একটি সুন্দর ও সভ্য সমাজ বিনির্মাণের জন্য জরুরি হচ্ছে সমাজের শিশুদের দীনদার ও আদর্শবান রূপে গড়ে তোলা। আর শিশুদের দীনদার ও আদর্শবানরূপে তখনই গড়ে তোলা যাবে যখন তাদের অধিকারগুলোকে যথাযথভাবে আদায় করা হবে। আর এ কারণেই ইসলাম শিশুদের অধিকারের বিষয়টিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েছে এবং শিশুদের অধিকার সম্পর্কে সবিস্তার দিক-নির্দেশনা প্রদান করে এগুলো প্রতিষ্ঠা করার ব্যাপারে জোর তাগিদ দিয়েছে। রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আপন হায়াত মুবারকে বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে শিশু অধিকারের বিষয়গুলোকে হাতেকলমে প্রতিষ্ঠিত করার প্রয়াস পেয়েছেন।
একটি শিশু পৃথিবীতে ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর ইসলাম তার জন্য সর্বপ্রথম যে অধিকার প্রদান করেছে, তা হচ্ছে, তার ডান কানে আজান ও বাম কানে একামত দেওয়া। এর উদ্দেশ্য হচ্ছে, শিশুর কর্ণকুহরে আজান ও একামতের মাধ্যমে জীবনের সর্বপ্রথম শব্দ প্রদান করে তার অন্তরে তাওহিদ ও রিসালাতের বাণী পৌঁছে দেওয়া এবং শয়তানের যাবতীয় কুমন্ত্রণা থেকে নিরাপদ থাকার রক্ষাকবচ তার অন্তরে বদ্ধমূল করে দেওয়া। এভাবে জন্মের পরপরই শিশুকে ইহকালীন সফলতা ও পরকালীন মুক্তির মহাসড়কে তুলে দেওয়া। তাই আজান ও একামতের মাধ্যমে শিশুর নিরাপদ ও সফল ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করা প্রত্যেক শিশুর জন্মগত অধিকার। ইসলাম এ অধিকার প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে বিশেষ গুরুত্বারোপ করেছে।
জন্মলাভের সাত দিনের মাথায় ইসলাম শিশুর জন্য আরও কিছু অধিকার প্রদান করেছে। যেমন : শিশুর আকিকা করা, সুন্দর নাম রাখা, শিশুর মাথার চুল মুন্ডন করে সমপরিমাণ রৌপ্য সদকা করে দেওয়া। এ সবকিছুই একটি শিশুর নিরাপদ ও সুন্দর ভবিষ্যৎকে নিশ্চিত করে তোলে। শিশুর আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ অধিকার হচ্ছে মাতৃদুগ্ধের অধিকার। শিশুর সুস্থ-সবল দৈহিক গঠনের জন্য আল্লাহ রাব্বুল আলামিন প্রত্যেক শিশুর জন্য পূর্ণ দুই বছরকাল মাতৃদুগ্ধের অধিকার প্রতিষ্ঠা করে দিয়েছেন। ইরশাদ হয়েছে, মাতাগণ তাদের সন্তানদের পূর্ণ দুই বছর দুধ পান করাবে। (সূরা বাকারা, আয়াত-২৩৩)। একটি শিশুর জীবনে তার সঠিক বেড়ে ওঠা অনেকটা নির্ভর করে তার প্রতি পিতা-মাতা ও পরিবারের অন্য সদস্যদের স্নেহ-ভালোবাসার ওপর। স্নেহ-ভালোবাসাপূর্ণ পরিবেশ শিশুর সঠিক বিকাশকে নিশ্চিত করে। তাই রাসুলুল্লাহ (সা.) যেমন নিজে শিশুদের প্রতি ছিলেন অত্যন্ত স্নেহপরায়ন, ঠিক তেমনি অন্যদেরও তিনি এ ব্যাপারে উদ্বুদ্ধ করতেন। এক হাদিসে ইরশাদ হয়েছে, ‘নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হাসান ইবনে আলী (রা.)-কে চুমু দিলেন। সেখানে উপস্থিত ছিলেন আকরা ইবনে হাবিস (রা.)। তখন আকরা বললেন, আমার দশটি সন্তান রয়েছে। আমি তাদের কাউকে কোনোদিন চুমু দেইনি। এ কথা শুনে রসুলুল্লাহ (সা.) তাঁর প্রতি তাকালেন এবং বললেন, যে দয়া প্রদর্শন করে না, সে দয়াপ্রাপ্তও হয় না।’ (বুখারি ও মুসলিম)। একটি শিশু তার ভবিষ্যৎ জীবনে আদর্শ ও অনুসরণীয় ব্যক্তিত্বরূপে গড়ে ওঠার জন্য সবচেয়ে জরুরি হচ্ছে তার সঠিক তালিম-তারবিয়াত তথা শিক্ষা-দীক্ষার নিশ্চয়তা। সঠিক শিক্ষা-দীক্ষা একজন শিশুর জন্য আল্লাহ প্রদত্ত অধিকার। শিশুর সঠিক তালিম-তারবিয়াতের ব্যবস্থা না করলে তার অভিভাবকদের আল্লাহর কাছে জবাবদিহি করতে হবে। আর একটি শিশুর শিক্ষার প্রথম ধাপ শুরু হয় তার পরিবার থেকে। আরও সুনির্দিষ্টভাবে বলতে গেলে মায়ের কাছ থেকেই একটি শিশু শিক্ষার প্রথম পাঠ নেয়। আর এ শিক্ষাই তার ভবিষ্যতের বুনিয়াদ হয়। তাই শিশুর সঠিক শিক্ষা নিশ্চিত করার জন্য প্রথম প্রয়োজন হচ্ছে তার মা দ্বীনদার হওয়া। আর সে জন্যই ইসলাম পুরুষদের বিয়ের ক্ষেত্রে দ্বীনদার নারীদের অগ্রাধিকার প্রদানের কথা বলেছে। হাদিস পাকে এসেছে, ‘চারটি বিষয় বিবেচনা করে একজন নারীকে বিবাহ করা যাবে। সম্পদের বিবেচনা করে, বংশের বিবেচনা করে, সৌন্দর্যের বিবেচনা করে, দীনদারির বিবেচনা করে। আর দীনদারির বিষয়টিকে সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য দাও। আল্লাহ তোমার মঙ্গল করবেন।’ (বুখারি ও মুসলিম)আর শিশুর শিক্ষার প্রথম পাঠ হওয়া চাই আল্লাহ শব্দ শিক্ষাদানের মাধ্যমে। শিশুর যখন মাত্র বুলি ফুটতে শুরু করে, তখনই তার মা-বাবার জন্য করণীয় হচ্ছে তাকে প্রথমেই আল্লাহর নামের উচ্চারণ শিক্ষা দেওয়া। কারণ মানবসৃষ্টির একমাত্র উদ্দেশ্য হচ্ছে স্রষ্টার পরিচয় লাভ করা। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন ইরশাদ করেন, ‘আমি জিন ও মানবকে কেবল এ জন্যই সৃষ্টি করেছি যে, যেন তারা আমার পরিচয় লাভ করতে পারে।’
মুফাসসিরিনের কেরামের ব্যাখ্যা মতে ওই আয়াতে এর অর্থে এসেছে। অর্থাৎ আল্লাহর পরিচয় লাভ করাই মানব সৃষ্টির একমাত্র উদ্দেশ্য। তাই একজন মানুষ হিসেবে পৃথিবীতে আগমনের পর প্রত্যেক শিশুর শিক্ষাজীবনের প্রথম অধিকার হচ্ছে তাকে আল্লাহর নামের শিক্ষা প্রদান করা। এ ছাড়া কোরআন ও হাদিসের শিক্ষা তথা ইলমে দীন শিক্ষাও একজন শিশুর জন্মগত অধিকার। কারণ ইলমে দীন শিক্ষা করা প্রত্যেক মুসলমানের ওপর ফরজ। রসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, ‘ইলমে দীন শিক্ষা করা প্রত্যেক মুসলমানের ওপর ফরজ।’ (শোআবুল ঈমান)। শিশুকে আদর্শ মানুষরূপে গড়ে তোলার জন্য পরিবারের সদস্যদের কর্তব্য হলো তাকে শৈশব থেকে ভালো-মন্দের শিক্ষা দেওয়া। শিশুকে ছোট বলে এ ধরনের বিষয়গুলোকে এড়িয়ে না যাওয়া। বড়দের থেকে ভালো-মন্দের শিক্ষালাভ করাও শিশুর একটি গুরুত্বপূর্ণ অধিকার। শিশুর এ অধিকারের বিষয়টিকে রসুলুল্লাহ (সা.) অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে দেখতেন।