ইদানীং বিশ্বে অশান্তভাব বিরাজ করছে। এর কারণ ধনী দেশগুলোতে বেশির ভাগ মানুষ বিজ্ঞান-প্রযুক্তির আধিক্যের কারণে অতিমাত্রায় পার্থিব। অন্যদিকে গরিব দেশে মানুষ অলৌকিক শক্তির ওপর ভাগ্যকে ছেড়ে দিয়ে অলস। একদিকে অতি-পার্থিব উন্নতির চেষ্টায় অস্বস্তি, অন্যদিকে অলৌকিক শক্তিনির্ভর দারিদ্র্য ও অবিশ্বাস সংকটের সৃষ্টি করে চলেছে। উভয় ক্ষেত্রেই আধিপত্য বিস্তারের অদম্য লিপ্সা। প্রকৃত ধর্ম, কোয়ালিটি শিক্ষা ও যথার্থ দর্শনের ফলপ্রসূ প্রয়োগ এ সংকটকে প্রশমিত করতে পারে এবং মানুষের মধ্যে মননশীলতা ও সৃজনশীলতার বিকাশ ঘটাতে সহায়তা করে।
ভয়শূন্য মুক্তমন, সত্যরূপী স্রষ্টার ধারক ধর্ম এবং স্রষ্টার সৃষ্টিগত ভাষানির্দেশক বিজ্ঞান পরস্পর সম্পূরক ও সমন্বয়ী। এই ত্রিমতবাদের সম্মিলিত শক্তি মানুষের বড় শত্রু, ধর্মে কথিত ‘শয়তান’, লোভকে প্রশমিত করতে পারে। লোভই যুক্তি-বিচার-বুদ্ধি-সৃজনশীলতাসহ মানব গুণাবলিকে আচ্ছন্ন রাখে। লোভবিহীন মানুষই ‘সেক্যুলার’ অর্থাৎ ‘অসাম্প্রদায়িক’। সেক্যুলারিজম (জাতীয় সংবিধানের ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’) মানুষকে অসীম শক্তি প্রদান করে এবং মহান করে।
খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চদশ শতাব্দীতে মহান শিক্ষক সক্রেটিস (খ্রি.পূ. ৪৭০-৩৯৯) সত্য রক্ষার্থে মৃত্যুবরণ করেছিলেন। বিভিন্ন ধর্মের অবতার বলি আর নবী-রসুল বলি পৃথিবীতে অবতীর্ণ হয়েছিলেন, তদানীন্তন সমাজের বিশৃঙ্খলা দূর করতে। তারা প্রত্যেকে ছিলেন ধর্মনিরপেক্ষ। সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতাব্দীর সবচেয়ে বড় বিজ্ঞানী স্যার আইজ্যাক নিউটন (১৬৪৩-১৭২৭) ধর্মপ্রাণ খ্রিস্টান ছিলেন। তিনি সবিনয়ে উক্তি করেছিলেন, ‘আমি (অজানা) জ্ঞান-সমুদ্রের তীরে বসে সাধারণ মানুষের চেয়ে কিছু বেশি সুন্দর নুড়ি কুড়াচ্ছি।’ কোয়ান্টাম যুগের সবচেয়ে বড় বিজ্ঞানী নোবেলজয়ী ড. আলবার্ট আইনস্টাইন (১৮৭৯-১৯৫৫) বলেছিলেন, ‘ধর্মবিহীন বিজ্ঞান খোঁড়া এবং বিজ্ঞানহীন ধর্ম অন্ধ।’ সত্যের পূজারি নোবেলজয়ী কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ রথযাত্রা কবিতায় লিখেছেন, ‘পথ ভাবে আমি দেব, রথ ভাবে আমি, মূর্তি ভাবে আমি দেব, হাসেন অন্তর্যামী’। সত্যকে প্রকাশ করতে কবিগুরু বলতে চেয়েছেন স্রষ্টা তো সর্বত্র বিরাজমান। অতএব যে যেভাবে স্রষ্টাকে গ্রহণ করে শান্তি পায় তাই করুক না! সাহিত্যের প্রকোষ্ঠে থেকেও তিনি আধুনিক বিজ্ঞানের নিগূঢ় অর্থ, বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসুকে উৎসর্গীকৃত ‘বিশ্ব পরিচয়’ গ্রন্থে সহজ বাংলা ভাষায় প্রকাশ করেছেন। এসবই কবিগুরুর সেক্যুলার শক্তির প্রকাশ। বর্তমান যুগে ঈশ্বরে অবিশ্বাসী হিসেবে খ্যাত বিশ্বনন্দিত জ্যোতির্বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং (১৯৪২-২০১৮) স্রষ্টার সমগ্র সৃষ্টিকে হেফাজত ও মানবজাতির কল্যাণে আমৃত্যু নিবেদিত ছিলেন বিধায় বিধাতা তাকে বহু সম্মানে ভূষিত করেছেন। ধর্মনিরপেক্ষতার প্রকৃত অর্থ পাওয়া যায় পঞ্চদশ শতাব্দীর কবি চ-ীদাস (১৪০৮ খ্রি.)-এর জোরাল উক্তিতে, ‘সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই’।
প্রতিকূলতা ও প্রতিরোধ জনগণকে জীবন ধারণে সাহসী, পরিশ্রমী, সংগ্রামী ও সৃজনশীল করে এবং যুক্তি-বুদ্ধি ও উপলব্ধি বোধ জাগ্রত করে। আমরা যদি ইতিহাস পর্যালোচনা করি তবে দেখতে পাব যে, উনবিংশ শতাব্দীতে একঝাঁক দেশপ্রেমিক, দক্ষ, অকুতোভয় ও মর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তিত্বের আবির্ভাব ঘটেছিল। এর কারণ ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন অত্যাচারী ছিল, কিন্তু ব্রিটিশ শিক্ষা ভালো ছিল বলে এই শিক্ষা ভারতীয়দের স্বাধীনতার চেতনায় উদ্বুদ্ধ করে এবং অনেকেই স্বাধীনতার জন্য প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ ভারত বিভক্তির সময় আমাদের ও ভারতের শিক্ষা ও গবেষণার মান একই ছিল। সময়ের সঙ্গে ভারতে শিক্ষা ও গবেষণার মান বাড়তে থাকে এবং সেই সঙ্গে তার প্রযুক্তিগত উন্নয়ন সমৃদ্ধি লাভ করতে থাকে। আমাদের মাটির মানুষ উপমহাদেশে বিজ্ঞানচর্চার পথিকৃৎ দুজন মহান বিজ্ঞানী, স্যার জগদীশ চন্দ্র বসু ও স্যার প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের উত্তরসূরি হওয়া সত্ত্বেও আমাদের দেশে শিক্ষা ও গবেষণা ভারতের চেয়ে অনেক নিম্নমানের। এটা আমাদের জন্য বড় লজ্জা!
ব্রিটিশ আমলের শিক্ষকদের কাছে প্রশিক্ষিত হয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকেই উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন, পাকিস্তানের ধর্মভিত্তিক রাজনীতি ধর্মকে অপব্যবহার করছে। পাকিস্তান শাসকগোষ্ঠী সাম্প্রদায়িক শিক্ষা ও রাজনীতি উসকে দিয়ে ভাষাসহ অন্যান্য ক্ষেত্রে বৈষম্যমূলক আচরণ শুরু করে। ১৯৪৭ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন ইসলামিয়া কলেজ থেকে বিএ পাস করার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে (ঢাবি) আইন বিভাগের ছাত্রাবস্থায় বঙ্গবন্ধু দেখতে পান, পাকিস্তান শাসকগোষ্ঠী সংখ্যাগুরু বাংলার জনগণের মাতৃভাষাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দিতে অস্বীকার এবং পূর্ব পাকিস্তানের সম্পদ লুণ্ঠনসহ এ অঞ্চলে অর্থনৈতিক শোষণ শুরু করে। তাই তিনি বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষার কাজে সংগ্রামী ভূমিকা রাখতে শুরু করেন। এ ছাড়া ঢাবিতে চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের দাবি আদায় আন্দোলনে নেতৃত্বদানের জন্য বঙ্গবন্ধুকে ১৯৪৯ সালে ঢাবি থেকে বহিষ্কার এবং গ্রেফতার করা হয়। এরপর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম লীগ ছেড়ে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগে যোগদান করেন। জেল থেকে মুক্তি পেয়ে এই সালেরই ১৪ অক্টোবর দরিদ্র মানুষের জন্য খাদ্যের দাবিতে ‘ভুখা মিছিল’ করতে গিয়ে সভাপতি মওলানা ভাসানী ও সাধারণ সম্পাদকসহ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান গ্রেফতার হন। জেল থেকেই তিনি রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের নির্দেশনা দিতেন।
অন্তর্দৃষ্টিতে তিনি দেখতে পান, গর্ভধারিণী মা যেমন নিজের সন্তানকে আগলে রাখেন তেমনই দেশমাতৃকা দেশের জনগণকে সম্পদ হিসেবে গণ্য করে এবং মাতৃভাষা জনগণের আবেগকে ধারণ করে। মায়ের এই ত্রিমূর্তির মর্যাদা রক্ষার মধ্যেই জনগণ, সমাজ ও রাষ্ট্রের সামগ্রিক কল্যাণ নিহিত থাকে। ১৯৫৩ সালে বঙ্গবন্ধু পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। সাধারণ বাঙালির ‘বাঁচার দাবি’ হিসেবে ১৯৬৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে লাহোরে বঙ্গবন্ধুর পেশকৃত ‘ছয় দফা’ পূর্ব পাকিস্তানে বিপুল সমর্থন লাভ করাতে পাকিস্তান সরকার বঙ্গবন্ধুকে জেলে আটক রেখে এক নম্বর রাষ্ট্রদ্রোহী করে ‘আগরতলা মামলা’ শুরু করে। কিন্তু পূর্ব বাংলার জনগণের প্রবল চাপের মুখে পাকিস্তান সরকার ১৯৬৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধুসহ ‘আগরতলা মামলার’ সব আসামিকে নিঃস্বার্থ মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। ২৩ ফেব্রুয়ারি পল্টন ময়দানে সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়।
ছয় দফার জনপ্রিয়তার কারণে ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে সমগ্র পাকিস্তানে আওয়ামী লীগ বিপুল ভোটে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়। কিন্তু পাকিস্তানি সামরিক শাসক বঙ্গবন্ধুকে গণতান্ত্রিক সরকার গঠন করতে না দিয়ে ’৭১ সালের ২৫ মার্চের কালরাতে নিরস্ত্র বাঙালির ওপর সশস্ত্র আক্রমণ চালিয়ে গণহত্যা শুরু করে। ২৬ মার্চের পূর্ব প্রহরেই বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা দেন এবং এর পরই অতি ভোরে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে তদানীন্তন পশ্চিম পাকিস্তানের কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর বাংলার জনগণ ৭ মার্চে বঙ্গবন্ধুর পল্টন ময়দানে প্রদত্ত ঐতিহাসিক ঘোষণা অনুযায়ী স্বতঃস্ফূর্তভাবে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। নয় মাস স্থায়ী মুক্তিযুদ্ধে শহীদ বুদ্ধিজীবী, অকুতোভয় মুক্তিযোদ্ধা ও ৩০ লাখ নিরস্ত্র জনগণের রক্ত এবং বীরাঙ্গনা মায়েদের ইজ্জতের বিনিময়ে সেক্যুলার বাংলাদেশ বিশ্বের মানচিত্রে সার্বভৌম রাষ্ট্রের মর্যাদা অর্জন করে। কিন্তু স্বাধীনতার মুকুল থেকে সমৃদ্ধির ফল আহরণের আগেই আমাদের দেশে ছন্দের পতন হয়ে যায়। ১৯৭৫ সালে ১৫ আগস্ট ক্ষমতার লোভী ও স্বাধীনতাবিরোধী কতিপয় অধস্তন সেনাসদস্য জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর ১০ বছরের পুত্র শেখ রাসেলসহ পরিবারের সবাইকে নির্মমভাবে হত্যা করে। শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা পরিবারসহ পশ্চিম জার্মানিতে তখন অবস্থান করায় বেঁচে যান।
বঙ্গবন্ধু যথেষ্ট ধার্মিক ছিলেন বলেই হৃদয়ের উপলব্ধি দিয়ে দুস্থ মানুষের কথা ভাবতেন। তাঁর বিশ্বাস ছিল, বাঙালিরা সাধারণভাবে যথেষ্ট ধার্মিক। তাই তিনি ১৯৭২ সালে প্রণীত সংবিধানের চারটি স্তম্ভ : গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার সঙ্গে (নবী মুহাম্মদ [সা.]-এর আমলে ৬২৮ সালে মক্কা ও মদিনার মধ্যে সম্পাদিত ‘হুদায়বিয়ার যুদ্ধবিরতি’ সনদের ন্যায়) ‘বিসমিল্লাহ’কে অন্তর্ভুক্ত করার প্রয়োজনবোধ করেননি। জীবনভর ধর্মনিরপেক্ষতার মনোভাব নিয়ে বাঙালির সংস্কৃতি রক্ষার্থে ভাষা আন্দোলন থেকে স্বাধীনতা অর্জন এবং বাঙালির ওপর তাঁর আন্তরিক বিশ্বাসের মর্যাদা রক্ষার্থে সমস্ত পরিবারসহ নিজের আত্মাহুতি দিয়েছেন, যা দার্শনিক সক্রেটিসের গৌরবকে অতিক্রম করেছে।
পাকিস্তান আমলের দুই দশকে বিভিন্ন রকমের কারাদ- বঙ্গবন্ধুকে কালজয়ী গুণাবলিতে সিক্ত ও অসামান্যভাবে মানবদরদি করেছিল। পাকিস্তানি অত্যাচার আমাদের স্বাধীনতার প্রেক্ষাপট সৃষ্টি করেছিল সত্য, কিন্তু শিক্ষাব্যবস্থায় তাদের ধর্মগত অপব্যবহার আমাদের জনগণের মধ্যে লোভ সঞ্চার করেছিল। ১৯৭৭ সালে বাংলাদেশ সংবিধান থেকে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ বাদ দেওয়া হয়। এর ফলে সর্বস্তরে শিক্ষিত জনগণের লোভ বেড়ে যায়। ক্ষমতার দ্বন্দ্ব ও প্রতিপত্তির লোভ শিক্ষায়তনগুলোতে ও পল্লী অঞ্চলে বিস্তৃত হয়। এই ‘লোভ’ এত গভীরভাবে প্রোথিত হয়েছিল যে ধর্মনিরপেক্ষতায় বিশ্বাসী জনগণও লোভে মোহগ্রস্ত হয়ে ধর্মনিরপেক্ষতার প্রকৃত মর্মার্থ বুঝতে ব্যর্থ হলো। আহমদ ছফার মতে ‘যারা মৌলবাদী তারা শতকরা একশ ভাগ মৌলবাদী। কিন্তু যারা প্রগতিশীল বলে দাবি করে থাকেন তাদের কেউ কেউ দশ ভাগ প্রগতিশীল, পঞ্চাশ ভাগ সুবিধাবাদী, পনেরো ভাগ কাপুরুষ, পাঁচ ভাগ একেবারে জড়বুদ্ধিসম্পন্ন।’ দুর্বল শিক্ষার কারণে শিক্ষিত ব্যক্তিবর্গও ক্রমান্বয়ে প্রকৃত ধর্ম, ধর্মহীনতা, ধর্মনিরপেক্ষতা ও অসাম্প্রদায়িকতার মধ্যে ভেদ ও অভেদ বুঝতে অক্ষম হলো। অতিরিক্ত লোভের বশবর্তী হয়ে বেশির ভাগ শিক্ষিত মানুষ সাধ্য অর্জন না করেই সাধ পূরণ করতে ঘৃণ্য-চক্রান্তে লিপ্ত হলো। ফলে দলে উপদল সৃষ্ট হলো।
পারস্পরিক অবিশ্বাস ও হিংসা-প্রতিহিংসা নিষ্ঠুর হত্যাকান্ডে পর্যবসিত হলো। আমাদের মূল্যবোধে ফাটল ধরল, নীতিবোধ বিলুপ্ত হলো এবং আমাদের জাতীয় পরিচয় আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বিশ্বাসযোগ্যতা হারাল। বাহাত্তরের সংবিধান পুনর্বহাল এবং শিক্ষার কোয়ালিটি উন্নয়নের জন্য বাংলাদেশে প্রথম ২০১০ সালে জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণীত হলেও আমাদের নৈতিকতা, বিচার-বুদ্ধি ও দায়িত্ববোধ ক্রমেই নিম্নমুখী হতে থাকল। সর্বস্তরে দেখা দিল অদক্ষতা ও পেশিশক্তির বাহুল্য। অসাম্প্রদায়িকতাকে ধর্মহীনতা আখ্যায়িত করে দুর্নীতিপরায়ণ ব্যক্তিরা এবং স্বাধীনতাবিরোধীরা মৌলবাদীদের উসকে দিয়ে সমাজে অস্থিরতা সৃষ্টি করতে লাগল। সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্তিমুক্ত করতে ২০১১ সালের পঞ্চদশ সংশোধনীতে ‘বাহাত্তরের সংবিধানের সঙ্গে দুটি উপবাক্য যোগ করা হয় : (১) ‘বিস্মিল্লাহির-রাহ্মানির রাহিম (দয়াময়, পরম দয়ালু, আল্লাহর নামে)/পরম করুণাময় সৃষ্টিকর্তার নামে’ এবং (২) ‘রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম, তবে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টানসহ অন্যান্য ধর্ম পালনে রাষ্ট্র সমমর্যাদা ও সমঅধিকার নিশ্চিত করিবেন।’ সম্প্রতি বাংলাদেশে সবচেয়ে জটিল সমস্যা হলো পরীক্ষার ‘প্রশ্নপত্র ফাঁস’। এর কারণ আমাদের বেশির ভাগ জনগোষ্ঠীর ধারণা, অর্থ সম্মানের এবং আরাম-আয়েশ আনন্দ পাওয়ার মাপকাঠি। তাই চাকরিপ্রার্থীরা চাকরি, চাকরিজীবীরা প্রমোশন, অভিভাবকরা সন্তানদের আরাম-আয়েশ ও শিক্ষার্থীরা কম পরিশ্রমে ভালো ফল অর্জনের জন্য ডিজিটাল ব্যবস্থাদির অপব্যবহার করছে নির্বিবাদে। তদুপরি আমাদের জবাবদিহি তেমন জোরালো নয় এবং দীর্ঘদিনের প্রশিক্ষণগত দুর্বলতা আমাদের মূল্যবোধকে ভোঁতা করে দিয়েছে। কম পরিশ্রমে লোভকে চরিতার্থ করতে আমরা মিথ্যা এবং ছলচাতুরীর আশ্রয় নেই। ফলে আমাদের কথা ও কাজের মধ্যে বিস্তর পার্থক্য থাকে। আমাদের সন্তানরা এতে বিভ্রান্ত হয়ে ভুল পথে চালিত হয়। আমাদের দেশে শিক্ষার্থীদের মেধা উন্নত বিশ্বের ছেলেমেয়েদের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। কিন্তু প্রাইমারি ধাপ থেকেই আমাদের অসংযত জীবনধারা ও দুর্বল প্রশিক্ষণ আমাদের শিক্ষার্থীদের সাধারণভাবে দুর্বল করছে। আমরা দলমতনির্বিশেষে লোভকে জয় করে যদি সংযত জীবনযাপন করতে পারি তবে সন্তানরা নিজেরাই সঠিক পথ নির্ধারণ করতে সক্ষম হবে।
আমাদের দেশেও বিভিন্নজনের বিশিষ্ট কোয়লিটি আছে। আমাদের পারস্পরিক বিভেদ ভুলে ‘যার যা আছে তাই নিয়ে’ যদি আমরা একত্রিত হতে পারি, তাহলে আমরা আমাদের সবরকম দুর্বলতাকে জয় করে এগোতে পারব। এখন দরকার আমাদের সচেতনতা, বিচার-বুদ্ধি প্রয়োগে লোভ-লালসাবিহীন মুক্তমনের অধিকারী হওয়া। এর একমাত্র ‘অলৌকিক ভেষজ’ বঙ্গবন্ধুর প্রদর্শিত ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’। ধর্মনিরপেক্ষতা এখন আর শুধু রাজনৈতিক স্লোগান নয়। আমাদের অর্জনকে রক্ষা এবং একে উন্নীত করতে ধর্মনিরপেক্ষতার গুরুত্ব হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করতে হবে। রাজনৈতিক বিভিন্নতার মাঝে ধর্মনিরপেক্ষতার বন্ধনশক্তি আমাদের এক কাতারে আনতে পারে। এতেই আমাদের মুক্তি ও শক্তি। আমাদের সন্তানরা লোভমুক্ত শিক্ষকদের মাধ্যমে কোয়ালিটি শিক্ষায় দীক্ষিত হয়ে সাহসী, পরিশ্রমী ও সৃজনশীল হবে এবং বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় সাফল্য অর্জনের দক্ষতা অর্জন করবে। তবেই হবে ‘সোনার বাংলা’ অর্জনে আমাদের জয়যাত্রা!! নোবেলজয়ী অমর্ত্য সেন বলেছেন, ‘দারিদ্র্য শুধু অর্থের অভাব নয়, এটা মানুষের পূর্ণশক্তির অবমূল্যায়নের ফসল।’
তথ্যসূত্র : [১] আহমদ ছফা, [সাম্প্রতিক বিবেচনা : বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস, (খান ব্রাদার্স অ্যান্ড কোম্পানি, ঢাকা, ১৯৯৭, পৃষ্ঠা ৪১) ISBN 9844081378]
[২] ‘হুদায়বিয়ার যুদ্ধবিরতি সনদ’
[সীরাতুন নবী (সা.), ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, তৃতীয় খ- (২০০৮), ISBN: 984-06-067-9]।
লেখক : প্রফেসর ইমেরিটাস
পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়