আগের যুগে আদর্শিক রাজনীতির জন্য নেতারা ভোগবিলাস বিসর্জন দিতেন। গান্ধী ছিলেন বিলেতফেরত ব্যারিস্টার। তার আদর্শিক রাজনীতি জাগিয়ে তোলে ভারতবর্ষের অনেক বিত্তশালী পরিবারকে। জওহরলাল নেহেরুর জীবনেও প্রভাব রাখেন মহাত্মা গান্ধী। গঙ্গা নদীর তীরে এলাহাবাদ শহরে বনেদি পরিবারে জন্ম নেহেরুর। ছোটবেলা থেকেই বিত্তবৈভবে বেড়ে উঠেছেন। ইংরেজ শাসনকালে পড়াশোনা করেন ব্রিটেনে। ভারতে এসে দেখেন পিতা মতিলাল নেহেরু কংগ্রেসের রাজনীতিতে কাজ করছেন মহাত্মা গান্ধীর সঙ্গে। মহাত্মা গান্ধীর দর্শন ও নৈতিক আদর্শবোধ নেহেরুর মাঝেও আকর্ষণ তৈরি করে। এ আকর্ষণেই ভোগবিলাসের জীবন পরিহার করে নেহেরু খাদির তৈরি কাপড় বেছে নেন। শুরু করেন যোগব্যায়াম ও ভগবদ্গীতা পাঠ। ছুটে বেড়াতে শুরু করেন ভারতবর্ষে। এ সময় হঠাৎ মতিলাল নেহেরু কংগ্রেস ত্যাগ করে স্বরাজ পার্টিতে যোগ দেন। কিন্তু জওহরলাল পিতার সঙ্গে গেলেন না। থেকে যান মহাত্মা গান্ধীর সঙ্গে। পাশাপাশি মানুষের জন্য কাজ করতে এলাহাবাদ মিউনিসিপ্যাল করপোরেশনের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীও কলকাতা মিউনিসিপ্যাল করপোরেশনের প্রেসিডেন্ট ছিলেন। এখন এ পদগুলো মেয়র হিসেবে বিবেচিত হয়। মানুষের জন্য সেই রাজনীতি কি আর আছে? এখন কতটা মানবসেবার ব্রত নিয়ে এ যুগের লোকেরা রাজনীতি করতে আসেন? কতজন পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছেন রাজনীতিকে? এই সংসদে ব্যবসায়ীর সংখ্যা কত? মহাত্মা গান্ধী, নেতাজি সুভাষ বসু, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ফিরে আসবেন তা বলছি না। কিন্তু মানুষের জন্য কল্যাণকর কিছু করার নৈতিক ভিত্তি নিয়ে সবাই রাজনীতি করবেন- সেই প্রত্যাশাটুকু তো রাখতেই পারি। প্রমথ চৌধুরীর একটি কথা আছে- ‘হাত যন্ত্র বাজায় না, বাজায় প্রাণ/গলা গান গায় না গায় মন।’ সত্যিকারের রাজনীতিবিদদের সামনে দেখলে রাজনৈতিক কর্মীদের মন ভরে ওঠে। শান্তি পায় আত্মা। কিন্তু কষ্টকর হলেও সত্য, এখন রাজনীতিবিদদের কাছে আর রাজনীতি নেই। গরিব মানুষের রাজনীতি কেউ করে না। আদর্শের চিন্তা কেউ করে না। সবাই নিজেরটা আগে বুঝে নেয়। আগে মন্ত্রী-এমপিরা ছিলেন কর্মীবান্ধব। এখন সবাই পরিবারবান্ধব। ইতিহাসের টানাপড়েনে সবকিছু বদলে গেছে।
রাজনীতির জন্য একটা দর্শন দরকার। এ দর্শন না থাকলে সমস্যা তৈরি হয়। ক্ষমতামুখী রাজনীতি অবশ্যই থাকবে, প্রতিযোগিতা থাকবে। কিন্তু সহনশীলতার জায়গাটুকু না থাকলে সর্বনাশ হয়ে যায় রাজনৈতিক শিষ্টাচারের। সমাজ ও রাষ্ট্রে অসৎরা দাপুটে অবস্থানে থাকলে সাধারণ মানুষের অস্তিত্ব হুমকিতে পড়ে। সত্যিকারের কর্মীরা বঞ্চিত ও হতাশ হয়। অথচ এ নিয়ে রাজনীতিতে কেউ এখন আর সমালোচনা শুনতে চায় না। প্রশংসার ঢেউয়ে ভাসতে চায় সবাই। ইতিহাসের মাহেন্দ্রক্ষণকে ঘিরে স্বপ্নচারিতাও এখন আর কেউ তৈরি করে না। আত্মসমালোচনা, আত্মশুদ্ধির রাজনীতি শেষ হয়ে গেছে। নেতারা আগে সারা দেশে ঘুরে কর্মী তৈরি করতেন। সেই কর্মীরা মানুষের কাছে যেত নেতার আদর্শের বাণী জানাতে। বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার স্বপ্ন মানুষকে জাগিয়ে তুলতে কর্মীরাই ছড়িয়ে দিয়েছিলেন সর্বস্তরে। ষাটের দশকের ছাত্র রাজনীতি ছিল আদর্শিক চিন্তাকে ঘিরে। এখন সেই রাজনীতি কোথায়? চাওয়া-পাওয়ার হিসাবগুলো সস্তা হয়ে ওঠায় আত্মসমালোচনা করার চিন্তাও কেউ করে না। পদ-পদবি বিক্রি হয় অর্থের বিনিময়ে। ছাত্রলীগের পদ পায় ছাত্রশিবির, ছাত্রদল। এ বিষয়ে ১৯৭৪ সালের ১৮ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আওয়ামী লীগের দ্বিবার্ষিক কাউন্সিলের উদ্বোধনী বক্তৃতায় খোলামেলাভাবে কথা বলেছিলেন। বিশেষ করে ক্ষমতাসীন দলে কেমন কর্মী দরকার, বঙ্গবন্ধু তা তুলে ধরেন। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘দেশ শাসন করতে হলে নিঃস্বার্থ কর্মীর প্রয়োজন।’ হাওয়া-কথায় চলে না। সেদিন ছাত্ররা আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল। তাদের বলেছিলাম, ‘আত্মসমালোচনা কর। মনে রেখো, আত্মসমালোচনা করতে না পারলে নিজেকে চিনতে পারবে না। তারপর আত্মসংযম কর, আত্মশুদ্ধি কর। তাহলেই দেশের মঙ্গল করতে পারবা।’ ছাত্রলীগের এখনকার নেতাদের অবস্থান দেখলে বঙ্গবন্ধু কী বক্তব্য দিতেন জানি না। বঙ্গবন্ধুর ছাত্রলীগ মুক্তিযুদ্ধ সংঘটিত করেছে। সেই সংগঠনের কর্মীরা এখন এমন কোনো অপকর্ম নেই যা করে না। তাদের কাছে এখন অন্য সংগঠন নয়, নিজের দলের নারী কর্মীরাও নিরাপদ নন। সরকারি দলের রাজনীতি মানে ক্ষমতার অপব্যবহার নয়। বুঝতে পারছি আন্দোলন-সংগ্রাম চোখে দেখনি। কিন্তু মানুষকে অতিষ্ঠ করে ২৪ ঘণ্টা দলের লায়াবিলিটিজ হয়ে কতদিন টিকে থাকা যায়? অথবা টিকিয়ে রাখা যায়? সবকিছুর একটা শেষ আছে। ক্ষমতা থাকলে অনেক কিছু সাদা চোখে দেখা যায় না। কিন্তু একটা ঝড় আঘাত হানলে টের পাওয়া যায় ক্ষতটা কত গভীর ছিল। ভারতের রাজনীতিতে কংগ্রেস আর বাংলাদেশে বিএনপি গভীর সেই ক্ষত এখন টের পাচ্ছে হাড়ে হাড়ে। আওয়ামী লীগও বহুবার টের পেয়েছিল।
![](/assets/archive/images/Print-Edition/2019/June%20-/02-06-2019/Bd-pratidin-02-06-19-F-02.jpg)
রাজনীতির নতুন গতিপ্রবাহ নিয়ে এ উপমহাদেশকে নতুন করে ভাবতে হবে। আমাদের রাজনীতির ময়দানে পার্টটাইম ব্যবসায়ী আর পার্টটাইম রাজনীতিবিদের দাপটই এখন বেশি। এ অবস্থার দরকার নেই। রাজনীতিবিদরা রাজনীতি করুক। পুলিশ ও সিভিল প্রশাসন প্রজাতন্ত্রের কাছে জবাবদিহি থাকুক। সরকারি কর্মকর্তাদের রাজনীতি করতে হবে কেন? অনেক হয়েছে, দয়া করে এবার সিভিল ও পুলিশ প্রশাসন এবং পেশাজীবীরা দলবাজির সর্বনাশা রাজনীতি বন্ধ করুন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ফিরে যাক নিজের পেশার উৎকর্ষতা সাধনে বিশ্বমানের সৃষ্টিতে। সাংবাদিক করুক সাংবাদিকতা। ডাক্তার তার সেবা দিক সাধারণ মানুষকে। প্রকৌশলী কাজ করুক দেশের উন্নয়নে। রাজনীতিবিদ রাজনীতি করুক। পেশাজীবী আর সরকারি কর্মকর্তাদের রাজনীতি করতে মন চাইলে সরাসরি যাওয়াই ভালো। পেশার বারোটা বাজানোর দরকার কি? আমাদের দক্ষ জনবলের এমনিতেই অভাব। তা ছাড়া রাজনীতিতে স্বাভাবিকতাও দরকার। সবাই দল করলে মানুষের কথা বলবে কে? মানুষের পাশে দাঁড়াবে কে? যেভাবে চলছে এভাবে হয় না। আত্মসমালোচনার মাধ্যমে শুদ্ধ হতে হবে সবাইকে। আত্মসমালোচনায় কোনো সমস্যা নেই। এ নিয়ে বঙ্গবন্ধুর আরেকটি বক্তৃতা আছে। ১৯ জুন ’৭৫ সালে বাকশাল কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠকে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আজকে এই যে নতুন এবং পুরান যে সমস্ত সিস্টেমে আমাদের দেশ চলছে, আমাদের আত্মসমালোচনা প্রয়োজন আছে। আত্মসমালোচনা না করলে আত্মশুদ্ধি করা যায় না। আমরা ভুল করেছিলাম, আমাদের বলতে হয় যে, ভুল করেছি। আমি যদি ভুল করে না শিখি, ভুল করে শিখব না, সেজন্য আমি সবই ভুল করলে আর সকলেই খারাপ করবে, তা হতে পারে না। আমি ভুল নিশ্চয়ই করব, আমি ফেরেশতা নই, শয়তানও নই, আমি মানুষ, আমি ভুল করবই। আমি ভুল করলে আমার মনে থাকতে হবে, আই ক্যান রেকটিফাই মাইসেলফ। আমি যদি রেকটিফাই করতে পারি, সেখানেই আমার বাহাদুরি। আর যদি গোঁ ধরে বসে থাকি যে না, আমি যেটা করেছি, সেটাই আমার ভালো। দ্যাট ক্যান নট বি হিউম্যান বিইং।’ বঙ্গবন্ধু ঠিকই বলেছেন। এখন গোঁ ধরে বসে থাকার এক জমানা চলছে। কিন্তু সবার মনোভাব আমি যা করছি সবই ঠিক আছে। এ কারণে ভুল হচ্ছে অনেক কিছুতে। রাজনীতির নামে চলছে অনিয়মের মহোৎসব। নতুন নতুন রথী-মহারথী সৃষ্টির খেলা। তাদের না আছে আদর্শ না আছে নীতি, না আছে আধুনিক চিন্তা। ভোগ-উপভোগের খেলায় ওরা মেতে উঠেছে।
এভাবে চলে না। আদর্শিক ধারা আর আসবে না, বুঝতে পারছি। কিন্তু সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজ, মাদক ব্যবসায়ীদের আশ্রয়-প্রশ্রয়ের হাতিয়ার হতে পারে না রাজনীতি। রাজনৈতিক দল কোনো খুনির ঠিকানা হতে পারে না। রাজনীতির নামে টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ চলতে পারে না। রাজনীতি মানে ব্যবসা নয়। ব্যবসা আর রাজনীতির আলাদা অবস্থান দরকার। ব্যাংকের ঋণ প্রদানে রাজনৈতিক তদবিরও বন্ধ করতে হবে। রাষ্ট্রক্ষমতাকে ব্যবহার করে অবৈধ আয়ের উৎসব করা যাবে না। সর্বস্তরে পেশাদারিত্ব ফিরিয়ে আনতে হবে। দূর করতে হবে রাজনীতির নিষ্ঠুর প্রতিহিংসা। এখনো আমাদের শেখার আছে অনেক কিছু। দুই ভুবনের বাসিন্দা হয়েও নরেন্দ্র মোদি উদারতা নিয়ে আশীর্বাদ নিতে যান প্রণব মুখার্জির বাড়িতে। প্রণব মিষ্টিমুখ করিয়ে বিদায় দেন। ইউক্রেনের সদ্যনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির জেলেনস্কি শপথ অনুষ্ঠানে বলেছেন, ‘নিজের যোগ্যতায় কিন্তু প্রেসিডেন্ট হইনি, বরং প্রেসিডেন্ট হয়েছি আগের শাসকের অযোগ্যতায়।’ আগের শাসকদের ব্যর্থতার কারণে নতুন কাউকে মানুষ বেছে নেয়। কিন্তু যারা আসে তারা পুরনো ভুলগুলো বার বার করে। তখনই সমস্যা তৈরি হয়। এ নিয়ে প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির জেলেনস্কির ছোটবেলার একটি ঘটনা উল্লেখ করতে চাই। ছোটবেলায় তার স্কুলে একবার এক মন্ত্রী এলেন। মন্ত্রী ছাত্রদের বললেন, ‘তোমরা ভালোভাবে পড়াশোনা করবে। সবাইকে আরও ভালো ছাত্র হতে হবে। অজানাকে জানতে হবে। তাহলে দেখতে পাবে বিশ্বকে।’ জবাবে উঠে দাঁড়ান ভøাদিমির। বললেন, ‘আমরা আজ কম জ্ঞানী বলেই আপনারা বড় বড় মন্ত্রী। আমাদের জ্ঞান যত বাড়বে, আপনাদের কাজ তত কমবে।’ মন্ত্রী বিস্ময় নিয়ে ছেলেটির দিকে তাকালেন। সেই ছেলেটি আজ মাত্র ৪১ বছর বয়সে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট।
লেখক : সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন।