রবিবার, ১৪ এপ্রিল, ২০১৯ ০০:০০ টা

যেভাবে এলো পান্তা-ইলিশ

মহিউদ্দিন খান মোহন

যেভাবে এলো পান্তা-ইলিশ

রবিবার সকালে যে সূর্যটি পূর্বদিগন্তে উদিত হবে, সেটি জানান দেবে নতুন একটি বাংলা বছরের সূচনার। পুরনো বছরের দুঃখ-কষ্ট, ব্যর্থতা-গ্লানি, বেদনা-বিষাদের স্মৃতি ভুলে গিয়ে সবাই নতুন করে সামনে চলা শুরু করবে। নতুন বছরকে বরণের প্রস্তুতি ইতিমধ্যেই সম্পন্ন হয়েছে। বাংলা নববর্ষ আমাদের নিজস্ব সম্পদ। এ নববর্ষ বরণের ঐতিহ্য বহুকালের পুরনো। এ দেশের মানুষ নানা আচার-অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে দিনটি পালনে অভ্যস্ত। প্রতিবারের মতো এবারও রাজধানীর রমনা বটমূলে বসবে সাংস্কৃতিক সংগঠন ছায়ানটের বর্ষবরণ অনুষ্ঠান, জমে উঠবে শাহবাগের শিশু পার্কের সামনে নারিকেলবীথি চত্বরে ঋষিজ শিল্পী গোষ্ঠীর সংগীতায়োজন। মঙ্গল শোভযাত্রায় শিশু-কিশোর, তরুণ-তরুণীসহ নানা বয়সের মানুষ মেতে উঠবে অন্যরকম এক আনন্দ-উৎসবে। পাশাপাশি রমনার সবুজ চত্বরে বসবে পান্তা-ইলিশের দোকান। নগরজীবনের নানারকম ঝক্কি-ঝামেলায় মনের মধ্যে জমে থাকা ক্লেদ দূর করতে অনেকেই এক দিনের জন্য হলেও পেছনে ফেলে আসা সেই পল্লীজীবনের আস্বাদ গ্রহণে বসে যাবেন লাল সানকিতে পান্তা-ইলিশ নিয়ে। ইট-কাঠের শহরে বসেও গ্রামের সেই কাদামাটির স্পর্শ পেতেই যেন সবাই ভিড় জমায় সেখানে।

বাংলা নববর্ষ বরণ আর পান্তা-ইলিশ এখন যেন সমার্থক হয়ে দাঁড়িয়েছে। নববর্ষ শব্দটি উচ্চারিত হলেই যেমন চোখের সামনে ভেসে ওঠে পান্তাভাত আর ইলিশ ভাজার ছবি, তেমনি পান্তা-ইলিশ বললেই বোঝা যায় বাংলা নববর্ষ বরণের কথা বলা হচ্ছে। গত তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে আমাদের নিজস্ব নতুন বছরের নানা আচার অনুষ্ঠানের সঙ্গে পান্তাভাতও জায়গা করে নিয়েছে।

পান্তার সঙ্গে বাঙালির যাপিত জীবনের সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য। বিশেষ করে গ্রাম বাংলায় পান্তা এক পরিচিত ও সমাদৃত খাবারের নাম। গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর এক বিশাল অংশের প্রাতরাশের প্রধান উপকরণ পান্তাভাত। কৃষক-মজুরের সকাল শুরু হয় পান্তা খেয়ে লাঙ্গল-জোয়াল কাঁধে নিয়ে হুঁকা হাতে মাঠে গমনের মধ্য দিয়ে। বিশিষ্ট সংগীতশিল্পী ফরিদা পারভীনের গাওয়া ‘এত বেলা হয় ভাবীজান পান্তা নাই মোর পেটে রে’- গানটি থেকেই অনুমান করা যায় আমাদের গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর প্রাত্যহিক জীবনের সঙ্গে পান্তার সম্পর্ক কত গভীর! ছেলেবেলায় দেখেছি প্রায় সব বাড়িতেই পান্তার প্রচলন। আগের দিন রাঁধা ভাতে রাতে পানি দিয়ে রেখে পরদিন একটু ভর্তা ডালের বড়া কিংবা ডিম ভাজার সঙ্গে কাঁচা পিয়াজ-মরিচসহযোগে তৃপ্তিসহকারে আহার করা। গ্রামের দরিদ্র, নিম্নমধ্যবিত্ত বা বিত্তহীন মধ্যবিত্ত পরিবারে পান্তা ছিল জীবন ধারণের অন্যতম অনুষঙ্গ। বলতে দ্বিধা নেই, ছাত্রজীবনে আমি নিজেও পান্তা খেয়ে স্কুল-কলেজে গিয়েছি। সে অভ্যাস এখনো আছে। সুযোগ পেলেই বর্তমান শহুরে জীবনেও পান্তার থালায় একরকম হামলে পড়ি। তবে একটি কথা বলতেই হয়, আমাদের কাছে যা বিলাস বা শখের বিষয়, এ দেশের আশি শতাংশ মানুষের কাছে তা জীবন ধারণের অপরিহার্য উপকরণ। সে পান্তা এখন অভিজাত হয়ে উঠেছে। গ্রামের দরিদ্র মানুষের পর্ণকুটির থেকে তা উঠে এসেছে শহরের বিত্তবান মানুষের ডাইনিং টেবিলে। আর পয়লা বৈশাখের সকালে পান্তা-ইলিশ খাওয়া এখন বাঙালির সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে পরিণত হয়েছে।

কিন্তু বর্ষবরণে পান্তা-ইলিশের এই যে সমাদৃত হয়ে ওঠা, এর পেছনের কাহিনি হয়তো অনেকেরই অজানা। এর প্রচলন শুরু হয় গত শতাব্দীর আশির দশকের ঠিক মধ্যবর্তী সময়ে। ১৯৮৪ সালের কথা। বর্তমানে লুপ্ত ‘দৈনিক দেশ’ কার্যালয় থেকে এর উৎপত্তি। সামরিক সরকারের রোষানলে পড়ে পত্রিকাটি তখন বন্ধ। কিন্তু কর্মরত সাংবাদিকরা সবাই প্রতিদিনই আসেন। জুনিয়র ফ্রিল্যান্স লেখক হিসেবে আমিও যাই সেখানে। সে বছর পয়লা বৈশাখ আসার কয়েকদিন আগে পত্রিকাটির সম্পাদকীয় বিভাগে বসে গল্প করছিলেন কয়েকজন সিনিয়র সাংবাদিক। তাদের মধ্যে ছিলেন পত্রিকাটির বার্তা সম্পাদক বোরহান আহমদ (পরে দৈনিক জনকণ্ঠের নির্বাহী সম্পাদক, বর্তমানে মরহুম), সহকারী সম্পাদক মুনশী আবদুল মান্নান, শেখ নূরুল ইসলাম (বর্তমানে মরহুম), রফিকুল ইসলাম, আবদুর রহিম আজাদ (বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী), সংস্কৃতি পাতার সম্পাদক চিত্র পরিচালক শহীদুল হক খান। কাজকর্ম নেই, কী করা যায়- এই-ই ছিল আলোচনার বিষয়বস্তু। শহীদুল হক খান বললেন, পয়লা বৈশাখে রমনা বটমূলে পান্তাভাতের দোকান দিলে কেমন হয়? তার প্রস্তাবটি সবাই একরকম লুফে নিলেন। এরপর শুরু হলো তোড়জোড়। উদ্যোগের সঙ্গে আরও সম্পৃক্ত হলেন সহকারী সম্পাদক কবি ড. মাহবুব হাসান (বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী), হাসমত আরা বেগম, মকবুলা পারভীন, রোজী ফেরদৌস, পত্রিকাটির আর্টিস্ট এস এম শামসুদ্দিন প্রমুখ। বাইরের লোক হিসেবে আমি মূল প্রক্রিয়ার সঙ্গে সম্পৃক্ত হলাম না, তবে রমনা পার্কে গিয়ে পান্তা খাওয়ার দাওয়াত পেলাম। উদ্যোক্তারা সিদ্ধান্ত নিলেন- লাল বিরই চালের ভাতের সঙ্গে আলু ভর্তা, কাঁচা পিয়াজ-মরিচ ও ডালের বড়া থাকবে। খাওয়ানো হবে মাটির সানকিতে। দাম পাঁচ টাকা। পরে আরও সিদ্ধান্ত হয়, সঙ্গে এক টুকরা ইলিশ ভাজা থাকবে, দাম ১০ টাকা। আর এ আয়োজক সংগঠনের নাম হবে ‘আমরা বাংলাদেশি’। সে মতে ওই বছর পয়লা বৈশাখে রমনা বটমূলের দক্ষিণে একটি গাছের নিচে চেয়ার পেতে ‘আমরা বাংলাদেশি’ ব্যানার টানিয়ে পান্তাভাতের দোকান দেওয়া হয়েছিল। বহিরাগত সহযোগী হিসেবে আমি সেখানে খাবার পরিবেশনে সহযোগিতা করলাম। বিনিময়ে বিনা পুঁজিতে এক প্লেট খেতে পেলাম। উল্লেখ্য, ওই অভিনব ব্যবসায়ের উদ্যোক্তারা সবাই ৩০ টাকা করে পুঁজি বিনিয়োগ করেছিলেন। সেদিন ওই দোকানে তৎকালীন মন্ত্রী এ কে এম মাঈদুল ইসলাম (বর্তমানে মরহুম), সাংবাদিক আবেদ খানসহ বিশিষ্ট ব্যক্তিরা পান্তা-ইলিশ খেয়েছিলেন। ঘটনাটি বেশ আলোড়ন তুলেছিল। সে সময়ের প্রধান প্রধান দৈনিকগুলোয় পান্তা-ইলিশ নিয়ে সরস সংবাদ বেরিয়েছিল। সমালোচনাও যে হয়নি তা নয়। কেউ কেউ এটাকে আমাদের গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর প্রাত্যহিক জীবনের সঙ্গে নিষ্ঠুর মশকরা বলেও অভিহিত করেছিলেন। সেই শুরু। তারপর পয়লা বৈশাখে পান্তা-ইলিশের সমাদর ফিবছর বেড়েই চলেছে। আজ তার বিস্তৃতি এতই যে, পান্তা-ইলিশ ছাড়া বাংলা নববর্ষ বরণের কথা যেন চিন্তাও করা যায় না। রমনা বটমূল থেকে যার শুরু তা এখন তারকাসমৃদ্ধ হোটেল-রেস্তোরাঁয়ও জায়গা করে নিয়েছে। আর দাম? সেদিন যার দাম ছিল পাঁচ টাকা, এখন তা দুই-আড়াই শ থেকে স্থানভেদে পাঁচ শ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়! ১৯৮৪ সালে কয়েকজন সাংবাদিকের হঠাৎ সিদ্ধান্তে উদ্ভাবিত পান্তা-ইলিশের বিস্তৃতি ও নগরজীবনে এর প্রভাব এতটাই যে, এখন অনেক বাসাবাড়িতে নববর্ষে পান্তা-ইলিশের আয়োজন হয়।  আত্মীয়-পরিজন, বন্ধু-সুহৃদদের নেমন্তন্ন করে আপ্যায়ন করা হয়। আর নামিদামি রেস্তোরাঁগুলো তো রীতিমতো বিজ্ঞাপন দিয়ে সবাইকে জানায় নববর্ষে তাদের পান্তা-ইলিশ আয়োজনের কথা। নববর্ষের পান্তা-ইলিশ এখন বিস্তৃত হয়েছে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও। গ্রামেগঞ্জেও এখন পয়লা বৈশাখে পান্তা-ইলিশের আয়োজন দেখা যায়।

কেউ কেউ বিষয়টিকে বাঁকা চোখে দেখলেও আমার মনে হয় এর মধ্যে আমাদের দেশীয় ঐতিহ্যের সমৃদ্ধির বিষয়টি নিহিত। এটা ঠিক, বহুকাল আগে থেকেই আমাদের গ্রামীণ জনপদে পান্তা খাওয়ার প্রচলন রয়েছে। জনগোষ্ঠীর একটি বৃহদাংশ যা খেয়ে জীবন ধারণ করে, তাকে শহুরে ও বিত্তবান মানুষদের বিলাসিতার বিষয়ে পরিণত করা হয়েছে- এমন অনেকে বললেও বিষয়টি ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকেও পর্যালোচনা করা যায়। আমাদের গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর নিত্যদিনের আহার্য বিত্তশালীদের ডাইনিং টেবিলে উঠে আসা আমাদের জাতীয় ঐতিহ্যের স্বীকৃতিরই প্রমাণ। সে হিসেবে একটি সর্বজনীন জাতীয় উৎসবের অন্যতম অনুষঙ্গ হিসেবে গণ্য হওয়ার মধ্য দিয়ে পান্তার মহিমা অবশ্যই বেড়েছে। আমরা জানি, বিভিন্ন দেশের বা বিভিন্ন জাতির কিছু উৎসব আছে যা তারা অত্যন্ত জাঁকজমকভাবে উদ্‌যাপন করে। ওইসব উৎসবে তারা তাদের জাতীয় ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির খুঁটিনাটি বিষয় উপস্থাপন করে। আমরা খ্রিস্টীয় নববর্ষ বাজি পুড়িয়ে, উচ্চ শব্দে রক মিউজিক বাজিয়ে এবং বিভিন্ন তারকা হোটেল-রেস্তোরাঁয় নানারকম পানাহারের মাধ্যমে উদ্যাপিত হতে দেখি। সেসব উৎসব-অনুষ্ঠানে আমাদের জাতীয় সংস্কৃতির তেমন কোনো উপস্থিতি দেখা যায় না। পক্ষান্তরে আমাদের জাতীয় জীবনের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত বাংলা নববর্ষের অনুষ্ঠানে আমাদেরই জনজীবনের প্রাত্যহিক একটি বিষয় যদি ভিন্নমাত্রায় উঠে আসে তাতে আপত্তি কী?

এটা ঠিক, পয়লা বৈশাখ পান্তা-ইলিশ খেতেই হবে, না হলে নববর্ষ উদ্‌যাপন হবে না এমন কোনো কথা নেই। কারণ এটা ধর্মীয় কোনো বিধান বা রাষ্ট্রীয় কোনো আইন নয়। তবে একটি কথা স্মরণ রাখা দরকার, যে জাতি তাদের জাতীয় উৎসব-অনুষ্ঠানে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর জীবনাচারের বিষয়গুলো যত বেশি সম্পৃক্ত করতে পারে, সে জাতির সংস্কৃতি তত সমৃদ্ধ। একসময় বাংলা নববর্ষ পালিত হতো ব্যবসায়ীদের হালখাতা, গ্রামে-গঞ্জে মেলা ইত্যাদির মধ্য দিয়ে। ঢাকায়ও আগে তেমনই ছিল। যখন নববর্ষের প্রভাতে রমনা বটমূলে ছায়ানটের বর্ষবরণ অনুষ্ঠান শুরু হলো তখন থেকেই পয়লা বৈশাখ উদ্‌যাপন ভিন্নমাত্রা পেল। এখন অনেকেই সারা বছর অপেক্ষায় থাকেন ওই অনুষ্ঠানটির জন্য। শুধু তাই নয়, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের শিশু পার্কসংলগ্ন নারিকেলবীথি চত্বরে ঋষিজ শিল্পী গোষ্ঠীও প্রায় তিন দশক ধরে নববর্ষ উপলক্ষে সংগীতানুষ্ঠানের আয়োজন করে আসছে। তা ছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের বকুলতলা থেকে যে মঙ্গল শোভযাত্রা বের হয়, এটাও তো বহুকাল আগে ছিল না। একসময় প্রচলন ঘটেছে এবং এখন তা বর্ষবরণের অপরিহার্য অঙ্গে পরিণত হয়েছে। তেমনি পান্তা যদি আমাদের বর্ষবরণের অংশে পরিণত হয় তাতে তো আমাদের আনন্দিত হওয়ার কথা।

পয়লা বৈশাখে পান্তা ভাত খেয়ে নিজের শিকড়ের টান অনুভব করার চেষ্টা অবশ্যই সমর্থনযোগ্য। এটা এক দিনের জন্য হলেও আমাদের অস্তিত্বের ভিত্তিভূমির কথা স্মরণ করিয়ে দিতে পারে। অবশ্য এও ঠিক, নববর্ষের সকালে পান্তা খেয়ে এক দিনের বাঙালি হয়ে কোনো লাভ নেই। বাঙালি বলুন আর বাংলাদেশি বলুন, তা হতে হবে প্রতিটি দিনের জন্য, প্রতিটি মুহূর্তের জন্য। তাহলেই নববর্ষে পান্তা খাওয়া প্রচলনের মূল উদ্দেশ্য সার্থক হবে।

                লেখক : সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক।

 

 

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর