ২৮ বছরের মধ্যে প্রায় ১৭-১৮ বছর ক্ষমতাসীন দুটি দলের সমর্থক ছাত্র সংগঠন পালাক্রমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস গায়ের জোরে দখল করে রেখেছে। কোনো কোনো ছাত্র সংগঠন সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের কোথাও ঢুকতে পারেনি। আবার কোনো কোনো সংগঠন শুধু মধুর ক্যান্টিন, টিএসসি এলাকায় সভা-সমাবেশ করতে পেরেছে। কিন্তু সরকার সমর্থক ছাত্রলীগ ছাড়া অন্য কেউই হলে হলে সাংগঠনিক কাজ করতে পারেনি। এটা একটা কারণ হতে পারে পূর্ণ প্যানেল দেওয়ার সামর্থ্য না থাকার। কিন্তু সব প্রতিকূলতা জয় করেই তো সংগ্রামী ছাত্র সংগঠনগুলোকে সাংগঠনিক সামর্থ্য অর্জন করতে হবে। পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক আইয়ুব-মোনেম আমলে সরকার সমর্থক এনএসএফ-এর সব বাধাকে পরাজিত করেই তো তখনকার ছাত্রলীগ-ছাত্র ইউনিয়নকে সাংগঠনিক শক্তি অর্জন করতে হয়েছে। তবে আমি কুখ্যাত এনএসএফ-এর সঙ্গে ছাত্রলীগের তুলনা করতে চাই না। কারণ ছাত্রলীগ আমার সংগঠন। যদিও আমি যে ছাত্রলীগ করতাম তা ১৯৭২ সাল থেকে আওয়ামী লীগের সঙ্গে রাজনৈতিক সম্পর্কযুক্ত নয় এবং এখন তা ছাত্রলীগ-বিসিএল নামে পরিচিত, তবুও ছাত্রলীগ বললেই আমার শৈশব ও তারুণ্যের অহংকারদীপ্ত দিনগুলোর কথা মনে পড়ে।
অন্যান্য বারের চাইতে এবার স্বতন্ত্র প্রার্থীদের ব্যাপকতা লক্ষণীয়। এর দুটি কারণ হতে পারে। এক, সরাসরি ছাত্র সংগঠন করলে (সরকার সমর্থক ছাত্রলীগ বাদে) হলের সিট থেকে উচ্ছেদ হতে হবে সে ভীতি। দুই, বিদ্যমান ছাত্র সংগঠনগুলোর কোনোটাই স্বতন্ত্র প্রার্থী সমর্থক ছাত্রদের রাজনৈতিক ও শিক্ষা সহায়ক প্রয়োজনের চাহিদা পূরণ করতে পারছে না। এবার বেশ কয়েকজন ছাত্রী ডাকসুতে ভিপি ও জিএস পদে প্রার্থী হয়েছেন। নারী হলগুলোতেও স্বতন্ত্র প্যানেলের শক্তিশালী উপস্থিতি দেখা যাচ্ছে। তবে এখনো সংখ্যানুপাতে এগুলো এবারের ডাকসু ও হল সংসদ নির্বাচনের নতুন বৈশিষ্ট্য।এবার নির্বাচনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ পোস্টার ব্যবহার বন্ধ রেখেছে। খুব ভালো সিদ্ধান্ত। এর সঙ্গে ব্যানার-ফেস্টুনও বন্ধ রাখলে ভালো হতো। বিশাল বিশাল ব্যানারে ছোট ছোট ব্যানার ঢাকা পড়ে গেছে। জায়গা, বিশেষ করে ভালো দর্শনীয় জায়গা সীমিত। তাই একজনের ব্যানারের ওপর আরেকজনের ব্যানার উঠতে দেখা গেছে। এটা উত্তেজনার কারণ হতে পারত। কিন্তু এখনো এ নিয়ে কোনো গণ্ডগোল হয়নি। এর ব্যবহার ভবিষ্যৎ নির্বাচনে বন্ধ রাখলে ভালো হবে।
এবারের নির্বাচনে প্রচারণায় নতুন উপাদান যুক্ত হয়েছে। ২৮ বছর আগে মোবাইল, টেলিফোন, ইন্টারনেট, ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ, ভাইবার ইত্যাদি ছিল না। ছিল না এত বেসরকারি টেলিভিশন। প্রার্থীরা দ্রুতই ভোটারদের কাছে পৌঁছাতে পেরেছেন। এটা আমাদের সময় এত সহজ ছিল না। ছাপানো সংবাদপত্র, পোস্টার এগুলোই ছিল ভরসা।
এবারের নির্বাচনে অধিকাংশ প্রার্থীই ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে এখনো অপরিচিত। তবে কিছু প্রার্থী অতীতে ছাত্র-ছাত্রীদের স্বার্থ রক্ষার সংগ্রামে ভূমিকার কারণে পরিচিত মুখ। তাদের কেউ কেউ এ জন্য পুলিশ ও সরকার সমর্থকদের দ্বারা নির্যাতিতও হয়েছেন। সে সব প্রার্থীরা ভালো করবেন বলে আমার ধারণা। অপরিচিত ও কম পরিচিত প্রার্থীরা তাদের নিজ নিজ সংগঠনের বিস্তার ও ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তার মাপকাঠিতে ফলাফল পাবেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনৈতিক দলের অন্ধ অনুগত কোনো ছাত্র সংগঠন ছাত্রদের সমর্থন পায়নি। যেসব ছাত্র সংগঠন স্বাধীন স্বকীয় ধারায় ছাত্র রাজনীতি পরিচালনা করছেন তারা ভোটারদের দৃষ্টি আকর্ষণ করবে বলে আমি মনে করি। তবে ছাত্র আন্দোলনের গতিময়তা এমনই ছিল সরকার সমর্থক ছাত্র সংগঠনের নেতারাও সরকারের স্বৈরতন্ত্রী ভূমিকার বিরুদ্ধে আন্দোলনের প্রবাহে একাত্ম হয়েছেন। ১৯৬৯ সালে ডাকসুতে জিএস পদে সরকার সমর্থক এনএসএফ-এর ছাত্রনেতা ছিলেন। ১১ দফা আন্দোলন শুরু হলে তিনি আন্দোলনের পক্ষে একাত্মতা প্রকাশ করেন ও ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সদস্য হয় আইয়ুব-মোনেমের এনএসএফ থেকে বেরিয়ে আসা ১১ দফা সমর্থক এনএসএফ। ১৯৯০ সালে ঐক্যবদ্ধ ছাত্র আন্দোলন নস্যাৎ করার চেষ্টা সফল হয়নি ছাত্র নেতৃত্বের স্বাধীন ভূমিকার কারণে।
ছাত্র সংসদ নির্বাচনের সুষ্ঠু ও অবাধ পরিবেশ নির্ভর করে তিন পক্ষের ভূমিকার ওপর। প্রথমত, সাধারণ ছাত্র-ছাত্রী ও ছাত্র সংগঠনগুলো। যে কোনো মূল্যে ডাকসু ও হল ছাত্র সংসদ নির্বাচন সম্পন্ন করতে হবেÑ এ মনোভাবের কারণেই এখন পর্যন্ত নির্বাচন বানচালের কোনো ষড়যন্ত্র সফল হয়নি। দ্বিতীয়ত, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের ভূমিকা। দৃশ্যত ছাত্র সংগঠনগুলোর চাপ, আদালতের বাধ্যবাধকতা ইত্যাদির কারণে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সংসদ নির্বাচন দিতে বাধ্য হলেও, শিক্ষকদের এক বড় অংশ ছাত্র সংসদ নির্বাচনের বিষয়ে আন্তরিক ও দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। তবে নির্বাচনের তারিখ ঘোষণার আগে ক্ষমতাসীন দলের সমর্থক ছাত্রলীগের পক্ষে অনৈতিক কিছু সুবিধা দিয়ে তাদের সুবিধামতো নির্বাচনের নিয়ম-কানুন নির্ধারণ করার অভিযোগ করেছে অন্য ছাত্র সংগঠন। যেমনÑ প্রার্থী ও ভোটারের বয়সসীমা নির্ধারণ, এমফিল ছাত্রদের ভোটার ও প্রার্থী হিসেবে যোগ্য ঘোষণা (এর আগে এমফিল ও পিএইচডি গবেষকরা ভোট দিতে পারলেও প্রার্থী হতে পারতেন না), ভোটের সময় বিকাল ৪টা পর্যন্ত না করে বেলা ২টা পর্যন্ত করা ইত্যাদি। অধিকাংশ ছাত্রসংগঠন হলের বাইরে ভোটকেন্দ্র স্থাপনের জন্য দাবি জানিয়েছিল। আমি ব্যক্তিগতভাবে হলের বাইরে ভোটকেন্দ্র স্থাপনের পক্ষে নই। তবে যেসব কারণে ছাত্র সংগঠনগুলো হলের বাইরে ভোটকেন্দ্র করার দাবি তুলেছিল, সে কারণগুলো দূর করার জন্য কর্তৃপক্ষকে গুরুত্ব দিয়ে পদক্ষেপ নিতে হবে। অতীতে কোনো ডাকসু নির্বাচনে কর্তৃপক্ষ তথা শিক্ষকদের ভূমিকা নিয়ে কোনো প্রশ্ন ওঠেনি। ডাকসু নির্বাচন ২৮ বছর না হলেও শিক্ষকবৃন্দ শিক্ষক সমিতি, সিনেট, সিন্ডিকেট, রেজিস্টার্ড গ্র্যাজুয়েট, কর্মকর্তা, কর্মচারী সংগঠনসমূহের নির্বাচন দক্ষতার সঙ্গেই পরিচালনা করছেন। অতীতের গৌরবজনক ঐতিহ্য ধরে রেখেই এবারেও ডাকসু নির্বাচনে কর্তৃপক্ষ নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করবেন সে আশা করছি। ছাত্র সংসদ নির্বাচন সরাসরি পরিচালনার অভিজ্ঞতা না থাকলেও তারা আন্তরিকতা ও সাহসিকতার সঙ্গে ভূমিকা পালন করবেন বলেও আশা রাখি। তা হলেই কর্তৃপক্ষের অভিজ্ঞতার ঘাটতি পূরণ হবে বলে আমি মনে করি। তৃতীয়ত, সরকারের ভূমিকা। সরকারের দুটি ভূমিকা আছে। প্রশাসনিক দায়িত্ব হিসেবে আইনশৃঙ্খলা নিশ্চিত করা ও সম্ভাব্য গোলযোগ প্রতিরোধ করতে সরকারকে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে নিবিড়ভাবে কাজ করা। আরেকটি ভূমিকা হচ্ছে রাজনৈতিক। তাদের সমর্থক ছাত্র সংগঠন এত দিন (১০ বছর ধরে) একচেটিয়া বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ন্ত্রণ করে আসছে। তারা নির্বাচনে যে কোনো প্রকারে জয়লাভ করার মাধ্যমে সে নিয়ন্ত্রণ অব্যাহত রাখার মানসিকতা পোষণ করতে পারে। সরকারকে পরিষ্কারভাবে এ বার্তা পৌঁছাতে হবে যে, ডাকসুতে যারাই জয়লাভ করুক, এতে সরকারের রাজনৈতিক কোনো ঝুঁকি সৃষ্টি হবে না। আমি জেনেছি, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সাবেক ছাত্রনেতাদের এক বৈঠকে তেমন বার্তাই দিয়েছেন। আশা করি সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলো মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর বার্তা অনুযায়ী কাজ করবেন। ১৯৭৩-এ অনুষ্ঠিত ডাকসু নির্বাচনে সরকার সমর্থকদের তৎকালীন মানসিকতার দুঃখজনক পুনরাবৃত্তি তারা করবেন না। আর নির্বাচনে যারা জয়লাভ করতে পারবেন না, তাদেরকেও পরাজয় মেনে নেওয়ার মানসিকতা থাকতে হবে। ফলাফল ঘোষণার পরে ১৯৮৯ সালের মতো বিজয় মিছিলে পরাজিত পক্ষের হামলা ও গোলাগুলির মতো কোনো ন্যক্কারজনক ঘটনার পুনরাবৃত্তি কোনো পক্ষ ঘটাবে না এ আশা করছি।
গত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিপুল বিজয়ের মাধ্যমে সরকার গঠিত হলেও নির্বাচনের পূর্ব রাতে প্রশাসনের অতি উৎসাহী অংশের ন্যক্কারজনক ভূমিকার কারণে সে গৌরবে কলঙ্ক লেপন হয়েছে। গোটা জাতি স্বস্তি ও উৎফুল্ল হওয়ার বদলে ম্রিয়মাণ ও বিষণ্নতায় আক্রান্ত। যার প্রভাব উপজেলা নির্বাচনেও পড়েছে। ডাকসু নির্বাচন বিষণ্ন তাকে ঝেড়ে ফেলে প্রাণবন্যা বয়ে আনুক, জাতির জীবনে গণতন্ত্রের ধারাবাহিকতা নিশ্চিত হোক এ নির্বাচনে। রাজনীতির সঙ্গে ছাত্র তথা জনমানুষের মেলবন্ধন আবার প্রতিষ্ঠিত হতে ডাকসু নির্বাচন আলোকবর্তিকা হিসেবে আমাদের প্রেরণা জোগাক।
লেখক : সাধারণ সম্পাদক, (ডাকসু ১৯৮৯-৯০)।