রবিবার, ২ জুন, ২০১৯ ০০:০০ টা

বিএনপি আবারও সেই বেলতলায়

মেজর জিল্লুর রহমান (অব.)

বিএনপি আবারও সেই বেলতলায়

রাজনীতির ময়দান একেবারে পানসে হয়ে গেল। এমন অবস্থা কেউ কস্মিনকালেও কল্পনা করেনি। বেগম খালেদা জিয়ার কারাবাসের বছরপূর্তি বিএনপি যথাযোগ্য মর্যাদার সঙ্গে পালন করল! বিলাতি ব্যারিস্টার বাংলা আইনের যত প্যাঁচ পেঁচিয়েছেন বছর ধরে, তাতে শাস্তির প্যাঁচ ছাড়াতে পারেননি, নেত্রীকে আলো দেখাতে পারেনি। আজ হোক কাল হোক জামিন হবে এ কথা বলে শুধু ঘোরাঘুরি ধানাইপানাই। বিলাতি আইনি চিকিৎসা ম্যাডামকে জেল থেকে মুক্ত বাতাসে আনতে ব্যর্থ হয়েছে। আইনি লড়াই লেজেগোবরে করে ব্যারিস্টাররা নিষ্ফল হয়ে বললেন আল্লাহ ভরসা। আমরা অপারগ। ম্যাডাম দর্শন, ভাইয়া কত্থন, অফিস পদার্পণ রাজনীতি দিয়ে জনগণের মন গলানো যাবে না। পরম নৈরাশ্যের সঙ্গে আবিষ্কার করতে হয় এদের দিয়ে যুগোপযোগী রাজনীতি হবে না। শেখ হাসিনার মেধা এবং কৌশলের কাছে তারা দাঁড়াতেই পারছে না। চোখে ছানি পড়লেও দেখা যায়, প্রাচীনকালের অস্বচ্ছ রাজনীতির ধ্যানধারণা বঙ্গবন্ধুকন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঠিকমতো সামাল দিয়েছেন। মজবুত হাতে সেকালের মরণব্যাধি স্মল পক্স খেদানোর মতো হাইডোজের ভ্যাক্সিন প্রয়োগ করে ঝাড়ে বংশে চিরতরে খতম করে রাজনীতিতে নবযুগের সৃষ্টি করেছেন। শেখ হাসিনা এখন রাজনীতিতে অপ্রতিদ্বন্দ্বী, তিনি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করেছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অর্থনৈতিক ও সামরিক শ্রেষ্ঠত্বের দিকে ধাবিত হচ্ছেন। তিনি শুধু দেশের রাজনীতি নয় আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে প্রবেশ করছেন। তার অবস্থান বিএনপি যত দ্রুত বুঝবে সবার মঙ্গল। বিএনপি আদিম যুগের দিবাস্বপ্নে বিভোর থাকার রাজনীতি করে শেখ হাসিনার আধুনিক যুগের রাজনীতির মোকাবিলা করে ম্যাডামকে মুক্ত করতে পারবে না। এটা একটা শিশুও বুঝে। বিএনপি নেতারা বুঝেও জেগে ঘুমালে কারাবাস দীর্ঘায়িত হবে। গ্রামে ঘুরলে পর্যবেক্ষণ করলে আশ্চার্য হয়ে মন্তব্য করতে হবে, সামগ্রিক উন্নয়নের যে নীরব বিপ্লব এক দশক আগে শেখ হাসিনা পরিকল্পিতভাবে হাতে নিয়েছিলেন যা আজ দৃশ্যমান। তবে এ কর্মযজ্ঞ এক দিনের দুই দিনের এক টাকা দুই টাকার, এক নয়া দুই নয়ার মামলা না, এক খান দুই খান বাতাসার মামলা না। গ্রাম চেনার উপায় নেই। গৃহকর্মী পাওয়া যায় না। দশ বছরের ব্যবধানে গ্রামের মানুষ সকালে টিফিন ক্যারিয়ারে খাবার নিয়ে তাদের নিতে আসা বাসে উঠে ফ্যাক্টরিতে যাচ্ছে আবার সন্ধ্যায় বাসে ফিরে আসে।

বোদ্ধাজনরা বলেছেন, রাজনীতিতে যে সংস্কার হয়েছে বিএনপি তা অনুধাবন না করে আবার সেই বেল তলায় যাচ্ছে। বারবার ভুল করছে তারা। সংস্কার একটি দৃষ্টিভঙ্গি, যা প্রচলিত সব নীতিকেই তীক্ষè প্রশ্নবাণে বিদ্ধ করে। অর্থনীতির দ্রুততম বিকাশের জন্য কোন নীতি প্রযোজ্য এবং কোনটি পরিত্যাজ্য, তা বিচার করেই নীতিমালা হাতে নেওয়ার নামই সংস্কার। রাজনীতির ক্ষেত্রে অতি অভিমানী বা ক্রোধ জিদে বুঁদ হয়ে ঝাঁপ গুটিয়ে হাঁটু ভাঁজ করে দুই হাত দুই পাশ দিয়ে জড়ায় ধরে থুতনি দুই হাঁটুর মাঝে ঠেকিয়ে হু হু করে পশ্চাদ দেশের এপার-ওপার হাওয়া প্রবেশ করতে পারবে না এমন ফেবিকল আঠা লাগিয়ে বসলে বেচাকেনা বন্ধ হবে দিনভর খদ্দের শূন্য হলে সন্ধ্যায় এক খদ্দের দিয়ে দশ দিনের বেচাকেনা পুষিয়ে দিতে হবে। জাতীয় সমস্যা সামনে আনার বিষয়ে কোনো আলোচনাই চলবে না, এই কিশোর বয়সী বালকসুলভ শুনব না মানব না জিদ রাজনীতির পরিপন্থী। জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের মুখপাত্র সবার প্রিয় বিএনপির মহাসচিব ম্যাডাম শোকে কেঁদে দিবানিশি নয়ন ভাসাচ্ছেন। তার অশ্রু বিসর্জনের কারণে অন্তর শীতল করতে পেরেছেন বলে মনে হয় না। তাদের আবাসিক মুখপাত্র নিয়মিত চিত্রনাট্য সংলাপ রচনার মাধ্যমে নয়া পল্টন জেগে আছে জানান দিচ্ছেন। লক্ষ্য স্থির না করে বকবক করে লাভ কী হবে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে ক্ষমতায় ভাগ বসাতে হলে গণভবনে চা-চক্রের অছিলায় সে কাম করতে হবে। চা-চক্র বর্জনের ফজিলত কি ভালো কিছু হবে? ৩০ তারিখের নির্বাচনে একই সিটে বিএনপি-জামায়াতের মনোনয়ন টিকিট নিয়ে জব্বারের লাঠি খেলার মতো ভোটারদের বিনোদনের খোরাক যুগিয়েছে। দেশে রাজনৈতিক অবস্থান দৃষ্টিকোণ থেকেই এখন অধিকাংশ ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ চলছে। সে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণে কিন্তু সরকার সুবিধাজনক আসনে। ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর প্রেসক্রিপসন ‘আপনি দলের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে বসেন। তবে সেখানে আপনার সিনিয়র নেতাদের উপস্থিত থাকতে বলেন, তাদের মাধ্যমেই এসব মিটিং করেন। এ রকম রিজভীর মাধ্যমে মিটিং ডাকবেন না। সরাসরি মিটিং ডাকেন। ড. মোশাররফ, মওদুদ, হাফিজকে সামনে রেখে। তাহলেই দেখবেন আন্দোলনটা গড়ে উঠবে।’ আমার আব্বা চাচাদের বন্ধু ছিলেনÑ শফি উদ্দিন, সবাই ডাকত শফে খুড়ো বলে। সনদহীন বিত্তহীন জ্ঞানী মানুষ ছিলেন। গ্রামের সবাই সম্মানের চোখে দেখত। হতাশা দুঃখের মধ্যে রম্য আলোচনা করে মানুষকে উজ্জীবিত করতে পারতেন তিনি। হাসির খোরাকের ভান্ডারও  ছিলেন। আমার ছোট চাচা মনিকাকা বেঁচে আছে। তিনি বললেন একদিন শফে খুঁড়ো সকাল ১০টা কিংবা ১১টার দিকে আমাদের বাড়িতে এলেন, শবেবরাতের পরের সকাল। বললেন, বড় মোরগ জবাই কর, আলু দিয়ে রান্না কর শুকনা মরিচের পাক হবে সঙ্গে চুঁই ঝালও হবে। গতকাল শবেবরাত গেল। তোমার ভাবীর একটা রুগ্ন মুরগি ছিল তোমার ভাবীর মতো মোটাতাজা। গতকাল সেটা জবাই করে খেলাম। ক্ষুদ্র এক টুকরা মুরগির মাংস বৃহৎ একটা রুটি দিয়ে খেয়ে উদর ভর্তি করে বিশ্রামে গেলাম। পরহেজগার বউ আমার ছুটে এসে বলল আজ শবেবরাত আপনি শুয়ে আছেন। শিগগির কোরআন পড়েন। নামাজ পড়েন। জিকির আজগর যা আছে সব করেন। সারারাত কান্নাকাটি করে বুক ভিজিয়ে ফেললাম। তোমার ভাবী খালি বলল মাবুদ গো শুকনা রুটি চিবাতে চিবাতে চোয়াল লেগে যায়, খেতে পারি না তুমি দয়ার চোখ এই গরিবের ঘরে দাও আমিন। ইবাদাত করে ক্লান্ত হয়ে ঘরে কিছু সময় অপেক্ষা করলাম বিশ্রাম নিলাম। তোমার ভাবীর মন খুব হতাশ। দুর্বল হয়েছি ইবাদত করে রাতে তোমাদের বাড়িতে ভালোমন্দ খাব সবাই মিলে স্থির করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে বড় রাস্তায় উঠেই রিজিকের ফেরেস্তার সঙ্গে দেখা হলো। জিজ্ঞাসা করলাম সারা রাত ইবাদাত করে কান্না করে রাত জেগে কাটালাম আপনারা কেউ যে আমার ঘরে এলেন না! উত্তর দিল আরে ভাই সময় পাইনি, দেখ না তোমার বাড়ির পাশে বড় বিল্ডিং হাজী বাড়ি স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা করেছে, খুলনায় মার্কেট বাড়ি হাজার একর সম্পত্তি পাপপুণ্য অনেক, তাদের হিসাব মিলাতে রাত কেটে গেছে তোমার কাছে যাব কখন। তবু কিছু বরাদ্দ তো আছে। সেটা হলো আগের বরাদ্দ বহাল। আজ শফে খুড়ো বেঁচে থাকলে বিএনপির জন্য হয়তো রাজনীতির দায়িত্বপ্রাপ্ত ফেরেস্তাকে জিজ্ঞাসা করতেন বিএনপির জন্য বরাদ্দ কী? এত দোয়া খায়ের কান্নাকাটি জেল জুলুম মামলা হামলা এ অবস্থার পরিত্রাণ কী। এ দলের বহু সমর্থক হতাশ নেতাদের দিকভ্রান্ত কর্ম দেখে। শক্তিশালী বিরোধী দল দেশের কল্যাণে প্রয়োজন। কিন্তু তারা জাতিকে হতাশ করছে। আমার ছোট বেলায় কার্তিক মাসটা বড় অভাবের মাস ছিল কারও ঘরে খাবার থাকত না। ধনী শ্রেণির হাতেগোনা দু-একজনের ঘরে গোলায় ধান থাকত। ধানের জমির বিন্যাস ছিল একপ্রান্ত উঁচু কান্দি অন্যপ্রান্ত নিচু সাতল। উঁচু জমিতে রাজাশাইল বালাম ধান লাগানো হতো এ জাত একটু আগে পাকে। নিচু জায়গায় অন্য ধান লাগাত। ঘরে চাল থাকত না। পেটে ক্ষুধা, উঁচু জমির ধান পুরোপুরি পাকেনি কিন্তু ক্ষুধা মানে না। দেখতাম গ্রামবাসী অভাবের তাড়নায় ওই আধাপাকা ধান কেটে নিয়ে আসত। আমার মা-চাচি-বোনরা ধান হাঁড়িতে সিদ্ধ করত, তারপর রোদে শুকাত। কখনো আকাশ মেঘলা থাকলে ধান ভাজি করত, ভাজি ধান নিয়ে যেত ঢেকি ঘরে ধান ভানতে। সারাদিন কষ্ট ক্লেশ করে ঢেকিতে ধান ভেনে সন্ধ্যায় চাল করে ভাত রান্না করে সন্তানদের খাওয়াত। সেই মায়েদের কষ্ট ক্ষুধার কষ্ট এখন নেই। কোথায় কার্তিকের অভাব। কোথায় পালাল ক্ষুধা দারিদ্র্য?

ভাবনার বিষয় নয়। এটা যে ঘটেছে তা স্বীকার করতেই হবে। মানুষ এ সরকারের সুবিধাভোগী। ফাঁকা বুলি দিয়ে তাদের গিলানো যাবে না। চাপাবাজির ভাঙা রেকর্ড যে যা পারেন কম তো বাজালেন না। ঘরে তো ফসল এলো না। বাঘা কাদের সিদ্দিকী এখন পাইকারি দরে বজ্র ডায়লগ বিক্রেতা। জাতীয় ঐক্য ফ্রন্টের জনসভায় নির্বাচনের আগে বললেন ভোটের পরের দিন জেলের তালা খুলে খালেদা জিয়াকে তিনি বের করবেন চাবি তার কাছে। এই মহৎ কাজে অনেক গুণীজন তাকে সহায়তা করার জন্য ৩১ ডিসেম্বর জেলের গেটে হাজির হয়ে তাকে না পেয়ে হতাশ মনে বাড়ি ফিরে আসে। ড. কামাল স্যার ভোট গুণে ফল নিয়ে ঘরে ফিরতে বললেন। প্রবীণরা নবীনের ডিজিটালের বুদ্ধিতে কুলিয়ে উঠতে না পেরে বলছেন রাজ চালাকিতে তারা ধরা খেয়েছেন। এত বছরেও তারা বুঝে উঠতে পারেননি রাজনীতির পথ কোনটি। ম্যাডাম যে দিন দিন শারীরিক শক্তির পাশাপাশি রাজনীতির শক্তি হারাচ্ছেন সে খেয়াল কি আছে উনার উকিলদের। তাদের কথায় গেয়ো মক্কেলকে আইনি বুঝ দেওয়ার কৌশল লক্ষ্য করা যাচ্ছে। কর্মীরা ধৈর্যহারা হয়ে ব্যর্থ নেতাদের ওপর চড়াও হওয়ার গুমোট বাতাস বইছে। বড় দল অটুট রাখে কর্মীরা। কা-ারির অভাবে তারকা নেতারা ক্ষমতাসীনদের পক্ষ থেকে গোপনে লোভনীয় এনাম পেয়ে ত্বরিত ডিগবাজি দেয় না কর্মীদের গুতান খাওয়ার ভয়ে, কর্মীরাই দলের অতন্দ্র প্রহরী।

গেয়ো গ্রামে পাকা রাস্তা ডিজিটাল ইন্টারনেট স্মার্ট ফোন কানে লাগিয়ে রান্না করছে গ্রামের বধূ, তার ছেলের সঙ্গে বিদেশে কথা বলছে। গ্রামের পড়ুয়া মেয়েরা ঘরে বসে কম্পিউটারে কাজ করে বিদেশ থেকে আউট সোর্সিংয়ে টাকা রোজগার করছে। অর্ধশিক্ষিত যুবক মুরগির খামার, পুকুর ডোবানালায় মাছ চাষ ও গরু ছাগল পালন করে অর্থ আয় করছে। শিল্প গড়ে ওঠায় কাজের লোক পাওয়া যায় না। কার্তিকের অভাব ভয়ে পালিয়েছে। গ্রামের রাস্তায় এত  মোটরসাইকেল  কোথা থেকে এলো! ভিক্ষুক নেই। সরকারি কর্মচারীদের বেতন বেশি হওয়ায় খুশি তারা, শতভাগ পেনশন বেচনেওয়ালারাও শেয়ারে ধরা খেয়ে ফতুর। তাদের যাতে হাত পেতে চলতে না হয় তার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি কওমি জননী শুধু নন, আধুনিক বাংলাদেশের দরদি জননী। মানুষ বলছে তাকেই চাই।

সরকারের আকাশ ছোঁয়া সাফল্য থাকলেও সরকারি অফিসের ঘুষ দুর্নীতি আর রাজনৈতিক টাউটদের দৌরাত্ম্যে মানুষ দিশাহারা। রাজকোষ খুলে সরকারি কর্মচারীদের বেতনভাতা বৃদ্ধি করা হলেও তারা দেশবাসীকে কী সেবা দিচ্ছে তা প্রশ্নবিদ্ধ বিষয়। অফিস আদালতে ঘুষ, দুর্নীতি কমার বদলে আরও বেড়েছে কিনা সে প্রশ্নও উঠছে। কর্মকর্তাদের কাছে সেবা নিতে গেলে হাবভাব দেখে মনে হয় একেকজন জেলা উপজেলার ভাইস রয় সেজে অফিস খুলে বসে আছে। এ অবস্থার অবসান ঘটাতে সরকারকে কঠোর হতে হবে।

 লেখক : নিরাপত্তা বিশ্লেষক।

[email protected]

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর